BAMCEF UNIFICATION CONFERENCE 7

Published on 10 Mar 2013 ALL INDIA BAMCEF UNIFICATION CONFERENCE HELD AT Dr.B. R. AMBEDKAR BHAVAN,DADAR,MUMBAI ON 2ND AND 3RD MARCH 2013. Mr.PALASH BISWAS (JOURNALIST -KOLKATA) DELIVERING HER SPEECH. http://www.youtube.com/watch?v=oLL-n6MrcoM http://youtu.be/oLL-n6MrcoM

Welcome

Website counter
website hit counter
website hit counters

Monday, June 2, 2014

মন ছুঁয়ে আছে মা ভূমি তেলেঙ্গানা পৃথক রাজ্য হল,কিন্তু মাভূমির লড়াই চলবে,আশা করি৷ পলাশ বিশ্বাস


মন ছুঁয়ে আছে মা ভূমি তেলেঙ্গানা

পৃথক রাজ্য হল,কিন্তু মাভূমির লড়াই চলবে,আশা করি৷


পলাশ বিশ্বাসbbc


মধ্যরাতে তেলেঙ্গানার বাসিন্দাদের উল্লাস,ফটোঃ বিবিসির সৌজন্যে

পৃথক রাজ্যের ঘোষণা বাস্তবায়িত হলে তেলেঙ্গানা হবে ভারতের ২৯তম রাজ্য। এ জন্য একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য করার বিষয়ে এর পরিকল্পনা রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করবে। এ ছাড়া অন্ধ্র প্রদেশের বিধানসভাকে এর মতামত জানাতে বলা হবে। এরপর প্রধানমন্ত্রী একটি কমিটি গঠন করে দেবেন। এই কমিটির কাজ হবে রাজ্যের তিনটি অঞ্চলের রাজস্ব ও পানি বণ্টনের মতো বিষয়গুলো কীভাবে সমাধান করা হবে, সে ব্যাপারে একটি মতৈক্যে পৌঁছানো। এ বিষয়ে কমিটি ওই তিন অঞ্চলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চালাবে। এরপর পার্লামেন্টের উচ্চ ও নিম্ন উভয় কক্ষে নতুন রাজ্য গঠনের বিষয়ে বিল উত্থাপন ও পাস করতে হবে। রাজ্য গঠনের এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে আগামী বছরের শুরুর দিকে। পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য করার দাবিতে পাঁচ দশক ধরে আন্দোলন চলে আসছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকার আকস্মিকভাবে ঘোষণা দেয়, নতুন তেলেঙ্গানা রাজ্য করার বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। তবে এর প্রতিবাদে অন্ধ্র প্রদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও রায়ালসীমা এলাকায় সহিংস বিক্ষোভ শুরু হলে সরকার পিছু হটে। এনডিটিভি।


মন ছুঁয়ে আছে মা ভূমি তেলেঙ্গানা

মাভূমি বাংলা সিনেমায় আমার প্রিয় ডাইরেক্টর গৌতম ঘোষের প্রথম ছবি,তেলুগু ভাষায় তেলেঙ্গানা আন্দোলনের ঔ উত্তাল সময় ধরার প্রবল প্রচেষ্টা।আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে গৌতম বাবুর সেই সময়ের অভিজ্ঞতা ছাপা হয়েছে।


অবশেষে,৬০ বছরের আন্দোলন, কত না মানুষের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের লক্ষ্য৷ সফল হল রবিবার মধ্যরাতে৷ গোটা সীমান্ধ্রের তরফে প্রবল প্রতিবাদ, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, হাজারো তর্ক-বিতর্ক পেরিয়ে রাত ১২টায় আনুষ্ঠানিক ভাবে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে বিভাজিত হয়ে দেশের ২৯তম রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল তেলেঙ্গানা৷


পৃথক রাজ্যেই কি তেলেঙ্গানা মাভূমির মা মাটি মানুষের মোক্ষ লাভ হল,প্রশ্ন আমার মনে৷

তেলেঙ্গানা নিয়ে আমি গোতম বাবুর মত সিনেমা করিনি৷ করার কথাও নয়৷


যদিও 2003 সাল নাগাদ কয়লা খনি অন্চল নিয়ে গৌতম বাবু যখন সিনেমা করার কথা ভাবছিলেন,তখন কয়লা খনি অন্চলে এককালে নাগাড়ে কাজ করার সুবাদে আমার সঙ্গেও তাঁর কথা হয়েছিল৷


আমাদের উদ্বাস্তু উপনিবেশে পাশের গ্রাম হরিদাসপুরে এক যাত্রা আসরে আমার বাল্যবন্ধু টেক্কাকে ঐ অনুষ্ঠানের সন্চালক চড় মেরে ছিল,...তিনি আবার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু  এবং ঐ হরিদাসপুর প্রাইমারি স্কুলের প্রাক্তনী হিসেবে ঐ গ্রামে ঘরে ঘরে আমার আত্মীযত,তবু  তীব্র প্রতিক্রিয়ায় আমি সেই রাতে যাত্র অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিলাম ছাত্র নেতার পেশীশক্তিতে,আবার শুরুও করেছিলাম৷কিন্তু গ্রাম্যমীমাংসা বৈঠকে বাবা সেই যে আমায় রেগে যাওয়ার কারণে তীব্র ভর্ত্সনা করলেন,যে সাংবাদিকতাকে আমি কখনো পাত্তা দিতে রাজি হইনি,কলেজের প্রোফেসার হতে চেয়েছিলাম এবং জেএনউতে এম ফিলএর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম,সেই সাংবাদিকতাই আমার জীবনযাপন হয়ে গেল রাতারাতি৷


ধানবাদে সাংবাদিকতায় আমার হাতে খড়ি৷টেকনিক্যালি কিছুই জানিনা,সরাসরি জেএনউ থেকে এসেছি বলেই সহকর্মিরা যে ভাবে ঠাট্টা ইযার্কি শুরু করলেন তার জবাব দিতে ইন্ডিয়ান স্কু অফ মাইন্সের স্পেশাল সহযোগিতায় আমি মাইনিং ইন্জিনিয়ারিং শিখলাম এবং চাসনালার বন্ধ খনির অভ্যন্তরেও ঢুকলাম৷প্রতিটি কয়লা খনিতে তখন আমার আনাগোনা৷কোল ইন্ডিয়ার অফিসার কুল আমার দাপটে থর হরিকম্পমান৷

সেই সময়ে আমি মহাশ্বেতাদির যাবতীয় সাহিত্য হিন্দিতে আদিবাসী ঝাড়খন্ডি জনগণের মাঝে আমার দৈনিক কাগজ মার্ফত ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম৷ঝাড়খন্ড আন্গোলনের ত্রিদেপ একে রায়,বিনোদবিহারি মাহাতো ও শিবু সোরেন তখন আমার বন্ধু৷সেই সময়ে মহাশ্বেতাদেবির সঙ্গে আলাপ ও সেই সম্পর্ক আজও নিবিড়,যদিও এককালে ভাষাবন্ধনের সম্পাদক মন্ডলিতে থাকা সত্বেও পরিবর্তনের পর পরিবর্তন পন্থী দিদির সহ্গে দেখা করিনি,যদিও ইতিমধ্যে মার্কি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমার লেখা উপন্যাস নিয়ে তিনি দৈনিক হিন্দুস্তানে এডিট পাতায় লিখেছেন এবং সবিতা প্রচন্ঢ অসন্তুষ্ট যে এর পরও দিদিকে আমি ফোন পর্যন্ত করিনি৷


হয়ত মহাশ্বেতাদির কথাতে সাংবাদিক বন্ধু ও প্রাক্তন সহকর্মী কৃপাশন্কর চৌবে মার্ফত গৌতম বাবু আমায় তাঁর গড়িয়াহাটের ফ্লাটে ডাকিয়েছিলেন,বা আমার বনধু ফিল্মমেকার রাজীব কুমার ও জোশী জোসেফের সঙ্গে আমার সিনেমায় কাজ কোনো ক্রমে তাঁর নজরে এসেছিল,যাই হোক সেদিন অন্ততঃ নিজের প্রোজেক্টে গৌতমবাবু আমায় ভেবেছিলেন৷কিন্তু ঘটনা হল তারপর থেকেই আমি সাংবাদিকতায় কাজে এক্কেবারে একা হতে শুুরু করি,এবং সিনেমার মত সময়সাপেক্ষ ডাইরেক্টর আধিবাত্যের মাধ্যমে সময় দেওয়ার মত মানসিকতা আর বেঁচে নেই৷


যাহোক,সেদিনও মাভূমির কথা উঠেছিল৷নাগরিকত্ব সংশোধণী বিল এসেছে এবং তারও আগে উত্তরাখন্ডে বাঙালি উদ্বাস্তুদের বাংলাদিশি অনুপ্রবেশকারি ঘোষমা করা হয়েছে৷কলকাতায যা যা করা সম্ভব ছিল করছি তখন৷


তারপর সেই আইনও হল এবং আমি তারপর থেকে নিজের স্বজন সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা মানুষদের অস্তত্বরক্ষার লড়াই চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আজ অবধি পিঠ বাঁচানোর কনো এভিন্যু খুঁজে পাইনি যেহেতু ততদিনে আমার বাবা পুলিন বাবু পিঠে ক্যান্সার নিয়ে সারা জীবন স্বজনদের লড়াই করতে করতে চিরকালের জন্য বিশ্রাম নিয়েছেন,তিনি যে বিপন্ন ব্রাত্য অন্ত্যজ বাঙালি অবাঙালি নির্বেশেষ এই উপমহাদেশে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা সর্বস্বহারাদের লড়াই লড়ে গিয়েছেন,সেই লড়াই থেকে অব্যাহকি পাওযার কোনো উপায় হয়নি আমার৷


গৌতম বাবু হয়ত নাগরিক সমাজের দৌলতে সেকথাো জানতেন৷

তাই মাভূমি মেজাজে বলেছিলেন সেদিন, পলাশ,লিখে কিচ্ছু হবে না৷কলমের বদলে রিভাল্ভর হাতে তুলে নাও৷

পারিনি৷

আমি পারিনি৷

কিন্তু ব্রাত্য অন্ত্যজ সর্বস্বহারাদের সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে,তাঁদের আশে পাশে কখনো আর যাইনি৷

যেমন পেশাদার সাংবাদিক হয়েও আমি প্রেস ক্লাবে যাইনা৷

ক্ষমতার মেরুকরণ কেন্দ্র যেমন বইমেলা,নন্দন রবীন্দ্রসদন চত্বর যাইনা যেদিন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হল সেই দিন থেকে৷

তেলেঙানার সঙ্গে আমার নাড়িরও কিন্চিত যোগ আছে৷

তেলেঙ্গানা আন্দোলন চরম বাম বিশ্বাসঘাতকতায় শেষ হওয়ার পরও সেই আন্দোলনের প্রেরণায় 1958 সালে নৈনিতালের তরাই অন্চলে ঢিমরি ব্লকে যে কৃষক বিদ্রোহ হয়,তার নেতা ছিলেন কিষান সভার নেতা আমার বাবা পুলিনবাবুর নেতৃত্বে৷ছোট বেলায় সেই আন্দোলনের জেরে চলা মোকদ্দমার শুনানির সময়ও বাবা আমাকে নিয়ে নৈনীতালের কোর্টে গিয়েছেন নির্দ্ভিধায়৷সাজা,জেল,শুনানি সব সেই দশ বছরের কম বয়সে দেখেছি৷দেখেছি নিজের চোখে জন আন্দোলনের মৃত্যু,কমরেডদের তিলি ক্ষয়ে যাওয়া,তাঁদের জীবন যন্ত্রণা৷

তারপরও তেলেঙ্গানার মানুষদের সঙ্গে মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়েছে৷

তেলেঙ্গানার আদিবাসী অন্চল থেকে আমি   আবার ফোনে অভিযোগ শুনি আদিবাসিদের যে সেকানে ভারতের সংবিধান,আইন,ন্যায় প্রণালী,গণতন্ত্রের কোনো অস্তিত্বই নেই৷

আজও ভূমি সংস্কার হয়নি৷

আজও তেলেঙ্গানায় নিজাম আমলের আইন বলবত৷

নূতন তেলেঙ্গানা মন্ত্রিসভায় সেই একই রকম স্বজনপোষণ দেখে আঁতকে উঠছি যা ঝাড়খন্ডে,উত্তরাখন্ডে এবং ছত্তিশগড়ে সেই সব আন্দোলনে সরিক হওযার সুবাদে পৃথক রাজ্য হওযার পর চাক্ষুষ দেখেচছি এ যাবত৷

পৃথক রাজ্য হল,কিন্তু মাভূমির লড়াই চলবে,আশা করি৷

আমি কিষেণ চন্দরের লেখা একটা ছোট উপন্যাস পড়ছিলাম, 'জব খেত জাগে'। গৌতমবাবু লিখেছেন৷লিখেছেন ঐ বইটিই মাভূমির প্রেরণা৷ঘটনাচক্রে ঐ বইখানি ছোটবেলা থেকেই আমার প্রিয় পাঠ্য৷সেখানেই আমি তেলেঙ্গানাকে ছুঁতে পারি এখনো৷

বিবিসির খবরঃ

ভারতের নতুন রাজ্য হল তেলেঙ্গানা

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে এর উত্তরাংশ নিয়ে গঠিত হয়েছে ভারতের নতুন রাজ্য তেলেঙ্গানা।

অন্ধ্রপ্রদেশের সাবেক ১০টি জেলা ও হায়দ্রাবাদ শহর নিয়ে নতুন এ রাজ্য গঠিত হয়েছে।

এর জনসংখ্যা তিন কোটি ৫০ লাখ।

এলাকাটির অধিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে নতুন রাজ্যের দাবি জানিয়ে আসছিল।

তেলেঙ্গানা আনুষ্ঠানিকভাবে স্থানীয় সময় মধ্যরাতে ভারতের ২৯তম রাজ্য হিসেবে গঠিত হয়।

আজ সোমবার ভোরে নতুন রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির নেতা কে চন্দ্রশেখর রাও।

রাজধানী হায়দ্রাবাদের রাজ্য ভবনে নতুন রাজ্যের আনুষ্ঠানিক শুরু ও প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।

তার আগে ইএসএল নরসীমান তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশের গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

আগামী দশ বছর তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রের একজনই গভর্নর থাকবেন এবং হায়দ্রাবাদ শহরই হবে দুই রাজ্যের রাজধানী।

এরপর নতুন রাজধানী হিসেবে কোনো জায়গা বেছে নিতে হবে অন্ধ্রপ্রদেশকে।

মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের সঙ্গে রাজ্য সরকারের ১২ জন মন্ত্রীও শপথ নেন। তেলেঙ্গানা রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য গত ১৪ বছর ধরে টিআরএস আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছিল।

তেলঙ্গানা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

তেলাঙ্গানা

తెలంగాణ


প্রস্তাবিত রাজ্য


ভারতের রাজ্যে তেলাঙ্গানার অবস্থান লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে


স্থানাঙ্ক: ১৮° উত্তর ৭৯° পূর্বস্থানাঙ্ক: ১৮° উত্তর ৭৯° পূর্ব


রাজ্য

অন্ধ্রপ্রদেশ

আয়তন[১]


• মোট

১,১৪,৮৪০

জনসংখ্যা (২০১১)


• মোট

৩,৫২,৮৬,৭৫৭

ভাষা


• সরকারি

তেলুগু

সময় অঞ্চল

ভারতীয় সময় (ইউটিসি+৫:৩০)

বৃহত্তম শহর

হায়দ্রাবাদ

তেলাঙ্গানা (তেলুগু: తెలంగాణ; উর্দু: تیلنگانا) হল ভারতের সর্বশেষ অনুমোদিত রাজ্য। এই অঞ্চলটি আগে নিজাম-শাসিতহায়দ্রাবাদ রাজ্যের (মেদক ও ওয়ারাঙ্গাল বিভাগ) অঙ্গ ছিল। তেলাঙ্গানার সীমানায় উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে মহারাষ্ট্র রাজ্য, পশ্চিম দিকে কর্ণাটক রাজ্য, উত্তর-পূর্ব দিকে ছত্তীসগঢ় এবং পূর্ব দিকে ওডিশা রাজ্য। অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য মোট তিনটি সাংস্কৃতিক অঞ্চলে বিভক্ত: তেলাঙ্গানা, উপকূলীয় অন্ধ্ররায়ালসীমা। তেলাঙ্গানা অঞ্চলের আয়তন ১১৪,৮৪০ বর্গকিলোমিটার (৪৪,৩৪০ বর্গমাইল) এবং জনসংখ্যা (২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে) ৩৫,২৮৬,৭৫৭ জন, যা অন্ধ্রপ্রদেশের মোট জনসংখ্যার ৪১.৬%।[২][৩][৪]

মোট দশটি জেলা নিয়ে তেলাঙ্গানা অঞ্চলটি গঠিত: হায়দ্রাবাদ, আদিলাবাদ, খাম্মাম, মেহবুবনগর, মেদক, নালগোন্ডা,নিজামাবাদ, রঙ্গরেড্ডিওয়ারাঙ্গলপূর্ব গোদাবরী জেলার (উপকূলীয় অন্ধ্রের অংশ) ভদ্রাচলমভেঙ্কটপুরম তালুক দুটিও ভৌগোলিক নৈকট্য ও প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য খাম্মাম জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আবার ১৯৫৯ সালে কৃষ্ণা জেলাথেকে মুনাগালা মণ্ডলটি নালগোন্ডা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মুসি, মঞ্জীরা, কৃষ্ণাগোদাবরী নদী এই অঞ্চলের উপর দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। হায়দ্রাবাদ ও ওয়ারাঙ্গাল হল এই অঞ্চলের বৃহত্তম দুটি শহর।

২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভায় পৃথক তেলাঙ্গানা রাজ্য গঠন সংক্রান্ত সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়।[৫][৬][৭]ভারত সরকার তেলাঙ্গানা রাজ্য গঠনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার জন্য বিচারপতি বি এন শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বে একটি পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে।[৮] ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই কেন্দ্রীয় শাসকদল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তেলাঙ্গানা অঞ্চলকে পৃথক রাজ্যে (ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ২৯তম রাজ্য) পরিণত করার জন্য সংবিধান-সম্মত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানায়। নতুন রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়াটি কমপক্ষে ১২২ দিন বা চার মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।[৯] হায়দ্রাবাদ শহরটিকে আগামী দশ বছরের জন্য তেলাঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশের যুগ্ম রাজধানী রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।[১০][১১] তবে নতুন রাজ্য গঠন করতে হলে এই প্রস্তাবে ভারতীয় সংসদরাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন। ২০১৩ সালের ৩ অক্টোবর, কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে পৃথক তেলাঙ্গানা রাজ্য গঠনের ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছে।[১২]

চিত্র:Hyderabad state from the Imperial Gazetteer of India, 1909.jpg

১৯০৯ সালে হায়দ্রাবাদ রাজ্য

পাদটীকা[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]


এই সময়: ৬০ বছরের আন্দোলন, কত না মানুষের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের লক্ষ্য৷ সফল হল রবিবার মধ্যরাতে৷ গোটা সীমান্ধ্রের তরফে প্রবল প্রতিবাদ, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, হাজারো তর্ক-বিতর্ক পেরিয়ে রাত ১২টায় আনুষ্ঠানিক ভাবে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে বিভাজিত হয়ে দেশের ২৯তম রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল তেলেঙ্গানা৷ ৯টা থেকে শুরু হওয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে হুসেন সাগর হ্রদের উপর অবিরাম আতসবাজিতে দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল নিজেদের রাজ্যকে বরণ করে নিলেন তেলেঙ্গানাবাসী৷


গত এক সপ্তাহ ধরেই চলছিল উত্‍সবের প্রস্ত্ততি৷ তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির উদ্যোগে পতাকার রং গোলাপিতে ঢেকে গিয়েছে হায়দরাবাদ শহর৷ মোড়ে মোড়ে পতাকা, ব্যানার, বেলুনে সাজানো, সঙ্গে বিরাট বিরাট কাট-আউট কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের৷ আজ নবতম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন সাম্প্রতিক কালে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা৷ মার্চ মাসে তেলেঙ্গানা গঠনের প্রতিবাদে অখণ্ড অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী কিরণ কুমার রেড্ডি ইস্তফা দেওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্রপতি শাসন জারি আছে গোটা রাজ্যে৷ হায়দরাবাদের রাজ ভবনে সকাল সওয়া ৮টায় নতুন মুখ্যমন্ত্রী শপথ নেওয়ার পর তেলেঙ্গানা থেকে তুলে নেওয়া হবে তা৷ সদ্য সমাপ্ত অন্ধ্রপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে তেলেঙ্গানা অংশের ১১৯টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৬৩টি জিতে নিয়েছিল রাওয়ের টিআরএস৷ সেই জনাদেশ মাথায় নিয়েই তেলেঙ্গানার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন তিনি৷


তেলেঙ্গানার জন্মমুহূর্ত যথাসম্ভব মসৃণ করতে গত এক সপ্তাহ কেন্দ্র থেকে রাজ্য নানা স্তরে চলেছে ব্যাপক ছুটোছুটি৷ শুক্রবার এই মর্মে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন অধুনা অন্ধ্রের রাজ্যপাল ইএসএল নরসিমহন৷ আগামি তিন মাস অস্থায়ীভাবে তেলেঙ্গানা-সীমান্ধ্র দুই রাজ্যেরই রাজ্যপাল থাকতে চলেছেন তিনি৷ অবশিষ্ট অন্ধ্রে অবশ্য এর পরেও জারি থাকতে চলেছে রাষ্ট্রপতি শাসন৷ এ বার বিধানসভা ভোটে সীমান্ধ্র অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সরকার গঠন করবে চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশম পার্টি৷ নাইডুর শপথ নেওয়ার কথা ৮ জুন৷


যেহেতু আগামি ১০ বছরের জন্য দু'রাজ্যেরই রাজধানী থাকতে চলেছে হায়দরাবাদ, তাই এই দুই শপথগ্রহণের জন্য আলাদা ব্যবস্থাপাতিও চলছে পুরোদমে৷ হায়দরাবাদের যে প্রশাসনিক কমপ্লেক্স থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের কাজকর্ম চলত, একই জায়গায় এ বার থেকে দুই রাজ্যের প্রশাসন চলবে৷ তবে তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রের জন্য নির্ধারিত হয়েছে আলাদা আলাদা বাড়ি ও ব্লক৷ অখণ্ড অন্ধ্রপ্রদেশের যে বিধানসভা ভবনটি ছিল, সেটি এ বার থেকে তেলেঙ্গানার বিধানসভা বলে পরিগণিত হবে৷ অবশিষ্ট অন্ধ্রের জন্য একই চত্বরে অন্য একটি ভবন নির্ধারিত হয়েছে৷ রাজ্যের সম্পত্তি ভাগাভাগির জটিল প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হতে অবশ্য বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে বলেই জানানো হয়েছে প্রশাসনিক সূত্রে৷ রাজ্যের বাইরে অখণ্ড অন্ধ্রের যে সব সম্পত্তি ছিল, যেমন দিল্লির অন্ধ্র ভবন, সে সবও আপাতত দুই রাজ্যের সম্পত্তি হিসেবেই গণ্য হবে৷ অন্ধ্র ভবনে অবশ্য দুই রাজ্যের ভিভিআইপি-দের ব্যবহারের জন্য ঘর নির্দিষ্ট করে রাখা হবে যাতে এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ না থাকে৷


সেই ১৯৫৩ সাল থেকে চলে আসছে তেলুগু ভাষাগোষ্ঠীর জন্য পৃথক রাজ্যের আন্দোলন৷ প্রতি ক্ষেত্রেই দু'পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে এসেছে প্রশাসন৷ নিজামি শাসনের হায়দরাবাদ রাজ্য (পরে মাদ্রাস প্রেসিডেন্সি) ভেঙে তৈরি হওয়া তেলেঙ্গানাকে নবনির্মিত অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয় ১৯৫৬ সালে৷ তার পর থেকে হায়দরাবাদকে কেন্দ্র করে উন্নতির শিখরে উঠেছে অন্ধ্র, কিন্ত্ত নানান সমস্যায় জর্জরিত বৃহত্তর তেলেঙ্গানা অঞ্চল থেকে গিয়েছে অন্ধকারেই৷ ভাষা পরিচয়, আর্থিক উন্নতির দাবিতে বিক্ষুব্ধ পৃথক তেলেঙ্গানাপন্থীদের কণ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন চন্দ্রশেখর রাও৷ ২০০৪ সালে টিডিপি ছেড়ে টিআরএস গঠন সেই উদ্দেশ্যেই৷ তখন পৃথক রাজ্যের সমর্থনে হাত মেলালেও বারবারই পিছিয়ে এসেছে কংগ্রেস নেতৃত্বও৷ এত দিন পরে শেষবেলায় এসে তড়িঘড়ি পৃথক তেলেঙ্গানায় তারা সিলমোহর দিল বটে৷ কিন্ত্ত তাতে আন্দোলনের দাবির প্রতি সহমর্মিতার থেকে রাজনৈতিক ভাবে প্রাসঙ্গিক থাকার প্রয়াসের গন্ধই বেশি৷


সে সব অবশ্য এখন অতীত৷ তেলেঙ্গানাবাসী ব্যালটে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁদের রায়৷ কংগ্রেসের দ্বিচারিতা নয়, টিআরএস-এর প্রতিরোধেই ভরসা রেখেছেন৷ ধুয়েমুছে গেছে কংগ্রেস৷ ৬ দশকের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল এসেছিল ভোটের অঙ্কে সওয়ার হয়ে৷ সব হিসেব-নিকেশ পেরিয়ে জিতে কিন্ত্ত গেল সেই আবেগই৷


তেলেঙ্গানার ওয়ার রুমে চলছে 'বহিরাগত'-সন্ধান


মা ভূমি

logo

আমার প্রথম ছবি

গৌতম ঘোষ

বিরাট একটা অ্যাডভেঞ্চারই বলা যায়, আমার প্রথম কাহিনিচিত্র বানানোর অভিজ্ঞতাটাকে। যে কোনও মানুষ তার প্রথম ফিচার ফিল্ম কল্পনা করে তার নিজের ভাষায়, বা যে ভাষায় সে অন্তত স্বচ্ছন্দ, তাতে। সেখানে আমি প্রথম ছবি বানালাম তেলুগু ভাষায়। ১৯৭৫-'৭৬ এর কথা, আমি তখন বিজ্ঞাপনী ছবি, তথ্যচিত্র বানাচ্ছি। ইচ্ছে ছিল, সমরেশ বসুর 'শ্রীমতী কাফে' নামের একটা উপন্যাস থেকে আমার প্রথম ছবি বানাব, নায়কের ভূমিকায় থাকবেন উত্তমকুমার। এ ছাড়াও অনেকগুলো চরিত্র ভেবেছিলাম, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে রবি ঘোষ, মমতাশংকর, এঁরা ভাবনায় ছিলেন। উত্তমবাবুর সঙ্গে কথাও এগিয়েছিল, উনি উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, তোমাদের মতো ইয়াং ডিরেক্টরদেরই তো এখন ছবির জগতে আসা উচিত। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল। মৃণালদার (সেন) 'মৃগয়া' ছবির প্রযোজক জি রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এলেন। আমার বানানো তথ্যচিত্র 'হাংরি অটাম' তখন বেশ সাড়া ফেলেছে। মৃণালদারও ছবিটা খুব প্রিয় ছিল, খুব গর্বভরে ছবিটার কথা বলতেন সবাইকে। তো নিজের প্রযোজককেও মৃণালদা ছবিটা দেখালেন। বললেন, একটা ইয়াং ছেলের বানানো নির্ভীক একটা ছবি, কাউকে ভয় না পেয়ে, সামাজিক পরিস্থিতি যা, তা-ই তুলে ধরেছে, দেখো। উনি ছবিটা দেখে আমাকে বললেন, আপনি হায়দরাবাদে এসে একটা ফিচার ছবি করুন। আমি একটু সময় চেয়ে নিলাম। কারণ প্রথমত, আমি তো বাংলাতেই আমার প্রথম ছবি করার কথা ভাবছিলাম। আর, হায়দরাবাদে গিয়ে ছবি বানালেও আমাকে এমন একটা বিষয় ভাবতে হবে, যার একটা জোরদার প্রাসঙ্গিকতা আছে, একটা আঞ্চলিক 'যোগ' আছে।

সেই সময় আমি কিষেণ চন্দরের লেখা একটা ছোট উপন্যাস পড়ছিলাম, 'জব খেত জাগে'। প্রেক্ষাপট তেলঙ্গানা কৃষক আন্দোলন। যেটা শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলন হিসেবে, পরে সশস্ত্র আন্দোলনে পরিণত হয়। সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় কৃষক আন্দোলন। পড়ে আমার মনে হল, এই বইটাকে ভিত্তি করে একটা ছবি হতে পারে। কারণ, সত্তর দশকের শেষের তেলঙ্গানাতেও তখন ভয়ংকর সামন্তশাসন, অত্যাচার, আর অসম্ভব দারিদ্র। মনে হল, ছবিটা বানালে কৃষকরা খুব উদ্বুদ্ধ হবেন, তাঁদেরই পূর্বপুরুষরা কী করে নিজামের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়েছিলেন, পরে ইন্ডিয়ান আর্মিও যখন হায়দরাবাদ অধিকার করতে এল, তাদের বিরুদ্ধেও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, সেই ইতিহাস মনে পড়বে ওঁদের। সিদ্ধান্ত নিলাম, ছবিটা করব। রিসার্চ, পড়াশোনা করলাম। আমি আর আমার কবি বন্ধু পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় মিলে চিত্রনাট্যও লিখলাম। ছবির নাম 'মা ভূমি', বাংলায় 'আমার দেশ'।

গেলাম হায়দরাবাদে। প্রযোজকদের বললাম, ছবিটা আমি হিন্দিতে করতে চাই। আমি তো হিন্দিটা তাও জানি। ওঁরা বললেন, হিন্দিতে হলে এই অন্ধ্র ও তেলঙ্গানার অসংখ্য মানুষ ছবিটা বুঝতেই পারবেন না। তেলুগুতেই করুন, একদম আপনার মতো করে করুন, আমাদের দিক থেকে কোনও রকম ব্যবসায়িক চাপ থাকবে না। এঁরা ছিলেন পড়াশোনা, গানবাজনা করা বুঝদার মানুষ, অনেকেই প্রোগ্রেসিভ থিয়েটার আর জননাট্যমণ্ডলীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মানসিকতাটাই অন্য রকম। আমি ছবিটা তেলুগুতে করতে রাজি হলাম। সঙ্গে এ-ও বললাম, স্ক্রিপ্ট আমি একটা লিখে এনেছি বটে, কিন্তু আমার একটু ঘুরে বেড়ানো দরকার। প্রথমে গেলাম সুরিয়াপেট নামের একটা জায়গায়, যেখান থেকে ১৯৪৬ সালে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আন্দোলনের যিনি প্রধান নেতা ছিলেন, তিনি পরবর্তী কালে মূল ধারার রাজনীতিতে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে অনেক ক্ষণ কথা বললাম। কথা বলে বেরিয়ে আসছি, স্থানীয় এক জন লোক আমার দোভাষীকে বললেন, দর্শকালু (তেলুগু ভাষায় এর অর্থ পরিচালক, মানে আমি) তো আসল লোকের সঙ্গে কথা না বলেই চলে যাচ্ছেন। আমায় নিয়ে গেলেন আব্বাস আলি নামে এক জনের কাছে। তিনি নিজে লড়াই করেছিলেন সেই যুগে, গায়ে তিনটে বুলেটের দাগ সাক্ষী। তাঁর কাছ থেকে ওই সময়ের ঘটনা শুনে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। কী স্বপ্ন নিয়ে, লক্ষ্য নিয়ে ওঁরা সেই সময় প্রবল প্রতাপী নিজাম আর তার রাজাকারদের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন, বুঝতে পারলাম। অনেক জায়গা ঘুরলাম, বহু বিপ্লবী যাঁরা তখনও জীবিত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করলাম, কথা বললাম। এই সব কিছুর পর পার্থ আর আমি ঠিক করলাম, কলকাতা থেকে লিখে আনা স্ক্রিপ্টটা আমাদের এক্ষুনি ছিঁড়ে ফেলা উচিত। আমরা আদতে কিছুই বুঝিনি, কল্পনা আর রোম্যান্টিকতায় সাঁতলানো একটা স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম।

নতুন স্ক্রিপ্ট লেখা হল। আরও জায়গা ঘুরে, আরও মানুষের সঙ্গে কথা বলে, লোকেশন দেখে। আরও দুজন, প্রাণ রাও ও নরসিং রাও, আমাদের স্ক্রিপ্ট লেখায় সহযোগিতা করলেন। এক দিন শেষ হল চিত্রনাট্য। দেখা গেল, ছবিটা এমন বিশাল একটা স্কেল নিয়েছে, যা আমরা ভাবতেও পারিনি। বিরাট পরিসর, অসংখ্য সংঘর্ষ-দৃশ্য, ওয়ার সিন শুট করতে হবে আমাদের। অথচ বাজেট নিতান্ত কম, সাদা-কালোয় করতে হবে ওই পয়সার অভাবেই। তারুণ্য, আবেগ, সংকল্প, সব কিছু নিয়ে আমরাও যেন আগুনে ঝাঁপ দিলাম। প্রযোজকরাও আমারই মতো স্বপ্নবিলাসী ছিলেন, কী হবে না হবে অত কিছু ভাবেননি। শুরু তো করি, শেষ দেখা যাবে পরে।

ঠিক হল, প্রধান চরিত্র 'রামাইয়া' করবেন জি নারায়ণ রাও। উনি মৃণাল সেন-এর 'ওকা উরি কথা'র নায়ক ছিলেন। শুট শুরু হতে মাত্র ক'দিন বাকি, উনি মৃণালদার ছবির জন্য বিদেশে চলে গেলেন। আমার পক্ষে শুটিং শিডিউল পালটানো সম্ভব ছিল না। মরিয়া হয়ে খুঁজতে লাগলাম বিকল্প কাউকে। এতটাই মরিয়া তখন, ভেবেছিলাম, চেহারাটা শুধু মানানসই হোক, অভিনয় না জানলেও চলবে। আমি ঠিক করিয়ে নিতে পারব। খুঁজতে খুঁজতে তেলুগু সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক গোপী চাঁদ-এর ছেলে সাই চাঁদ-কে পেলাম। সে বলল, অভিনয় তো দূরস্থান, আমি জীবনে একটা আবৃত্তি পর্যন্ত করিনি। যা হোক, আমার মনে হয়েছিল সাই পারবে। মুশকিল হল বাকি কাস্টিং নিয়ে। এত চরিত্র কোথায় পাব? জনাকয়েক পেলাম, যাদের তেলুগু থিয়েটারের কিছুটা অভিজ্ঞতা ছিল। আর নেওয়া হল প্রচুর গ্রামবাসীকে। আজ এত বছর পরও অবাক হয়ে ভাবি, এই গ্রামবাসীরা কী করে এমন অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। আসলে অভিনয় সম্পর্কে ওঁদের কোনও পূর্ব-ধারণা ছিল না। ওঁরা যা করেছিলেন, সেটাকে একেবারে ঘটমান বাস্তব হিসেবে করেছিলেন। চরিত্রগুলো তাই খুব বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল। ওঁরাও এতটাই 'ইনভল্ভ্ড' হয়ে পড়েছিলেন, কতকগুলো সংঘর্ষের দৃশ্যের শুটিংয়ে রক্তারক্তি পর্যন্ত হয়েছিল। লাঠি দিয়ে মারার দৃশ্যে কেউ সত্যি সত্যি লাঠির ঘায়ে মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছেন। ইমোশন সামলাতে পারছেন না। এটা অভিনয়, সত্যি না, সেটা বোঝাতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল।

আমরা প্রায় থেকেই গেছিলাম ওখানে। মাঝেমধ্যে টাকা আসছে, সেইমতো শুট করছি। প্রথম দুটো শিডিউল শেষে অর্থাভাবে শুট আটকেও গিয়েছিল। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ছবি শেষ হল। এমন অবস্থাও হয়েছে, লাঞ্চের পয়সা নেই, গ্রামবাসীরাই রান্না করে আমাদের খাইয়েছেন। কিন্তু পয়সা নেই বলে আমাদের কারও মনোবল ভেঙে যায়নি। বরং এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল যে কখনও কখনও মনে হত, আমরা সত্যিকারের তেলঙ্গানা আন্দোলনের মধ্যেই দিন যাপন করছি।

এক বছরেরও ওপর চলল সেই অ্যাডভেঞ্চার। ১৯৮০-র ২৩ মার্চ অন্ধ্রপ্রদেশের ৩০টিরও বেশি হল-এ মুক্তি পেল 'মা ভূমি'। আমরা কল্পনাও করিনি, যে ছবিতে কোনও স্টার নেই, যার বিষয়বস্তু একেবারেই ভিন্ন, পরিচালকের নামটা পর্যন্ত কেউ জানে না, সেই ছবির ব্যবসায়িক ভবিষ্যৎ কী হবে। রিলিজের দিন আমার সাহসই হয়নি হল-এ যাওয়ার। ছোট্ট একটা ইরানি ক্যাফে ছিল, সেখানে লুকিয়ে ছিলাম, কফি খাচ্ছিলাম। এমন সময় আমার চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের ভাই দৌড়ে এসে আমাকে জানাল, তুমি এখানে বসে আছ? ও দিকে হল তো ফেটে পড়ছে, সবাই হাততালি দিচ্ছে! ছবি তো হিট! সত্যিই তাই। দারুণ ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছিল 'মা ভূমি'। হায়দরাবাদের হল-এ এক বছর চলেছিল ছবিটা। দুশো, তার পর তিনশো দিনের সেলিব্রেশন হয়েছিল, মনে আছে। সঙ্গে ছিল বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছবিটা নিয়ে লেখালিখি— রিভিউ, ফিচার, এমনকী প্রথম পাতার খবর। আমার প্রথম ছবির বহুল প্রচারে সংবাদমাধ্যমের অবদানও তাই কম নয়। ছবির পরিবেশকের বড় বড় হোর্ডিং করার টাকা ছিল না, সীমিত সাধ্যে যেটুকু সম্ভব, করেছিলেন।

আশির ২৪ জুলাই, তখনও আমি হায়দরাবাদে। 'মা ভূমি'র সাফল্যে তখন নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে। দিনটা আমার জন্মদিনও, তাই মাকে ফোন করেছি কলকাতায়, আশীর্বাদ নিতে। মা জানালেন, উত্তমকুমার মারা গেছেন। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। প্রথম ছবি তো ওঁকে নিয়ে করব ভেবেছিলাম! 'মা ভূমি' হল, কিন্তু উত্তমকুমারকে নিয়ে আমার আর ছবি করা হল না।

তবু, 'মা ভূমি' বানানোর স্মৃতি, প্রথম প্রেমের মতো। অতখানি আবেগ, পরিশ্রম জড়িয়েছিল, কোনও কিছুই অসম্ভব বলে মনে হয়নি। কোনও পরিস্থিতিতেই পিছিয়ে আসিনি। অনেকে বলেছিলেন, প্রথম ছবিই এত বড় ক্যানভাসে করছ, একটু বেশি দুঃসাহসিক কাজ হয়ে যাচ্ছে। আমার কিন্তু মনে হয়েছিল, আমি পারব। চৌত্রিশ বছর হয়ে গেল, এখনও কিছু মানুষ আছেন যাঁরা 'মা ভূমি' রিলিজের দিনটা সেলিব্রেট করেন। এখন তেলঙ্গানা নতুন রাজ্য হয়েছে, আমার প্রথম ছবি এখন অনেক মানুষের সম্পদ। এর থেকে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে!

goutamghose@gmail.com


Telangana Rebellion

From Wikipedia, the free encyclopedia

Not to be confused with Telangana movement.

Telangana Rebellion



Date

1946 to 1951

Location

Hyderabad State, India



Belligerents


Razakars, Reddys,Velamas and other Feudal Landlords

People of Hyderabad State


Communism in India

Indicom.PNG

Communist Party of India

Communist Party of India (Marxist)

Socialist Unity Centre of India (Communist)

Portal icon Communism portal

The Telangana Rebellion (Telugu: Vetti Chakiri Udyamam Bonded Labour Movement or Telangana Raithanga Sayudha PoratamTelanana Peasants Armed Struggle) was a peasant rebellion against the feudal lords of the Telangana region and later against the princely state of Hyderabad between 1946 and 1951.

Contents

 [hide]

Communist led[edit]

Vetti Chakiri Udyamam[edit]

Telangana Rebellion District

The communists were as surprised as everyone else to see their efforts culminate in a series of successful attempts at organising the rebellion and the distribution of land. With the Nizam holding on, even after the proclamation of Indian Independence, the communists stepped up their campaign stating that the flag of the Indian union was also the flag of the people of Hyderabad, much against the wishes of the ruling Asaf Jah dynasty.[1]

The revolt started in 1946 in the Nalgonda district against the oppressive feudal lords and quickly spread to the Warangal and Bidar districts in around 4000 villages. Peasant farmers and labourers revolted against local feudallandlords (jagirdars and deshmukhs),[2] who were ruling the villages known as samsthans. These samsthans were ruled mostly by Reddys andVelama,[citation needed] known as doralu. They ruled over the communities in the village and managed the tax collections (revenues) and owned almost all the land in that area. The Nizam had little control over these regions, barring the capital Hyderabad. Chakali Ilamma, belonging to a the Rajaka caste, had revolted against 'zamindar' Ramachandra Reddy,[3] during the struggle when he tried to take her 4 acres of land. Her revolt inspired many to join the movement.

The agitation led by Communists was successful in liberating over 3000 villages from the feudal lords and 10,000 acres of agriculture land was distributed to landless peasants. Around 4000 peasants lost their lives in the struggle fighting feudal private armies.

It later became a fight against Nizam. The initial modest aims were to do away with the illegal and excessive exploitation meted out by these feudal lords in the name of bonded labour. The most strident demand was for the writing off of all debts of the peasants that were manipulated by the feudal lords.

Nizam's resistance to join Indian Union[edit]

With Hyderabad's administration failing after 1945, the Nizam succumbed to the pressure of the Muslim elite and started the Razzakar Movement, which was very violent and was also responsible for forcible conversions of religion. At the same time the Nizam was resisting the Indian government's efforts to bring the Hyderabad state into the Indian Union. The government sent the army in September 1948 to annex the Hyderabad state into Indian Union. The Communist party had already instigated the peasants to use guerrilla tactics against the Razzakars and around 3000 villages (about 41000 sq. kilometres) had come under peasant rule. The landlords were either killed or driven out and the land was redistributed. These victorious villages established communes reminiscent of Soviet mir (social)s to administer their region. These community governments were integrated regionally into a central organization. The rebellion was led by the Communist Party of Indiaunder the banner of Andhra Mahasabha.

Among the well-known individuals at the forefront of the movement were Ravi Narayana Reddy, Puchalapalli Sundarayya, Pillaipalli Papireddy, Suddala Hanmanthu, Chandra Rajeswara Rao, Bommagani Dharma Bhiksham, Makhdoom Mohiuddin,Sulaiman Areeb, Hassan Nasir, Manthrala Adi Reddy, Bhimreddy Narasimha Reddy, Mallu Venkata Narasimha Reddy, Mallu Swarajyam.

The violent phase of the movement ended in 1951, when the last guerilla squads were subdued in the Telengana region.[4]

Annexation of Hyderabad State[edit]

The rebellion and the subsequent police action led to the liberation of Hyderabad state from the Nizam's rule on 17 September 1948 and after a temporary military administration the dominion was eventually merged into the Indian Union. In the process tens of thousands of people lost their life, majority of them Muslims.[5] The Last Nizam Asaf Jah VII was made theRajpramukh of the Hyderabad State from 26th January 1950 to 31st October 1956. The elections of 1952 led to the victory of the Congress party in Hyderabad state. Burgula Ramakrishna Rao was first chief minister of the Hyderabad state from 1952 to 1956. In 1956, Hyderabad State was merged with Andhra state to form the present day Andhra Pradesh State. It was again separated from Andhra Pradesh into the Telangana State in 2014.

The revolt ensured the Land reform[edit]

The revolt ensured the victory of the Communist Party in Andhra Pradesh in the 1952 elections. Land reforms were recognised as important and various acts were passed to implement them.[6]

In popular culture[edit]

See also[edit]

References[edit]

  • Thirumali, Inukonda (2003). Against Dora and Nizam: People's Movement in Telangana. Kanishka Publishers, New Delhi. ISBN 81-7391-579-2.

External links[edit]

Categories:

বর্তমান ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহ — একটি প্রাথমিক আলোচনা

অগাষ্ট 19, 2013 মন্তব্য দিন

পূর্ব-কথা

ভারতীয় বিপ্লবের সামনে হাজার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর একটা বড় অংশই অবশ্য বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের যে সামগ্রিক বিপর্যয় চলছে তার সাথে অঙ্গীভূত হয়ে রয়েছে। এত দিনের সমাজতন্ত্র অনুশীলনের ব্যর্থতার কারণগুলি গভীরভাবে অনুসন্ধান এবং তার থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুনভাবে চলার একটা সাধারণ রূপরেখা নির্ণয়ের উপর বহুলাংশে নির্ভর করবে এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার উপায়। কিন্তু ভারতীয় বিপ্লবের ক্ষেত্রে এই সাধারণ সমস্যা ছাড়াও একটি অতিরিক্ত সমস্যা আছে। শুধু এর বিশালত্ব নয়, বহু জাতিসত্তার এই দেশের সীমাহীন বৈচিত্র্য, বহু বর্ণাঢ্য আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, অর্থনৈতিক বিকাশের জটিল ইতিহাস, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও জাতপাত প্রথা সহ ধর্ম ও সংস্কৃতির এক একান্ত নিজস্বতা, সর্বোপরি বহু জাতিসত্তার একটি দেশ হয়েও একটি একক ভারতীয় মানসিকতা এবং একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার মধ্যে যে টানাপোড়েন— এ সবই এই দেশটিকে ঠিক মতো বুঝে ওঠার ক্ষেত্রে এক বিশাল বাধা। এ বাধা অতিক্রম করে সম্পূর্ণ নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিতে এই দেশকে বিশ্লেষণ করে একে ঠিক ঠিক বুঝতে পারা এমনিতেই এক দুরূহ কাজ। এ কাজ করার মতো একটি কমিউনিস্ট পার্টি তো নেই-ই, এমনকি এটি আংশিকভাবে করতে গেলেও আত্মমুখিনতাকে যেভাবে পরাস্ত করতে হবে, যে সাহসভরে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তা করতে সক্ষম বা ধাপে ধাপে সেই সক্ষমতা অর্জনের দিকে এগোচ্ছে এমন কোন স্পষ্ট ছবি দেখা যাচ্ছে না।

এমনিতেই আত্মমুখিনতার ঝোঁক ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বরাবরই লক্ষিত হয়েছে। তারই পরিণতিতে হয় দক্ষিণপন্থী নয়ত অতিবামপন্থী বিচ্যুতি ধারাবাহিকভাবে এ আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ১৯৬৭-তে শুরু হওয়া ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবী আন্দোলনও এ রকম একটি জটিল দেশকে দেখতে শুরু করেছিল ঐ ঐতিহ্যের পরম্পরা বহন করেই। ফলে এই মহান আন্দোলন ভারতের বুকে চেপে বসা সংশোধনবাদের একচ্ছত্র আধিপত্যকে এক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেললেও, সশস্ত্র সংগ্রামের ও কৃষি বিপ্লবের প্রশ্নটি আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে অত্যন্ত জোরের সাথে উত্থাপিত করলেও, আমাদের দেশটিকে ঠিক মত বোঝার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই একপেশে হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হলো যখন তখনকার অবিসংবাদী আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব চীনের কমিউনিস্ট পার্টিও তার ভারতীয় কমরেডদের একপেশেপনা, আত্মমুখিনতা ও অদূরদর্শিতাকে প্রকারান্তরে উত্সাহ দিয়ে ফেললো। এ সবের যোগফলে বিগত চার দশকের বেশি সময় জুড়ে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের রণনীতি ও রণকৌশল নির্ণয়ে বারবার ভুল হয়েই চলেছে এবং এখনও এই দুষ্টচক্র থেকে বেরোবার কোন স্পষ্ট লক্ষণ নেই।

প্রতিটি দেশের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। তাই প্রতিটি দেশেরই বাস্তব অবস্থার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেই সে দেশের বিপ্লবের প্রকরণ নির্ণয় করতে হয় এবং এ কাজটির দায়িত্ব সব চেয়ে ভালভাবে নিতে পারে সেই দেশেরই কমিউনিস্ট পার্টি, অন্য কোন দেশ নয়, অন্য কোন আন্তর্জাতিক কেন্দ্রও নয়। কাগজে কলমে কোথাওই এ সত্য অস্বীকার না করেও অনুশীলনের সময়ে তাকে লঙ্ঘন করাই যেন একটি বড় পর্যায় জুড়ে পৃথিবীর কমিউনিস্ট আন্দোলনের দস্তুর হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশেও প্রায় প্রথম থেকেই ভিন্ন দেশের কোনও কমিউনিস্ট পার্টি বা আন্তর্জাতিক কেন্দ্র দ্বারা পরিচালিত হবার সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। এটি শুধু আমাদেরই সীমাবদ্ধতা নয়, যাঁরা পরিচালিত করার চেষ্টা করেছেন তাঁদেরও ভ্রান্তি। এ ভুলেরই একটি মূর্ত প্রকাশ যা গত কয়েক দশক পৃথিবীর কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পীড়িত করেছে, তা হচ্ছে যে কোন দেশের বিপ্লবকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে দেবার চেষ্টা। মতাদর্শগতভাবে দুর্বল (যেটা প্রায় ধরেই নেওয়া যায়) একটি কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে বিপদ হলো যখনই সে বুঝতে পারলো কোনও একটি দেশের ধাঁচে তার দেশের বিপ্লব সংঘটিত হবে তখন অনিবার্যভাবে সেই 'মডেল' দেশটির মত করে নিজের দেশকে ভাবতে শুরু করা। সেই দেশের সাথে তার নিজের দেশের মিলগুলিকেই সে দেখতে পায়। যেন তীব্রভাবে দেখতে চায় বলেই দেখতে পায়। অমিলগুলিকে দেখতে চায় না বলেই দেখতে পায় না। এটি কোনও সততা অসততার প্রশ্ন নয়। এটি দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। আমাদের দেশে এই সমস্যাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি। ১৯৬৭ থেকে '৭০ পর্যন্ত এখানকার কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের এমন দ্বিধাহীন ও অকুণ্ঠ সমর্থন সে দিয়ে গেছে যে এখানকার কমিউনিস্টরা ভাবতে শুরু করলো ঠিক চীনের মত করেই আমাদের দেশের বিপ্লব হবে। তারপর বিপদ যখন ঘনীভূত হয়ে গেছে তখন সিপিআই(এমএল)-এর প্রতিনিধিদের দেওয়া নিজের দেশকে চেনার পরামর্শ তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। '৬৭-র মে থেকে শুরু হওয়া সিপিসি-র লাগাতার সমর্থন ভারতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত এমনভাবে এখানকার কমরেডদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে যে তারপর আর রাশ টানার অবকাশ ছিল না। আন্দোলনের একেবারে প্রথম পর্বে যে মোহাচ্ছন্নতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যে মোহাচ্ছন্নতা একটি বিশেষ দৃষ্টিতে ভারতকে দেখতে শিখিয়েছে তা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের একটা বড় অংশকে আজও আক্রান্ত করে রেখেছে। আমাদের দেশকে, বিগত দশকগুলিতে যে সব গভীর পরিবর্তন এ দেশে ঘটে গেছে তা সহই মুক্ত মনে, নতুন করে দেখার ক্ষেত্রে বিশাল প্রতিবন্ধকতা আজও থেকে গেছে।

এরই সঙ্গে একবিংশতি শতকের কমিউনিস্টদের বহু কিছুই একটু নতুন করে দেখা ও ভাবা ও একটু সাহস ভরে অতীতের অবস্থানগুলি নতুন করে মূল্যায়ন করার ব্যাপারে যে সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি হয়েছে তাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিরাট বিপর্যয় একদিকে যেমন হতাশার আবহাওয়া তৈরি করেছে একই সঙ্গে তা মডেল সর্বস্বতাকে ভেঙে নতুন সৃষ্টির বৈষয়িক ভিত্তি তৈরি করেছে। কোন পূর্বধারণায় আচ্ছন্ন না থেকে আমাদের দেশকে বোঝার চেষ্টা করাই সম্ভবত এই দশকে ভারতের কমিউনিস্টদের অন্যতম একটি বড় কাজ, এ কাজে অবশ্যই বিপদ আছে। আত্মমুখিনতা যখন একটি চিহ্নিত ব্যাধি তখন এ কাজ করতে গিয়ে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা তো থাকবেই! সে ব্যাপারে সাধ্যমত সতর্ক থেকেই আমরা বর্তমান নিবন্ধে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। উল্লেখ করে নেওয়া ভালো যে বর্তমান ভারতকে বোঝার জন্য আমরা ২০০৪-০৫ এর তথ্যকেই হাতিয়ার করতে বাধ্য হয়েছি। এর পরের কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য আমরা পাই নি।

প্রথমে ঔপনিবেশিক আমলের ভারতীয় অর্থনীতির কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে শুরু করা যায়। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে ঐ গোটা পর্যায় জুড়ে ব্রিটিশ শাসন ভারতের অর্থনীতিতে পুঁজির স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করে এক বিকৃত বিকাশ চাপিয়ে দিয়েছিলো। এ ব্যাপারেও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতের কৃষিক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন সম্পর্কে টিকিয়ে রেখেছিল। দেশে উত্পাদিত কাঁচামাল নিজেদের দখলে রেখে তা ইংল্যান্ডের শিল্পের জন্য যোগান দেওয়া, এ দেশের অত্যন্ত সীমাবদ্ধ পণ্যবাজার বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া, লগ্নী পুঁজির অনুপ্রবেশ, বাণিজ্যিক পুঁজির প্রাধান্য, শিল্পপুঁজির বিকাশকে করে তুলেছে ধীরগতি ও বিকৃত। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে সামন্ততন্ত্রের ক্ষয়ও হয়েছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। ১৭৯৩ সালে কর্ণওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে জমিদারদের হাতে জমি কেনাবেচার অধিকার অর্পণ করে জমিদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং এইভাবে তাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়াও করে ফেলে। ঔপনিবেশিক ভারতে অর্থনৈতিক বিকাশের এই ছকটি আমাদের চেনা এবং বহুচর্চিত। কিন্তু যে বিষয়টা কমিউনিস্ট বিপ্লবী মহলে বিশেষ আলোচিত হয় না তা হলো ধীর এবং বিকৃত পুঁজিবাদী বিকাশের সাধারণ কাঠামোর মধ্যেই ভারতে শিল্পপুঁজির স্থিরগতি ও আপেক্ষিকভাবে উন্নত এক বিকাশের ইতিহাস যা অন্যান্য কোনও পশ্চাত্পদ ঔপনিবেশিক দেশের পুঁজির বিকাশের সঙ্গে তুলনীয় নয়। কেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু আগে ১৯২৫ সালে এক বক্তৃতায় কমঃ স্ট্যালিন এই বিশেষত্বটির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন, আশ্চর্যজনকভাবে তা কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরে কোনও মনোযোগ দাবী করেনি। অথচ আজকের ভারতকে বুঝতে প্রাক-'৪৭ ভারতের এই বিশিষ্টতাকে হিসেবে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি বিষয়। (প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক এবং নির্ভরশীল দেশগুলির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচ্যের শ্রমজীবী মানুষের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য। রচনাবলী ৭ম খণ্ড) আজকের ভারতকে বস্তুনিষ্ঠভাবে বুঝতে চেষ্টা করার প্রারম্ভবিন্দু হিসেবে প্রায় এক শতাব্দী আগের স্ট্যালিনকৃত মূল্যায়নটির অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা প্রাসঙ্গিক অংশটি উদ্ধৃত করছি।

''আজকের সময়ের উপনিবেশ এবং নির্ভরশীল দেশগুলির নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আজ আর কোন একক এবং সাধারণ সূত্রবদ্ধ ঔপনিবেশিক প্রাচ্যের অস্তিত্ব নেই। আগে ঔপনিবেশিক প্রাচ্যকে দেখা হতো একটি সমসত্ত্ব বিশিষ্ট সমগ্র হিসেবে। আজ আর সেই ছবিটি বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আজ আমাদের সামনে রয়েছে ঔপনিবেশিক এবং নির্ভরশীল দেশের অন্ততপক্ষে তিনটি বর্গ। প্রথমতঃ মরক্কোর মত দেশগুলি,যেখানে সর্বহারার হয় কোন অস্তিত্ব নেই, বা থাকলেও খুব কমই আছে এবং যেগুলি শিল্পগতভাবে খুবই অবিকশিত। দ্বিতীয়ত চীন ও মিশরের মত দেশগুলি, যেগুলির শিল্পগতভাবে স্বল্পোন্নত এবং যেখানে আপেক্ষিকভাবে কম সংখ্যক সর্বহারার উপস্থিতি রয়েছে। তৃতীয়ত ভারতের মত দেশ যেগুলি পুঁজিবাদী রূপে কমবেশি উন্নত এবং যেখানে আছে কমবেশি প্রচুর সংখ্যক জাতীয় সর্বহারার উপস্থিতি।

স্পষ্টতই এই সকল দেশকে সম্ভবত একে অপরের সমতুল হিসেবে উপস্থিত করা যায় না।''

কমঃ স্ট্যালিনের এই বক্তব্য আজকের ভারতীয় অর্থনীতি তথা রাজনীতি বোঝার জন্যই শুধু নয়, আগেকার ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে পুঁজিবাদের বিকাশধারাকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত সেই বিচারেও অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। বিগত কয়েক দশক ধরে কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরে লালিত ও সম্পূর্ণ প্রশ্নহীনভাবে গৃহীত দুটি স্বতঃসিদ্ধকে এ বক্তব্য নতুনভাবে ভাবাকে উত্সাহিত করে। প্রথমতঃ প্রায় এক শতাব্দী আগেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যে থেকেও ভারতে পুঁজিবাদের এই আপেক্ষিক বিকাশ কীভাবে সম্ভব হলো এবং তারই গতিধারায় পরের প্রায় ১০০ বছরে পুঁজিবাদের ক্রমবিকাশ কোথায় গিয়ে পৌঁছুতে পারে! দ্বিতীয়তঃ সমস্ত পৃথিবীকে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক— এই দুই প্রশস্ত বর্গে ভাগ করে এর একেকটিকে সম্পূর্ণ সমসত্ত্ব ভাবার নিশ্চিন্ত ও সাদরে লালিত অভ্যাসটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই অতিসরলীকরণের ঝোঁক বিষময় পরিণতির জন্ম দিয়েছে। ঔপনিবেশিক দেশের বিপ্লবের সবচেয়ে সফল অভিজ্ঞতায় দেশটির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রমাণ করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা বিগত কয়েক দশকের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রেখেছে। অথচ কমরেড স্ট্যালিন গত শতাব্দীর প্রায় গোড়ার দিকেই ঔপনিবেশিক দেশগুলির সমসত্ত্বতার ধারণাকে নাকচ করে ভিন্নতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং তা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদের বিকাশের মাত্রার ভিন্নতাকেই মানদণ্ড করেছেন। তারও আগে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত ''সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর'' গ্রন্থে লেনিন পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের যুগে পৃথিবীকে উপনিবেশের মালিক দেশসমূহ আর তাদের উপনিবেশ, কেবলমাত্র এ দুভাগে ভাগ না করে নির্ভরশীল দেশগুলির বহুবিচিত্র রূপের কথা উল্লেখ করেন। ''ফিনান্স পুঁজি এবং তার বিদেশ নীতি… রাষ্ট্রীয় নির্ভরশীলতার (State dependence) অনেকগুলি উত্ক্রমণকালীন রূপের জন্ম দেয়। উপনিবেশের মালিক এবং উপনিবেশসমূহই কেবলমাত্র নয় নির্ভরশীল দেশগুলির, যারা রাজনৈতিকভাবে এবং আনুষ্ঠানিক অর্থে স্বাধীন,কিন্তু কার্যতঃ আর্থিক এবং কূটনৈতিক নির্ভরতার জালে জড়িয়ে রয়েছে, বহু বিচিত্র রূপ এই যুগের বৈশিষ্ট্য। আমরা ইতিমধ্যে নির্ভরতার একটি রূপ উল্লেখ করেছি — আধা-উপনিবেশ। আর একটির উদাহরণ হচ্ছে আর্জেন্টিনা। …রাজনৈতিক স্বাধীনতা সহই আর্থিক ও কূটনৈতিক নির্ভরতার কিছুটা ভিন্নতর রূপের উদাহরণ হচ্ছে পর্তুগাল।'' লেনিন বা স্ট্যালিন কেউই দুটি বর্গের কঠোর, অপরিবর্তনযোগ্য বিভাজন হিসেবে পৃথিবীকে ভাগ করেন নি। সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক এ ধরনের মোটা দাগের বিভাজন মানলেও পুরো দৃশ্যপট জুড়ে অন্তর্বর্তীকালীন নানা রূপের অস্তিত্বের কথাও বলেছেন। এ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করতে হলো এই কারণেই যে আজকের ভারত যে মূলগতভাবে বিপ্লব-পূর্ববর্তী চীনেরই মতই তাকে যেনতেনভাবে প্রতিষ্ঠা করার যে 'মতান্ধ' মনোভাব বিগত সাড়ে চার দশক জুড়ে কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তার হাত থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। এ আচ্ছন্নতা না কাটলে তথ্য থেকে সত্যে পৌঁছনর প্রক্রিয়াতেই ঢোকা সম্ভব নয়।

প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতে পুঁজিবাদের আপেক্ষিক বিকাশ

১৯২৫ সালেই যে ঔপনিবেশিক দেশগুলির মধ্যে কমবেশি বিকশিত পুঁজিবাদের দেশ হিসেবে কেবল ভারতের নামই উল্লেখিত হলো তার কারণ বুঝতে গেলে বিংশ শতাব্দীর বহু আগে থেকেই এর উত্স সন্ধান করতে হবে। নিশ্চয়ই ভারতের অতীত ইতিহাসের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেইসব উপাদান যা অন্যান্য যে কোন উপনিবেশিক দেশের তুলনায় ভারতে পুঁজিবাদী উত্পাদনের উদ্ভব ও বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছিল। অসংখ্য স্ববিরোধী উপাদানের সংমিশ্রণ অত্যন্ত প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় ইতিহাসকে একই সঙ্গে করে তুলেছে জটিল ও বর্ণময়। ভারতের উত্পাদন শক্তির বিকাশের ইতিহাসও এই বৈশিষ্ট্যটি দ্বারা চিহ্নিত। অতীতকাল থেকেই জাতিভেদ প্রথা যেমন সামন্ততন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার এক বিশেষ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে উত্পাদনের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তেমনি এর বিপরীতে উন্নত সেচ ব্যবস্থা আবার ভারতীয় কৃষিপদ্ধতিকে বিকশিতও করেছিল। আর ফলে চালু হয়েছিল পণ্যোত্পাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে আমাদের দেশে কুটির শিল্পের সমৃদ্ধি আজ রূপকথার কাহিনীতে পরিণত হয়েছে। রেশম ও বস্ত্র শিল্প-জাত পণ্য রীতিমতো বিদেশে রপ্তানি হতো। সুরাট, আমেদাবাদ, ঢাকা, কাশিমবাজার ইত্যাদি শিল্প ও বাণিজ্যের বড় বড় কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। তীব্র জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব সত্ত্বেও সমাজে এক ধরনের গতিময়তাও বজায় ছিল। জাতিভেদ প্রথাকে কখনই একটি শিলীভূত বিমূর্ত ''বর্ণাশ্রম'' প্রথায় আটকে রাখা যায়নি। জন্মলাভ করেছিল অসংখ্য ছোট ছোট 'জাত', যার সদস্যরা অভিন্ন পেশা, ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়মকানুন, বিবাহ-ব্যবস্থা ও খাদ্যাভ্যাস দ্বারা একটি নির্দিষ্ট 'জাত' হিসেবে চিহ্নিত হতো। 'নিম্ন জাত'-এর মানুষদের মধ্যে লক্ষ্য করা যেতো 'উচ্চ জাত'-এর রীতিনীতি, আচার ব্যবহার আয়ত্ত করে সমাজে উপরে ওঠার এক চেষ্টা। রাজনৈতিক ব্যবস্থা সাধারণভাবে খুব সুদৃঢ় না থাকার কারণে এবং উদ্বৃত্ত জমির অভাব না থাকার জন্য বিভিন্ন জাতের মানুষদের দেশান্তর যাত্রাও (migration) বেশ প্রচলিত ছিল। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণ স্থবিরত্বের মধ্যে এগুলি এক ধরনের চলিষ্ণুতা সৃষ্টি করতো। সব চেয়ে বড় আলোড়ন তৈরি হতো যখন জাতিভেদ প্রথা সহ অন্যান্য সামাজিক অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষক ও হস্তশিল্পীরা বিদ্রোহে ফেটে পড়তেন। কৃষি-জমির অসাধারণ উর্বরতা, হস্ত ও কুটির শিল্পের অগ্রগতি, পণ্যসামগ্রীর অন্তর্দেশীয় ও বহির্বাণিজ্য— এ সবই সামন্ততন্ত্রের জড়ত্ব ভেঙে উন্মেষশীল পুঁজিবাদের লক্ষণাক্রান্ত ছিল। এরই প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতিতে প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগেই ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্ফুরণ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি দৃষ্টিগোচর হয়।

ভারতের পশ্চিম উপকূলে কয়েক শতাব্দী জুড়ে বহির্বাণিজ্যের বড়-বড় ঘাঁটি ছিল ইংরেজরা ভারতে আসার বহু আগে থেকেই। এ সব কেন্দ্রে ব্যবসা চালাত গুজরাতের জৈন ও হিন্দু বণিকেরা, বোহরা মুসলমান ও কোঙ্কণি সওদাগররা। বহির্বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র সুরাট থেকে মোগল সাম্রাজ্যের শাসনকেন্দ্র দিল্লী-আগ্রা পর্যন্ত বাণিজ্যপথ চলে গেছিল রাজস্থানের মধ্য দিয়ে। সেখানকার মারোয়াড় ও শেখাওয়তি অঞ্চলের বণিকেরা অন্তর্বাণিজ্য ও মহাজনি ব্যবসায়ে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিল এবং ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তরপ্রদেশ, বিহার, বাংলা, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত। মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্য বিস্তার করেছিল পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়। সাবেকী ও ঐতিহ্যশালী জাত ব্যবসায়ী ছিল বাংলার গন্ধবণিক ও সুবর্ণ বণিকরা, মাদ্রাজের চেট্টি সম্প্রদায়, আরও দক্ষিণে তামিল মুসলমান ব্যবসায়ীরা, কেরালায় মোপলা ও খ্রিস্টানরা, কোঙ্কণের ব্রাণেরা। এদের সকলেরই যুগ যুগ ধরে বহির্বাণিজ্যের অভিজ্ঞতা ছিল। এ সময়ে ব্যবসা ছিল অবাধ প্রতিযোগিতামূলক। ফলে সাধারণভাবে ছিল তেজি। আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ পরিস্থিতি বজায় ছিল। এ সময় থেকে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য শুরু হলো। দেশি ব্যবসায়ীবৃন্দ বড় রকম ধাক্কা খেলো। কিন্তু আমরা দেখবো নিজদেশের শক্ত মাটির উপর দাঁড়িয়ে ভারতীয় সওদাগরেরা দেশজুড়ে যে জাল বিস্তার করেছিল তাকে কখনই ইংরেজরা নিশ্চিহ্ন করতে পারে নি। যখন যেখানে সে সুযোগ পেয়েছিল সেখানেই সে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করে। পরবর্তীকালের ভারতীয় পুঁজির গতিপ্রকৃতি বুঝতে হলে সূচনাকালটি আমাদের খেয়ালে রাখতে হবে।

উপনিবেশিক ভারতে বিদেশি পুঁজি ও তার ফলাফল

ভারতে ইংরেজদের শোষণের একেবারে প্রথম পর্বটি ছিল বাণিজ্যিক শোষণের। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত ছিল এর আয়ুষ্কাল। এই পর্বটি পাকাপোক্তভাবে শুরু হওয়ার আগে ভারতের বাজারে বিদেশে রফতানির পণ্য ক্রয়ের জন্য ওলন্দাজ, ফরাসী ও ইংরেজদের মধ্যে ছিল প্রতিযোগিতা। দিশি বণিকরা হস্তশিল্পীদের দাদন দিত বলে অর্থনৈতিক জগতে তাদেরও একটি ভূমিকা ছিল। তাদের পুঁজির জোর এবং রাজনৈতিক প্রতিপত্তিও কম ছিল না। ইংরাজরা প্রথমে ওলন্দাজ ও ফরাসিদের কোণঠাসা করে। তারপর ধীরে ধীরে রপ্তানিযোগ্য পণ্য ক্রয়ের এক শক্তিশালী জাল বিস্তার করে। দিশি বণিকদের এর ফলে হয় অন্তর্বাণিজ্যেই আটকে থাকতে হয়। নয় তো ইংরাজ বণিকের অধীনস্থ হয়ে বহির্বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে হয়। ইংরেজদের বাণিজ্যিক শোষণের এই পর্বের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল প্রত্যক্ষ লুণ্ঠন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য, ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভারতীয় পুরো সারা (finished) উত্পাদন সামগ্রী অস্বাভাবিক কমদামে কিনে রপ্তানি। এই বাণিজ্য ইংরেজরা চালাত উদ্বৃত্ত রাজস্ব ''বিনিয়োগ'' করে। অনেকটা মাছের তেলে মাছ ভাজার মত। এইভাবেই শুরু হয়েছিল ভারত থেকে ''সম্পদ-নির্গমন।'' প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের আগে পর্যন্ত ভারতে রপ্তানির জন্য পণ্য ক্রয় করতে বিদেশি বণিকদের এ দেশে স্বর্ণ বুলিয়ন ঢালতে হতো। ১৭৫৭-র রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর একদিকে তাঁতিদের উপর ইংরেজ এজেন্সীগুলির অত্যাচার বাড়লো। অন্যদিকে কেবলমাত্র বিদেশিরা বা তাদের বশংবদ দেশি বেনেরাই কাপড় কেনার এজেন্সি পেল। মোট কথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হলো আর সাধারণভাবে দেশি বণিকদের ব্যবসা সংকুচিত হলো। ননের দেওয়ানি আর উচ্চ সুদে ইংরেজদের টাকা ধার দেওয়ার মধ্যে তাদের ব্যবসা আটকে গেলো।

১৮১৩ থেকে ইংরেজদের শোষণের ধরন পাল্টে গেল। এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে ইংল্যান্ডের শিল্প-বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি। এই সময় থেকে শুরু হলো তথাকথিত অবাধ-বাণিজ্যভিত্তিক (free trade) শিল্প-পুঁজির শোষণ। ভারত অতিদ্রুত পরিণত হলো ইংল্যান্ডের বস্ত্র শিল্পের বাজারে। এখানকার চিরাচরিত হস্ত শিল্পকে ধ্বংস করা হলো। আর শিল্পের জন্য কাঁচামালের উত্স হিসেবে এ দেশকে ব্যবহার করা শুরু হলো। এই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার শেষ হলো। নতুন ব্যবসায়ী হিসেবে উঠে এল কোম্পানির প্রাক্তন ও বর্তমান ইংরেজ চাকরেরা যারা পুঁজি সৃষ্টি করেছিল কোম্পানির লুঠ করা পয়সায়। এরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়াগিরি ধ্বংস করে কার্যত ইংরাজগোষ্ঠীরই একচেটিয়া ব্যবসা গড়ে তুললো আর তা করা হলো অবাধ বাণিজ্যের নাম করে। এদের হাতে সঞ্চিত অর্থই ভারতে বিদেশী পুঁজির প্রাথমিক উত্স। এই সময় থেকেই আবার ব্যাংক ব্যবসায়েও দিশি বণিকদের আধিপত্য কমতে থাকে। ফলে ভারতীয়রা ব্যাংক থেকে ঋণ পেত না। ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরের টাকার বাজারেও দিশি পুঁজি মার খেতে থাকে। টাকার বাজারে যখনই মন্দা দেখা দিত আর দিশি বণিকরা টাকা ধার দিয়ে উঁচু হারে সুদ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিত তখনই সরকার রাজস্ব থেকে ইংরেজ ব্যবসায়ীদের কম সুদে ধার দিয়ে এ দেশের মহাজনী ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ভারতে ইংরেজদের লগ্নী পুঁজির শোষণ শুরু হয়। ভারতে রপ্তানি হয় খানিক ব্রিটিশ পুঁজি আর তার সাথে এদেশে গড়ে ওঠে ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্ক, আমদানি রফতানির অফিস এবং ম্যানেজিং এজেন্সির এক সুবিস্তীর্ণ শৃঙ্খল। ভারতে বিনিয়োগকৃত ব্রিটিশ পুঁজির পরিমাণ মোটেই খুব বেশি ছিল না। পৃথিবীতে বিনিয়োজিত ইংরাজ পুঁজির মাত্র ১৪% এশিয়াতে এসেছিল। ভারতে নিশ্চয়ই শতাংশের হিসেবে আরো কমে যাবে। কিন্তু ভারতে ব্রিটিশের এই বিনিয়োগ তার পরিমাণের তুলনায় তাত্পর্যে ও গুরুত্বে অনেক বেশি ছিল। ১৮৫৪-১৮৭০ পর্বে ভারতে ১৫ কোটি পাউন্ড স্টারলিং বিনিয়োগ হয়, যার অর্ধেকই ছিল রেল কোম্পানিতে। ১৯০৯-১০ সালের একটি হিসেবে দেখা যায় ৩৯% পুঁজি ঢালা হয়েছে রেল কোম্পানিতে ৫০% সরকারি ও মিউনিসিপ্যাল ঋণ হিসেবে, আর সামান্য যেটা পড়ে থাকে তা বিনিয়োজিত হয়েছে চা, কফি, রাবার বাগিচায়, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোনে, খনিজ ও পেট্রলে আর সওদাগরি কোম্পানি ও ব্যাঙ্কে। বিনিয়োগের ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিকাশের বিশেষত: শিল্পের বিকাশের দিকে কোন লক্ষ্যই এ বিনিয়োগের ছিল না। বরং ধরনটি ছিল রপ্তানি ও বিদেশী চাহিদার মুখাপেক্ষী। কেন আরও বেশি বিদেশী পুঁজি ভারতে এল না, তার উত্তরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন বিষয়ের উপর জোর দেন। ভারতে আরও শিল্পবিকাশ তাদের নিজেদের দেশের শিল্পকে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে সেদিকে সরকারের একটা নজর তো ছিলই, তা ছাড়া একটা বড় কারণ ছিল অত্যন্ত গরীব দেশ ভারতে চাহিদার অভাব। পরিমাণ যতই কম হোক না কেন, বিদেশী পুঁজির আধিপত্য স্থাপন হয়েছিল উপনিবেশিক শাসন ও অর্থনীতির সামগ্রিক কাঠামোটির জোরে। এই কাঠামোটিই সর্বতোভাবে ইংরেজ ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েমে সাহায্য করেছিল— ইংরেজ বণিক সমিতিগুলি, ইংরেজ আমলাবাহিনী, ইংরেজ ম্যানেজিং এজেন্সী ও ব্যাংকের জোরে।

ঔপনিবেশিক আমলে দেশী পুঁজির অবস্থা

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশশক্তির উপস্থিতি যে বহু বিচিত্র উপায়ে দেশীয় পুঁজির বৃদ্ধি ও বিকাশকে রুদ্ধ করার জন্য তত্পর থাকবে তা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। এমন কি কার্ল মার্কস যে রেলপথকে ''ভারতীয় শিল্পের অগ্রদূত'' বলে বর্ণনা করেছিলেন দেখা গেল তাও ব্যবহার হলো শুধু বহির্বাণিজ্যের পক্ষে প্রয়োজনীয় বন্দরগুলির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য। আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও শিল্প বিকাশের দিকে কোন নজরই ছিল না। ভাড়ার বিন্যাসও এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে বন্দর-অভিমুখী কাঁচামালের আর বন্দর থেকে অন্তর্দেশ-অভিমুখী শিল্পদ্রব্যের ভাড়া অত্যন্ত কম থাকে, আর উল্টোদিকের ভাড়া অনেক বেশি থাকে। পরে অবশ্য মার্কসই বলেছিলেন ব্রিটিশ ভারতে রেলপথ স্থাপনা ভারতীয়দের কাছে অর্থহীন। বৈষম্যমূলক শুল্ক, অবাধ বাণিজ্যের (laissez faire) মুখোশের আড়ালে শুধু ইংরেজদের উদ্যোগগুলিকে সহায়তা দেওয়া, অর্থকরী ফসল চাষের জন্য কেবলমাত্র ইংরেজদেরই জমি দেওয়া, ভারতীয় অর্থনীতিকে শুধুমাত্র রপ্তানির প্রয়োজনের সঙ্গে জুড়ে রাখা, সর্বোপরি সমস্ত অর্থনীতিকেই সাধারণভাবে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার এক ক্রমান্বয় প্রচেষ্টা ভারতে ইংরেজ ঔপনিবেশিক পলিসির কয়েকটি মূল স্তম্ভ।

কিন্তু এতসব সত্ত্বেও এ সমগ্র পর্ব জুড়ে দেশি পুঁজি একেবারে লপ্ত হয়ে গিয়েছিল এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। অবশ্যই তার নিজস্ব একটা ধরন ছিল এবং অবশ্যই ছিল ইংরেজ আধিপত্যের অধীনস্থ। দেশী পুঁজি ছিল বেশ কিছু ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে, মহাজনী কারবারে, বিলিতি পণ্যের এ দেশে বিক্রেতা হিসেবে, এ দেশের রপ্তানিযোগ্য কাঁচামালের খুচরো বা পাইকারি কারবারী হিসেবে। আর আধিপত্যকারী ইংরেজ পুঁজি খাটতো জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে, ম্যানেজিং এজেন্সিতে, আমদানি-রপ্তানির বৈদেশিক বাণিজ্যে, ব্যাঙ্ক-বীমা-জাহাজ কোম্পানিতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই চিত্র কিন্তু কখনই স্থায়ী রূপ পায় নি। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে দিশি ব্যবসায়ীদের যে জোরের কথা আমরা বর্ণনা করেছি ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ পুঁজির পূর্ণ আধিপত্যের সময়ও কিন্তু তা নিঃশেষ হয়ে যায় নি। প্রথম থেকেই সে তার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে গেছে। এ লড়াই চালাতে চালাতে যখনই কোন অনুকূল পরিস্থিতি সে পেয়েছে তখনই চেষ্টা করেছে ইংরেজ পুঁজির সঙ্গে টক্কর দিতে। প্রথম ও দ্বিতীয় এই দুই বিশ্বযুদ্ধের পরে পরেই দেশি পুঁজি বিভিন্ন মাত্রায় তার শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত পূর্বে উল্লেখিত দেশি পুঁজির মূল ভূমিকা ছিল মহাজনি বা বাণিজ্যিক। পরবর্তীকালে এই পুঁজি কীভাবে ধীরে ধীরে উত্পাদনের জন্য বিনিয়োগ হতে শুরু করলো তা এক চিত্তাকর্ষক গবেষণার বিষয় হয়ে রয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে এই প্রক্রিয়াটির লীলাভূমি পূর্বভারত না হয়ে কেন পশ্চিম ভারত হলো সেটিও একটি মনোগ্রাহী আলোচনার বিষয়। দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে দু এক কথা এখনই বলে নেওয়া যায়। বাংলায় কেন দেশি পুঁজি শিল্পে যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োজিত হল না, তা নিয়ে প্রচুর পরস্পর বিরোধী তত্ত্ব আছে। বাঙালী ভদ্রবাবুদের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে যারা দায়ী করেন তারা ব্যাখ্যা করতে পারেন না কেন ব্রাহ্মসমাজভুক্ত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশিষ্ট বাঙালীরাও এ ব্যাপারে ব্যর্থ হলো। যাঁরা বলেন বাঙালী ধনীরা জমিদারি কিনতে বেশি প্রলুব্ধ হয়েছিল তাঁদের তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে অনেক ঐতিহাসিক দেখিয়েছেন আসলে শিল্প-উদ্যোগে ব্যর্থ হয়েই তারা জমিদারি কিনতে বাধ্য হয়েছিল। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা সম্ভবত এই যে পশ্চিম ভারতের তুলনায় এখানে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের নাগপাশ অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারতীয় পুঁজি দুভাবেই খাটতে শুরু করেছিল। একদিকে বিস্তারলাভ করেছিল মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে বাণিজ্যিক পুঁজি, যার পরিসর ছিল উত্তর, পূর্ব ও মধ্য ভারত এবং দক্ষিণভারতের চেট্টিয়ার ব্যবসায়ীরা যাদের বাণিজ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এই দুই গোষ্ঠীর ব্যবসায়ীরাই অন্ততঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ছিল সম্পূর্ণ ইংরেজ নির্ভর এবং ইংরেজদের বেনে হিসেবেই ছিল একমাত্র ভূমিকা। অন্যদিকে ঐ একই সময়ে পশ্চিম ভারতে, প্রথমে বোম্বাই ও কিছু পরে আমেদাবাদে দেশি পুঁজি শিল্প-উত্পাদনে নিয়োজিত হতে শুরু করলো। দুই জায়গাতেই এই শিল্প ছিল মূলতঃ বস্ত্র শিল্প।

বোম্বাই-এর বস্ত্র শিল্পের প্রাথমিক পুঁজি সৃষ্টি হয় রপ্তানি বাণিজ্য থেকে। মালওয়া অঞ্চলে প্রচুর আফিং উত্পাদন হতো যা সরাসরি চীনে রপ্তানি করা হতো। আর ছিল তুলা রপ্তানি। ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে সুতি কাপড়ই ছিল প্রধান উত্পাদন সামগ্রী। ফলে সেখানে তুলোর চাহিদা ছিল বিপুল। সেই চাহিদা মেটানোর উর্বর ক্ষেত্র ছিল দাক্ষিণাত্যের কৃষ্ণমৃত্তিকা। অন্যদিকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের কারণে সেখান থেকে তুলোর রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায় ঠিক এরকম একটি সময়েই। ফলে ম্যাঞ্চেস্টারে তুলোর বিপুল চাহিদা মেটাবার সুযোগ এল বোম্বাই-এর ব্যবসায়ীদের হাতে। ইতিমধ্যে রেললাইন স্থাপন হয়ে যাওয়ায় বোম্বাই বন্দরে মাল পরিবহনের সুযোগ এসে গেছে। সর্বোপরি ইংরেজ শাসনের বনিয়াদ পশ্চিমভারতে অতটা দৃঢ় না থাকায় পূর্ব ভারতে যেভাবে সম্পদ নির্গমন হয়েছে মহারাষ্ট্রে তেমন হয়নি। ফলে ব্যবসাবাণিজ্যের পরিকাঠামো অনেক ভাল ছিল। ব্যবসা ও শিল্পের পক্ষে বোম্বাইতে বিরাজমান এই সুযোগ সুবিধাগুলি ওখানকার সবচেয়ে উদ্যোগী জনগোষ্ঠী পার্সিরা আঁকড়ে ধরলো। পুরনো ধাঁচের ব্যবসায়ীদের মত নানা সামাজিক বাধানিষেধ তাদের ছিল না। সমাজে বিধর্মী বলে পরিচিত হবার ফলে নতুন যে কোন পথে যাত্রা করা তাদের পক্ষে সুবিধাজনক ছিল। ঊনবিংশ শতকের প্রথমভাগে তাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগের সাফল্য ও অভিজ্ঞতা নিয়েই তারা শিল্পের জগতে পা রাখলো। ১৮৫০-এর দশকে নতুন শিল্পের প্রতিষ্ঠা দিয়ে শুরু হয় তাদের উদ্যোগ।

পার্সি শিল্পোদ্যোগের বড় প্রতিভূ অবশ্যই টাটারা। তুলা রপ্তানির ব্যবসা যখন আমেরিকার গৃহযুদ্ধের অবসানে মন্দার ধাক্কা খেলো তখন তারা ইথিওপিয়ার যুদ্ধে কনট্র্যাক্টরি করে পুঁজি সঞ্চয় করে প্রথমে সুতি কারখানা (১৮৭০), পরে বস্ত্র কারখানা (১৮৭৭) স্থাপন করে। ব্রিটিশরা যেহেতু ম্যাঞ্চেস্টারের সঙ্গে ভারতের ভূমি থেকে প্রতিযোগিতা করবে না তাই বস্ত্র শিল্পে কোন বিদেশী বিনিয়োগ তারা করে নি। এর ফলে বোম্বাই-এর সুতো শিল্প ও বস্ত্র শিল্প দ্রুত বেড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমাদের গুরুতর মনোযোগ দাবী করে তা হলো বোম্বাই-এর এই শিল্পবিকাশ মোটেই ম্যাঞ্চেস্টারের সঙ্গে তথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে চরম সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে নি। ম্যানেজিং এজেন্সি ব্যবস্থা ছিল ব্যাঙ্ক, বাণিজ্য ও শিল্পের এক পরস্পরের সঙ্গে সংপৃক্ত ব্যবস্থা। তাই ব্রিটিশ প্রভাবিত এই ব্যবস্থায় থাকার অর্থই হলো ব্রিটিশ পুঁজির সঙ্গে অসংখ্য বন্ধনে জড়িয়ে থাকা। তা ছাড়া বড় কথা হলো কারিগরি ও যন্ত্রপাতির জন্য তো ইয়োরোপের উপর নির্ভর করতেই হতো। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে সাম্রাজ্যবাদী বন্ধন যতই থাক এই পুঁজির মালিকানা ভারতীয় এবং এই মালিকানার অন্তর্লীন প্রবণতা থাকবে সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকা যাতে ঐ বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসা যায়। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এসে ম্যাঞ্চেস্টারের সঙ্গে ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের মুখোমুখি প্রতিযোগিতা।

আমেদাবাদের বস্ত্র শিল্পের বিকাশ বোম্বাই-এর কিছু পরে ঘটে। বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে প্লেগের মহামারীতে বোম্বাই শহর ফাঁকা হতে শুরু করে। ঐ সময়ে চীনেও যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে প্রাচ্যে সুতো রপ্তানির ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর দরুন জোর পড়ে বস্ত্র শিল্পের উপর। এই সময়ই আমেদাবাদের বস্ত্র শিল্পের উত্থান। বোম্বাই-এ পার্সিদের শিল্পোদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে গুজরাতি বেনেরা প্রথমে সুতি কারখানা ও পরে বস্ত্র কারখানায় পুঁজি বিনিয়োগ করে। ভারতের বাজারে বস্ত্র সরবরাহের উপর এদের জোর ছিল এবং তুলনায় উচ্চমানের সুতো ব্যবহার করতো। এর দরুন ল্যাঙ্কাশায়ারের সঙ্গে তাকে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আমলে ব্রিটেনের নিজস্ব রণনীতিগত কারণে তার শিল্প সংক্রান্ত পলিসির কিছু গুরুতর পরিবর্তন হয়। ভারত সরকার তার নিজস্ব আর্থিক প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক বাড়ায়, কিন্তু বস্ত্র শিল্পের এক্সসাইজ অপরিবর্তিত রাখে। এর ফলে ল্যাঙ্কাশায়ার ভারতীয় উত্পাদনের কাছে মার খেতে শুরু করে। এই সময় বোম্বাই এবং আমেদাবাদের বস্ত্র শিল্পে এক বিশাল অগ্রগতির সূচনা হয়। ১৯১৩-১৪ সালে ব্রিটেন থেকে আমদানি করা সূতি বস্ত্র ছিল ৩১০৪ মিলিয়ন গজ, আর ভারতীয় মিলের উত্পাদন ছিল ১১৭১.১ মিলিয়ন গজ। সেখানে ১৯২২-২৩ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৪৫৩ মিলিয়ন গজ ও ১৭২০ মিলিয়ন গজ। অর্থাৎ ল্যাঙ্কাশায়ারের আমদানি থেকে ভারতীয় মিলের উত্পাদন নির্ধারকভাবে ছাপিয়ে গেল। পরবর্তীকালেও এ প্রবণতা অপরিবর্তিত থেকে গেল।

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে পূর্বভারতে শিল্পের বিকাশের অসুবিধার কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। বিড়লাদের হাত ধরেই এই পরিবর্তন সূচিত হয়। আগ্রা-দিল্লী-রাজস্থানের ব্যবসা যখন গুটিয়ে গেল তখন মারওয়াড়ি সম্প্রদায়ের বেনেরা দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে এরা রপ্তানি ব্যবসায়ের দেশীয় পাইকার হিসেবে প্রচুর পয়সা করে। এই গোষ্ঠীর মুখ্য প্রতিনিধি বিড়লা। ১৮৫৭ সালে বর্তমান বিড়লা গোষ্ঠীর আদি পুরুষ শিবনারায়ণ বিড়লা আমেদাবাদ থেকে বোম্বাই পৌঁছায়। আফিং ও তুলোর ব্যবসা করে যখন ফলে ফেঁপে উঠছিল তখনই বোম্বাই-এ প্লেগ শুরু হয় এবং প্লেগের ভয়ে কলকাতায় পালিয়ে এসে আফিং আর পাটের ব্যবসা শুরু করে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় পাটের চাহিদা তেজি হয়ে ওঠায় তার পত্র ও পৌত্র তাদের পুঁজি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে সমর্থ হয়। এই পৌত্রটির নাম জি ডি বিড়লা যে তার পয়সার জোরে ইংরেজ কোম্পানি থেকে একের পর এক শিল্প কারখানা কিনতে থাকে। কেশোরাম কটন, মর্টন চিনি কারখানা তার উদাহরণ। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিড়লা ব্রাদার্স লিমিটেড কোম্পানি। তারপর বিড়লা জট কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে। এইভাবে দালালি ও কাঁচামালের যোগানদার থেকে পাক্কা শিল্পপতি। এখানেই তারা থেমে থাকে নি। বিশ্বমন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলিতে তাদের শিল্প সাম্রাজ্য ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কাগজ কল ও বীমা কোম্পানি এই সময়ই তাদের ব্যবসায়ে সংযোজন। একই সময়ে জি ডি বিড়লার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারত চেম্বার অফ কমার্স এবং FICCI। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ইংরাজরাই প্রথম বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স প্রতিষ্ঠিত করেছিল নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ এগিয়ে নিয়ে যেতে। এরই বিপরীতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা গড়ে তোলে বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স (১৮৮৭)। পরপর তৈরি হলো বোম্বাইতে ইন্ডিয়ান মার্চেন্টস চেম্বার (১৯০৭), মাদ্রাজে সাদার্ন ইন্ডিয়া চেম্বার অফ কমার্স (১৯০৯)। এছাড়াও ছিল বিভিন্ন সম্প্রদায়ভিত্তিক (যেমন মাড়ওয়ারি, মুসলিম ইত্যাদি) অসংখ্য চেম্বার অফ কমার্স। নিজেদের গোষ্ঠীর ব্যবসা এগিয়ে নিতেই এর প্রবর্তন হয় যেমন বোম্বাইতে বাজারের চাইতে কম সুদে মাড়োয়ারিরা নিজেদের মধ্যে ঋণ দেওয়া নেওয়া করতো। ১৮৫৭ সাল থেকে শুরু হয়েছিল জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। ইংরাজরা এ ক্ষেত্রেও পথ প্রদর্শক হলেও পরে ভারতীয়রা বিপুল পরিমাণে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি সৃষ্টি করে। একটি হিসেব অনুসারে ১৯৩০ সালে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিগুলিতে ভারতীয় পুঁজি ৫৩ শতাংশের বেশি ছিল।

কিন্তু একই সাথে যেটা লক্ষণীয় বিষয় তা হলো ইংরেজদের সঙ্গে দরকষাকষির নানা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি ভারতীয় শিল্পপতিরা, বিশেষত তাদের মধ্যে যারা বড়, নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থেই আবার ইংরেজদের প্রতি অনুগতও ছিল। বড় পুঁজিপতিরা শ্রমিক অসন্তোষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকারি সহায়তা চাইতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বস্ত্র শিল্পের মালিকরা ও তুলার রপ্তানিকারকরা তুলার দাম কমাবার স্বার্থে সরকারের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ককে কাজে লাগাতে চাইত। ছোট বা মাঝারি শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আবার জাতীয় চেতনা অনেক বেশি ছিল। যেমন তুলোর যে ব্যাপারীরা কাঁচা তুলো বোম্বাই নিয়ে আসত তাদের মধ্যে ইংরেজ বিরোধিতা তীব্র ছিল। আবার ১৯২০-২১-এর উত্তাল অসহযোগ আন্দোলনের সময়েই তুলোর বৃহৎ রপ্তানিকারক পুরুষোত্তম দাস ঐ আন্দোলনের বিরোধিতা করার জন্য পাল্টা সংগঠন পর্যন্ত গড়ে ফেলেছিল। ভারতীয় উদ্যোগপতিদের মধ্যে টাটারা ছিল বিশেষভাবে ইংরেজ অনুগত, কারণ ইস্পাতের মত শিল্পের বাজার ভীষণভাবে নির্ভর করে সরকারি আনুকূল্যের উপর। ইংরাজ আনুগত্য যে মাত্রারই থাকুক না কেন, মোট কথা হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব ও পশ্চিম উভয় ভারতেই বৃহৎ দেশি পুঁজিপতিদের শিল্প খুব বড় মাত্রায় সম্প্রসারিত করে। এর যে নানা কারণ ছিল তার মধ্যে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যুদ্ধের কারণে চাহিদা বৃদ্ধি, বিদেশী পুঁজির সঙ্গে প্রতিযোগিতা হ্রাস, কাঁচা পণ্যের মূল্য হ্রাস এবং প্রকৃত মজুরির হ্রাস। ঐতিহাসিকরা এই সময়টিকেই ভারতীয় পুঁজিপতিদের প্রথম বিশাল অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই তাই একদিকে ভারতীয় পুঁজিপতিদের বিকাশ, বৃদ্ধি ও সঙ্ঘবদ্ধতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে অন্যদিকে পায়ের নিচে খানিক মাটির সন্ধান পেয়ে তারা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে দর কষাকষি শুরু করে। একই সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে ইংরেজ পুঁজির শক্তিক্ষয় তাদের অবস্থানকে আরও সুবিধাজনক করে তোলে। ১৯২৭ সালের লিবারাল ইনকয়্যারি কমিশনের রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে ইংরেজ পুঁজির বিনিয়োগের হার কমে যাচ্ছিল এবং পুঁজি রপ্তানির ক্ষমতাও যথেষ্ট হ্রাস পেয়ে গেছিল। ১৯৩০-এর দশক জুড়ে ইংরেজ পুঁজির এই অধোগমন অব্যাহত ছিল, কারণ এই দশকেই এশিয়ার বাজারে জাপান, বলকান ও স্ক্যান্ডেনিভিয়ার বাজারে জার্মান এবং ল্যাটিন আমেরিকার বাজারে মার্কিন পুঁজিপতিরা তাদের আধিপত্য কায়েম করে। এর অর্থ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই ব্রিটেন বিশ্ববাজারে তার প্রাধান্য হারিয়ে ফেলে। এ রকম একটি সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে, ১৯১৮ সালে ভারতীয় শিল্প কমিশনের রিপোর্টে যখন ভারতে বিপুল শিল্প সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে, তখনই কমিশনের সদস্য ভারতীয় পুঁজিপতিরা শুল্ক ও বৈদেশিক বিনিময়ের উপর নিয়ন্ত্রণের দাবি তোলে। ১৯১৯-২১ এর জাতীয়তাবাদী লড়াই-এ ভারতীয় পুঁজিপতিদের একাংশের অংশগ্রহণের লক্ষ্য ছিল এই দাবী আদায়ের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২২-এর ফিস্কাল কমিটির রিপোর্টে দেশীয় উত্পাদনকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে কিছুটা সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯২৪-এ শুল্ক বোর্ড গঠন, তারও পরে টাকার সঙ্গে পাউন্ডের বিনিময় হার পরিবর্তন ইত্যাদি সূচনা করে যে ইংরেজরা দেশি পুঁজিপতিদের শক্তিকে কিছুটা মান্যতা দিতে বাধ্য হয়েছিল।

১৯৩০-এর দশক থেকেই ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিরা ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য সরকারের তরফে ''পরিকল্পিত বিকাশ''-এর পন্থা গ্রহণের জন্য আবেদন করেছিল। ১৯৩৪-এ ''ফিকি''র এক সাধারণ সভায় জি ডি বিড়লা এই দৃষ্টিভঙ্গীই প্রতিফলিত করে। ১৯৩৮ সালে ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি 'ভারতের জাতীয় কংগ্রেস' পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে চেয়ারম্যান করে 'জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি' গড়ে তোলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতের 'স্বাধীনতা'

১৯২৯-এর বিশ্বব্যাপী মন্দা ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ভারতের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ সব পরিবর্তন সূচনা করলো যা ভারতীয় পুঁজিপতিদের অবস্থানকে আরও খানিকটা সংহত করার সুযোগ এনে দিল। ভারত-ব্রিটেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভীষণভাবে পরিবর্তিত হলো। ১৯৪৪-৪৫-এর মধ্যেই ব্রিটেনকে সরিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতে বৃহত্তম আমদানিকারক হয়ে উঠলো। যুদ্ধের প্রয়োজনে ইংল্যান্ডকে ভারত থেকে এত বেশি যুদ্ধ সামগ্রী কিনতে হয়েছিল যে ভারতের স্টারলিং ঋণ শুধু শোধ হয়ে গেল না, ১৯৪৫ এর মধ্যে ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের স্টারলিং ব্যালান্স ভারতের ঘরে জমা হলো। এই বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার স্বাধীনতার পরও ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যে দারুণ সহায়ক হয়েছিল। যে বৈদেশিক ঋণ শোধ চিরাচরিতভাবেই ভারত থেকে ধন নির্গমনের এক প্রধান উত্স ছিল, তাও বন্ধ হলো। দ্বিতীয়তঃ যুদ্ধের চাহিদা মেটাতে গিয়ে বস্ত্র, লোহা ও ইস্পাত, সিমেন্ট, কাগজ এবং কিছুটা পরিমাণে ইঞ্জিনিয়ারিং ও রাসায়নিক শিল্পের বৃদ্ধি ঘটলো। যুদ্ধের বাজারে উত্পাদনের পরিমাণের তুলনায় লাভের পরিমাণ বেড়ে গেল বহুগুণ। এর উত্স ছিল ফাটকা কারবারের লাভ, শেয়ার বাজার, খাদ্যদ্রব্য এবং কালো বাজার। হাতে প্রচুর অর্থ অথচ কারিগরি দক্ষতার ভয়ানক অভাব এদেরকে বৈদেশিক সহযোগিতা-ভিত্তিক পুঁজি-বিনিয়োগের দিকে ঠেলে দিল। কিন্তু সামগ্রিক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আনুকূল্যে বিদেশি পুঁজির সঙ্গে লেনদেন এখন আর মারাত্মক অসম শর্তে নয়। ইতিমধ্যে ভারতে একটি ডলার তহবিল তৈরি হয়ে গেছে। ভারতীয় পুঁজিপতিদের সঙ্গে মার্কিন পুঁজিপতিদের নতুন বন্ধনও তৈরি হয়ে গেছে। এয়ারক্রাফট ও অটোমোবাইল পার্টস উত্পাদনে মার্কিন পুঁজিপতিরা ভারতে কারখানা স্থাপন করে। ভারতে নতুন শিল্পস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিনারিও পুরনো প্রযুক্তিতে গড়া ব্রিটিশ পণ্যের স্থানে মার্কিন পণ্য দিয়ে প্রতিস্থাপিত হলো।

১৯৪৪ সাল নাগাদই ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিরা তাদের সুসংহত ও নিজস্ব উদ্যোগ প্রকাশ করে। তাদের বোঝাপড়ায় এটা ঐ সময়ই স্পষ্ট হয় যে ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পশ্চাদপসরণ আসন্ন হয়ে উঠছে এবং তারাই হয়ে উঠবে ভারতীয় সমাজে নেতৃত্বদায়ী শ্রেণী। নেতৃত্বের সেই ভূমিকা পালনের জন্য তারা আগাম ''অর্থনৈতিক বিকাশের একটি পরিকল্পনা'' প্রকাশ করে। এটিই ''বম্বে প্ল্যান'' হিসেবে পরিচিত হয়। ভারতের ৭ জন প্রধান পুঁজিপতি জে আর ডি টাটা, জি ডি বিড়লা, এ দালাল, শ্রীরাম কস্তুরভাই লালভাই, এ ডি শ্রফ এবং জন মাথাই ছিল এ দলিলের রচয়িতা। এই দলিলে ভারতের ভাবী শাসকশ্রেণীর মূল প্রতিভূ পুঁজিপতি শ্রেণী তার আগামী দিনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রকাশ করে। তাতে একদিকে যেমন ছিল সামাজিক সুরক্ষা ও জন সাধারণের জীবন যাপনের মানোন্নয়ন করা, অন্যদিকে শিল্পে দ্রুত অগ্রগতির পাশাপাশি কৃষিতে এক ধীরগতি বিকাশের পরিকল্পনা। মাথাপিছু আয় ১৫ বছরে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য ধার্য করা হয়। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি থেকে আধুনিক ও উন্নত যন্ত্রপাতি এবং পুঁজি যোগানের কথা বলা হয়। জাতীয় সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে অস্পষ্টতা থাকলেও, তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় মৌলিক শিল্প গড়ার কথা বলা হয়, বিশেষত যে ক্ষেত্রগুলিতে বিকাশের ঐ পর্যায়ে বেসরকারি পুঁজির যোগান সম্ভব নয়। আশ্চর্যজনকভাবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রসঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার উদাহরণ এসেছে এবং তা এসেছে সপ্রসংশভাবে। উল্লেখ্য যে ১৯৪৭ পরবর্তী পর্যায়ে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী সরকারিভাবে এই পরিকল্পনা গ্রহণ না করলেও ১৯৫০-এর ১ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল বম্বে প্ল্যানের ছাঁচে তৈরি।

১৫ বছরের জন্য প্রস্তাবিত এই পরিকল্পনার মোট ৭৫০০ মিলিয়ন পাউন্ড সরকারি বিনিয়োগের কথা বলা হয়। তার মধ্যে শিল্পে ৩৩৬০, কৃষিতে ৯৩০, কমিউনিকেশনে ৭০৫, শিক্ষায় ৩৩৭.৫, স্বাস্থ্যে ৩৩৭.৫, বাসস্থান নির্মাণে ১৬৫০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করার কথা বলা হয়। এই বিনিয়োগের উৎসগুলির মধ্যে ছিল আভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ৩০০০ এবং সৃষ্টি করা অর্থ ২৫০০ মিলিয়ন পাউন্ড। যুদ্ধোত্তর পর্বের দামের ভিত্তিতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫০০০ মিলিয়ন পাউন্ড। ১৫ বছরের জন্য করা এই পরিকল্পনায় কৃষিতে ১৩৫ শতাংশ এবং শিল্পে ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল। প্রায় একই সময়ে, অর্থাৎ ১৯৪৫ সালে ভারত সরকারের যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন কমিটি তার দ্বিতীয় রিপোর্ট পেশ করে এবং সেখানেও ১৫ বছরেরই এক পরিকল্পনা হাজির করা হয়। ''বম্বে পরিকল্পনা''র সঙ্গে তার বিস্ময়কর মিল লক্ষ্য করা যায়। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি নতুন ও জরুরী বৃহদায়তন শিল্পে বিনিয়োগ ছিল এই শিল্পনীতির মূল কথা। ঐ একই বছরে ভারত সরকারের পরিকল্পনা ও বিকাশ বিভাগ শিল্পনীতি বিষয়ক রিপোর্টে ২০টি শিল্পকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার কথা বলে। এমনকি এগুলিকে জাতীয়করণ করার কথাও বলা হয়। এই শিল্পগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল রেল, লৌহ ও ইস্পাত, বিমান, বস্ত্র নির্মাণ, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি প্রভৃতি। বম্বে পরিকল্পনার সাথে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারত সরকারের পরিকল্পনার সাদৃশ্য দুই বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর সম্মিলিত উদ্যোগ এবং ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়ার আন্তর্জাতিক পুঁজির উপর নির্ভরতাকেই তুলে ধরে।

এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে ভারতীয় পুঁজিপতিদের এই আত্মবিশ্বাস এবং তার উপর দাঁড়িয়ে এই আত্মঘোষণার পশ্চাত্পটে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের বিপুল ক্ষতি এবং পুঁজিবাদী শক্তিগুলির ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস। যুদ্ধের বিপুল খরচ বহন করতে গিয়ে একদিকে সে ভারতের কাছে ঋণী হলো। অন্যদিকে যুদ্ধ চালানো থেকে শুরু করে নিজের দেশের পুনর্গঠনের জন্য তাকে হাত পাততে হলো মার্কিনীদের কাছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে কায়েম হলো ডলারের আধিপত্য। আবার মার্কিনীদের স্টারলিং-এর সঙ্গে একটা সমঝোতা করেও চলতে হলো, কারণ ইতিমধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে তার শুরু হয়েছে ঠাণ্ডা লড়াই। ঠিক এরকম একটা অবস্থায় ভারতের শিল্প প্রসার এবং এর সিংহভাগই হলো দেশি পুঁজির হাত ধরে। ব্রিটিশ-নির্ভরতার পাশাপাশি মার্কিন নির্ভরতা এবং তার পাশাপাশি নিজের শক্তিবৃদ্ধি সম্পর্কে সচেতনতা। ব্রিটিশরাও বুঝতে শুরু করলো এমন একটি শক্তি ভারতের বুকে সৃষ্টি হয়েছে যারা ব্রিটিশের অর্থনৈতিক স্বার্থকে বড় ধরনের আঘাত না দিয়ে ব্রিটিশের রাজদণ্ড হাতে নেবার যোগ্যতা অর্জন করেছে। ব্রিটিশদের প্রতি বরাবর অনুগত অপর শ্রেণীটি অর্থাৎ সামন্ত জমিদার শ্রেণীও ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের নির্ভরযোগ্য সহযোগী হিসেবে থেকে গিয়েছে। ইতিমধ্যে তারাও প্রস্তুত হয়ে গেছে বৃহৎ পুঁজিপতিদের নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে আগামী ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হতে। ভারতে পুঁজিবাদের বিকাশ বুঝতে গেলে ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতি এবং সেখানকার শ্রেণী বিন্যাস নিয়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা প্রয়োজন।

ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের কৃষি-অর্থনীতি

১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলার রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব পায়। তখন থেকে ইজারাদার আর রেভেন্যু সুপারভাইজারের অত্যাচারে চাষীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অনাবৃষ্টি আর বছর বছর মন্বন্তর যার মধ্যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সকলেরই জানা। ঐ বছরও রাজস্ব ঠিক ঠিক জমা পড়েছিল। এর পর রাজস্ব আদায়ের নানা পদ্ধতি পেরিয়ে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের তত্ত্বাবধানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন জমিদারদের দিয়ে রাজস্ব আদায়ের নিশ্চয়তা খুঁজে পেল। রাজস্বর পরিমাণ অপরিবর্তনীয় বলে ''চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত'' নাম হলো। এই ব্যবস্থায় জমি জমিদারদের ব্যক্তিগত মালিকানায় চলে এলো। ফলে ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে জমিদারদের সম্পর্ক গাঢ় হলো। কিন্তু কয়েক বছর পরই এই ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা শাসকদের নজরে এল। সরকারের লাভ বাড়ছে না, যেহেতু রাজস্ব একই থাকছে, কিন্তু চাষীর কাছ থেকে নিংড়ে নিতে শুরু করলো জমিদার ও তার নীচের অসংখ্য দালাল। কোম্পানি তাই রাজস্ব আদায়ের অন্য ব্যবস্থার কথা ভাবতে লাগলো। সরাসরি রায়তের সঙ্গে রাজস্ব-আদায়ের চুক্তি করলে মধ্যবর্তী শ্রেণী আর রাজস্বের অংশ শোষণ করতে পারবে না। আর চুক্তি চিরস্থায়ী না করে ২০ বা ৩০ বছর ব্যবধানে বাড়াতে পারলে কৃষির বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাজস্বও বাড়ানো যাবে। এই ভাবনা থেকে রায়তওয়ারি ব্যবস্থার প্রচলন মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে। কিন্তু এই অবস্থায় ''গ্রাম ব্যবস্থার'' কোন গুরুত্ব থাকলো না। ফলে রায়ত আর সরকারের মধ্যে ঢুকে পড়লো সরকারের এজেন্ট হিসেবে লোভী ও বিবেকহীন কর্মচারীরা। গ্রাম-ব্যবস্থা যে সব জায়গায় বিদ্যমান ছিল যেমন পাঞ্জাব, অযোধ্যা, গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী এলাকা সেখানে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা হিসেবে ''মহালওয়ারি'' চালু হলো। রাজস্ব প্রশাসনের কাজগুলি ''মহাল'' বা গ্রামই করতো, আর যেখানে কোনও ভূস্বামী মহালের অধিকর্তা সেখানে তার সঙ্গেই চুক্তি হতো। রায়তওয়ারির মতই রাজস্ব নির্ধারণের বন্দোবস্ত অস্থায়ী ছিল। মোট চাষযোগ্য জমির ১৯ শতাংশ ছিল জমিদারি বন্দোবস্ত, ২৯ শতাংশ মহালওয়ারি বন্দোবস্ত আর ৫২ শতাংশ ছিল রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত।

ঊনবিংশ শতক থেকে রাজস্ব দেবার জন্য কৃষকের উপর যে লন চলতো তার সঙ্গে যুক্ত হলো কৃষি-পণ্যের বাজারের লন। ভারতবর্ষে এ বাজারের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। মধ্যযুগ থেকে চলমান কৃষিপণ্যের এ বাজার কোম্পানির আমলে কুটির শিল্পজাত সামগ্রী এবং নীল ইত্যাদি কৃষিপণ্যের বিদেশে রপ্তানি শুরু হবার দরুন অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষিপণ্যের বাজারে এক উল্লম্ফন ঘটলো ইংল্যান্ডের শিল্পের জন্য কাঁচামালের চাহিদা বাড়ায় এবং দেশের অভ্যন্তরে রেল সহ পরিবহনের উন্নতির ফলে। ১৮৬৯-এ সুয়েজ খাল খোলার পর রপ্তানি অনেক বেড়ে গেল। অনেক নতুন কৃষি পণ্য এমন কি চাল ও গমের রপ্তানিও বেড়ে গেল। চাল ছাড়া অন্যান্য দ্রব্য রপ্তানি হতো বিনা শুল্কে। এর ফলেও কৃষিপণ্যের বহির্বাণিজ্য বেগবান হলো। এইভাবে ভারতের কৃষিপণ্য বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে ভালভাবে জড়িয়ে পড়লো। অর্থকরী ফসলের (cash crop) উত্পাদন বৃদ্ধি আবার দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যশস্যের বাজারকেও সম্প্রসারিত করলো। কারণ যেখানে যে ফসল ভাল হয় সেখানে সেই ফসলেরই চাষ হতো। সেখানকার কৃষকদের খাদ্যশস্য বাজার থেকেই কিনতে হতো। বিংশ শতকের গোড়ায় এই প্রবণতা আরও বেড়ে গিয়েছিল। একটি সরকারি হিসেবে দেখা যায় ১৯০১ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে যেখানে খাদ্যশস্যের চাষের এলাকা বেড়েছে ১৬ শতাংশ সেখানে আখচাষের ৬৯, তুলো চাষের ৫৯, তৈলবীজের ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। কৃষি-পণ্যের উত্পাদন ও বাজার বাড়ার সাথে সাথে কৃষকের দুর্দশা হু হু করে বাড়তে শুরু করলো। কারণ এই ধরনের চাষে বিনিয়োগ অনেক বাড়াতে হতো যা কৃষককে ধার করতে হতো মহাজনের কাছ থেকে। পণ্য বাজারজাত করতেও নির্ভর করতে হত মধ্যবর্তী একাধিক মহাজন বা ব্যবসায়ীর কাছে। প্রতি পদক্ষেপে তারা চাষিকে ঠকাতো। আর একটি বড় সমস্যা হলো অর্থকরী পণ্যের চাষের এলাকায় চাষীদের খাদ্যের জন্য মহাজনের কাছে ঋণ নিতেই হতো, আর ফসল মার খেলে সে ঋণ শোধ করাও সম্ভব হতো না। এই ধরনের ঋণে সুদের হার ছিল শতকরা ২০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত। তা ছাড়া চাষীরা যে হেতু বাজারে দামের ওঠা-পড়ার খুবর গ্রামে বসে পেত না, ফলে গ্রামের বেনে বা আড়তদারেরা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে খুব কম দামে কৃষিপণ্য কিনে অনেক বেশি দামে বেচতে পারতো। এই রকম একটা অর্থনীতিতে কৃষকদের মধ্যে বৈষম্যও ভয়ানক বাড়তে শুরু করলো। সম্পন্ন চাষীদের মহাজনের উপর নির্ভর করতে হতো না বলে আগে উল্লেখিত শোষণের শিকার তাদের হতে হতো না। ফলে তাদের হাতে প্রচুর পয়সা আসতে শুরু করলো এবং এদের একটা বড় অংশই মহাজনী কারবার নিজেরাই শুরু করে দিল। কৃষিপণ্যের বাজার পড়ার সাথে সাথে গ্রামের বেনে আর মহাজনরা, যাদের মধ্যে অনেকেই আবার ধনী কৃষক, বাজারের উপর তথা গ্রামীণ অর্থনীতির উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এলো। গ্রামের বর্ধিষ্ণু কৃষক-মধ্যবর্তী ব্যবসাদার (ফড়ে, দালাল, বেনে) –মহাজন, এরাই হয়ে দাঁড়ালো ঔপনিবেশিক গ্রামীণ অর্থনীতির মূল স্তম্ভ এবং কৃষক- সম্প্রদায়ের মূল শোষক। মোট কথা এই যে কৃষকদের উপর যুগ যুগান্ত ধরে যে সামন্ত শোষণ চলে আসছিল ঔপনিবেশিক অর্থনীতি তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এই অর্থনীতি কৃষকদের মধ্যে বিভাজন বাড়িয়ে দেয় এবং সর্বোপরি কৃষকদের একটা বড় অংশকে ভূমি থেকে উত্খাত করে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত করে।

দেখা যায় উনিশ শতক থেকেই ভারতীয় কৃষিতে অনেকগুলি পুঁজিবাদী উপাদান সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি-উত্পন্নের বাজারজাত হবার প্রবণতা ক্রমেই বেড়েছে। বাজার-নির্ভর চাষ ক্রমেই বেড়েছে, বিপরীত পক্ষে বাজার-দরের ওঠা-নামা কৃষি-উত্পাদনকে ক্রমেই বেশি বেশি করে প্রভাবিত করেছে, অর্থনীতিতে টাকার লেনদেন ক্রমেই বেড়েছে, মহাজনী ব্যবস্থার চাপে অসংখ্য কৃষক জমি হারিয়ে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়েছে। এতগুলি পুঁজিবাদী বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও কিন্তু ভারতীয় কৃষিতে পুঁজির বিকাশ সীমিতই থেকে গেল। এর একেবারে প্রত্যক্ষ কারণ কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ে নি। কৃষিপণ্য বেচে কৃষক যা পেয়েছে তার সিংহভাগ চলে গেছে সরকারের ঘরে জমিদারের কাছে আর মহাজনের পকেটে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য ছিল উপনিবেশের সস্তার কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজের দেশের শিল্পকে পুষ্ট করা আর নিজের দেশের তৈরি শিল্পদ্রব্য উপনিবেশে বিক্রি করে মুনাফা লুঠ করা। ভারতে পুঁজির অবাধ বিকাশ হলে এই দুটি লক্ষ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতের বুকে পুঁজির বিকাশ সীমায়িত রাখা ছিল তার সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে অস্তিত্বের পূর্বশর্ত। তাই ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষি ও শিল্পের অনগ্রসরতা ঔপনিবেশিক কাঠামোয় পারস্পরিকভাবে বিজড়িত। ভারতের কৃষিতে পুঁজিবাদী বিকাশ আরও কেন হল না তা মূলত বুঝতে হবে সাম্রাজ্যবাদের এই ক্রিয়াপদ্ধতির সাহায্যে।

ভারতের শাসক শ্রেণীর কাছে ইংরেজদের ক্ষমতা হস্তান্তর

আমরা আগেই দেখেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পর্বে ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতি শ্রেণী একটা মাত্রায় নিজেদের সংঘবদ্ধ করে ফেলেছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ইংরেজ পুঁজি যত মার খাচ্ছে ততই সে ভারতের বুকে ইংরেজদের পশ্চাদপসরণ অনুভব করছে। কিন্তু ভারতের মতো বিশাল দেশে বিশেষতঃ এর সুবিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে যারা ক্ষমতার স্তম্ভ সেই গ্রামীণ সামন্ত-জমিদার শ্রেণীর সঙ্গে একটি সুষ্ঠু সমন্বয় ছাড়া যে এখানে শাসন চালানো যাবে না তা এই পুঁজিপতি শ্রেণী ভালভাবেই জানতো। এই কাজটি গান্ধীজির কৌশলী নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভালভাবেই করে ফেলেছিল। গ্রামাঞ্চলে শ্রেণী বৈষম্য ক্রমবর্ধমান থাকলেও জাতীয়তাবাদী শ্লোগানের আড়ালে গান্ধীজি একই সঙ্গে ইংরেজবিরোধী লড়াই-এর নামে শোষিত কৃষকদের সমাবেশিত করতে পেরেছিলেন আবার তাদের শোষক সামন্ত-জমিদার শ্রেণীকেও জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে রাখতে পেরেছিলেন। ফলে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে শাসক শ্রেণীগুলির যে সমন্বয় প্রয়োজন ছিল তা অনেক আগেই ঘটে গিয়েছিল। উপনিবেশগুলিতে সামন্তবাদকে টিকিয়ে রাখা এবং দেশীয় পুঁজিবাদকে সীমায়িত রাখা যেহেতু সাম্রাজ্যবাদেরও কর্মসূচী তাই এই দুটি শ্রেণীর বোঝাপড়ার বৈষয়িক ভিত্তি সাম্রাজ্যবাদই রচনা করে দেয়।

১৯৪০-এর দশকের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে একের পর এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে থাকে। সেগুলি একদিকে যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভীতসন্ত্রস্ত করে দেয়, অন্যদিকে ভারতের শাসকশ্রেণী ও তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকেও বিপন্ন করে তোলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিশ্ব জনগণের হাতে ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয় এবং চীন বিপ্লবের দুর্বার অগ্রগতি পৃথিবীর শক্তি বিন্যাসে নতুন মোড় ঘোরালো। সাম্রাজ্যবাদ সাময়িকভাবে হলেও দুর্বল হলো জনগণের শক্তি দেশে দেশে বৃদ্ধি পেল। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠলো। আর একই সঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরেও এক অভূতপূর্ব সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনজোয়ার সমগ্র দেশকে প্লাবিত করলো। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন ১৯২০-র দশক থেকেই ভারতে এক সংগঠিত রূপ নিয়েছিল। পরবর্তী দু'দশকে তার প্রভাব আরও বিস্তৃত হয় এবং ৪০-এর দশকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ব্যাপক শ্রমিক আন্দোলন এবং তেভাগা-তেলেঙ্গানার কৃষক আন্দোলন সারা দেশের শ্রমিক কৃষক আন্দোলনকে দেশব্যাপী বৈপ্লবিক জোয়ার সৃষ্টির দিকে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করলো। এতে ভারতের শাসকশ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ শক্তিগুলি আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে ভারতে প্রত্যক্ষ শাসন চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়লো। আবার ভারতের শাসক শ্রেণীরাও দেশের জনগণের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভকে প্রশমিত করার জন্য স্বাধীনতার ঘোষণাকে প্রয়োজনীয় মনে করলো। তা ছাড়া দেশের শাসকে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন তাদের ছিলই! এইভাবেই এল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট।

স্বাধীন ভারতে নতুন শাসকদের 'উন্নয়ন' পরিকল্পনা

স্বাধীনতার ঠিক পর পরই নতুনভাবে দেশ গড়ার জন্য ভারত সরকার যে 'উন্নয়ন' পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা মোটেই ব্রিটিশ তত্ত্বাবধানে নয়। তা ঘটলো মার্কিন প্রত্যক্ষ আর্থিক ও কারিগরি পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণে। ১৯৪৮ সালে গৃহীত এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়— সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পতিত জমি পুনরুদ্ধার, ফসল সংরক্ষণ ও সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি ইত্যাদি। স্পষ্টতই দেশের সংখ্যাগুরু অংশ কৃষক সমাজের ধূমায়িত ক্ষোভ-বিক্ষোভকে প্রশমিত করার আকাঙ্ক্ষা এতে প্রতিফলিত। আমেরিকার ফোর্ড ফাউন্ডেশন, রকফেলার ফাউন্ডেশন এবং MIT বিশ্ববিদ্যালয় এই উন্নয়ন প্রকল্প রচনা করে। একই সময় শাসকদল কংগ্রেস মৌলিক ভূমি সংস্কারের কথা ঘোষণা করে। তদনুসারে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বেশিরভাগ রাজ্য ভূমি সংস্কার আইন পাশ করে। এই আইনের ভিত্তি তৈরি হয় ১৯৪৮ সালের ''কংগ্রেসের কৃষি সংস্কার কমিটি''র রিপোর্ট অনুসারে। লক্ষ্য হিসেবে রাখা হয় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের জমি সমবায়ীকরণ এবং সমবায় প্রথায় গ্রাম পরিচালন। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং গ্রাম পঞ্চায়েত ও গ্রাম সমবায়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাব ভূমি মালিকদের কাছে এই সংকেত পাঠায় যে তাদের বাড়তি জমি নিয়ে নেওয়া হবে। কংগ্রেসের ভেতরে ও বাইরে যে শক্তিগুলি ভূমি সংস্কারের বিরোধী তারা সংঘবদ্ধ হতে থাকে এবং ভূমি সংস্কারের সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়া হয়। জমির উর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত আইন অবশ্য ১৯৬০-এর দশকে এবং ১৯৭৫-এর জরুরী অবস্থার সময় নতুন করে সংশোধন করা হয়।

ভূমি সংস্কার আইনের প্রথম ধাপ ছিল মধ্যস্বত্বভোগী অর্থাৎ জমিদার, জায়গীর, ইনাম ইত্যাদিদের উত্খাত করা। ১৯৫০-এর দশকে ভারতের প্রায় অর্ধেক এলাকায় চাষীরা এদেরই খাজনা দিত। এই আইন চালু করার ফলে ২ কোটি কৃষক সরাসরি সরকারকে খাজনা দিতে পারলো। মধ্যস্বত্বভোগীদের অবশ্য ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। বিহার, উড়িষ্যা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও জমিদাররা তাদের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে জমিদারি টিকিয়ে রেখেছিল। একমাত্র কৃষক আন্দোলনের শক্তিতেই জমিদারি প্রথা বিলোপের সাফল্য নির্ভর করেছে। ভূমি সংস্কারের দ্বিতীয় ধাপ ছিল প্রজাস্বত্ব অধিকার সংস্কার। এর দুটি লক্ষ্য ছিল। প্রজাস্বত্বের মেয়াদ সুরক্ষিত করা এবং খাজনা হিসেবে দেয় ফসলের ভাগের ক্ষেত্রে কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষিত করা। এ ক্ষেত্রেও দেখা যায় আইন যতই কঠোর হোক দরিদ্র কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ বা দখলি স্বত্ব যাতে কায়েম না হতে পারে তার জন্য বিভিন্ন জমিদারদের জমিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষ করানোর প্রথা থেকেই গেল। কার্যত এই আইন পাশ হবার পর কৃষক উচ্ছেদ বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের অপারেশন বর্গা তুলনায় বেশি সাফল্য লাভ করেছিল। খাজনার ব্যাপারে মোট উত্পাদনের এক চতুর্থাংশ থেকে এক ষষ্ঠাংশ সরকারি হিসাবে স্থিরীকৃত ছিল, কিন্তু কার্যত বহুক্ষেত্রেই সাবেকী হিসেবে অর্ধেক অংশ জমির মালিক চাষীর কাছ থেকে খাজনা আদায় করে নিতো। ভূমি সংস্কারের তৃতীয় স্তম্ভ জমির উর্ধ্বসীমা নির্ণয় করার লক্ষ্য ছিল উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া। এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সরকারি ব্যর্থতা লক্ষণীয়। আইনের ফাঁকফোকর. উদ্বৃত্ত জমি মালিকদের সঙ্গে রাজস্ব-আধিকারিকদের গোপন বোঝাপড়া এবং সরকারের সদিচ্ছার অভাব— এগুলিই এই ব্যর্থতার কারণ। এ ক্ষেত্রেও যেটুকু সাফল্য পাওয়া গেছে তা কৃষক আন্দোলনের জোরের উপরই নির্ভর করেছে। চতুর্থ বিষয় ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জমির সংহতিকরণ। ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত ভারতের কৃষি জমির প্রায় একতৃতীয়াংশ এই সংহতিকরণের আওতায় এসেছে— যার প্রায় সবটাই পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশে। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যেসব স্থানে মহালওয়ারি ব্যবস্থা চালু ছিল, সেসব জায়গাতেই এই প্রক্রিয়া বেশি সফল হয়েছে।

ভূমি সংস্কারের এই সীমাবদ্ধতার কারণে ভারতের গ্রামাঞ্চলে থেকে গেছে বিপুল বৈষম্য। ছোট ও প্রান্তিক চাষীর সংখ্যাও বিগত দশকগুলিতে ভীষণ বেড়েছে। স্বাধীনতার পর সরকারের আধাখ্যাঁচড়া ভূমি সংস্কার ভয়াবহ গ্রামীণ দারিদ্র্য কিছুমাত্র কমাতে পারে নি। এর পরিণতিতে ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবী কৃষক আন্দোলন ফেটে পড়ে। এ আন্দোলন বহু জায়গায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি এরকম পরিস্থিতিতে আবার নতুন করে কৃষি ও ভূমি সংস্কার নিয়ে পরিকল্পনা করতে বাধ্য হয়। ৬০-এর দশকের শেষ থেকে সমগ্র ৭০ দশক ধরে সরকারি উদ্যোগে প্রকৃত কৃষককে জমির ও ফসলের অধিকার দান করার ক্ষেত্রে সক্রিয়তা এবং ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪৩-এর বম্বে পরিকল্পনায় যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব মৃদুভাবে হলেও লক্ষ্য করা যায়, তেমনি ১৯৫০ দশকের ভূমিসংস্কার পরিকল্পনায় সদ্য সমাপ্ত চীন বিপ্লবের প্রভাব এবং ১৯৭০-এর দশকে কৃষক সমস্যা নিয়ে সরকারের তত্পরতায় ঐ সময় চলমান দুর্বার কৃষক আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ার ছাপ স্পষ্ট।

ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলি ভারত সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৫০-এর মার্চে পরিকল্পনা কমিশন গড়ে তোলা হয় এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯৫১-৫৬ সময় পর্বের জন্য। স্বাধীনতার পরে পরেই ১৯৪৯ সালে ভারতে ভয়াবহ খাদ্য-সঙ্কট উপস্থিত হয় এবং খাদ্যের অভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। আশু সমাধান হিসেবে ভারতের সদ্যগঠিত নতুন সরকার মার্কিন সরকারের কাছে ২০ লক্ষ টন খাদ্য ঋণ হিসেবে চায়। আমেরিকা অনেক বেশি দামে এই খাদ্যশস্য ভারতকে দেয়। ১৯৫৬ সালে দীর্ঘকালীন প্রকল্প হিসেবে ভারত আমেরিকা থেকে খাদ্য আমদানির চুক্তি করে যা পি এল ৪৮০ নামে কুখ্যাত হয়ে রয়েছে। ভারত সরকার নতুন রাষ্ট্রের দায়িত্ব পাবার পরই খাদ্য উত্পাদনের ক্ষেত্রে যে সঙ্কটের মুখে পড়ে তাতে স্বাভাবিকভাবেই ১৯৫১-৫৬ সালের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষক ও কৃষি সমস্যা নিয়ে সরকারের উদ্বেগ ও মনোযোগ স্পষ্ট দেখা যায়। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল জলসেচ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন, ভূমিসংস্কার ও বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলার উপর। সংগৃহীত সম্পদের ৪৫ শতাংশ কৃষিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল কৃষি-ক্ষেত্রের বিকাশই পারবে খাদ্য সঙ্কট সমাধান করতে এবং জনসাধারণের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে। তা ছাড়া সদ্য-ক্ষমতায় আসীন বৃহৎ পুঁজির নেতৃত্বের কাছে শিল্পের বিকাশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি রণনীতিগত দৃষ্টিভঙ্গীতেও কৃষির বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারত সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপরেখায় বলা হয়েছিল, ''কৃষিক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বর্ধিত নিয়োগকে ধরে রাখার জন্য তাকে কাজে লাগানো হচ্ছে মৌলিক উন্নয়ন— যা বিশ এবং তিরিশের দশকের সোভিয়েত অভিজ্ঞতা আমাদের শিক্ষা দেয়।'' প্রথম পরিকল্পনায় জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৮ শতাংশ, মাথা পিছু আয় ২১ শতাংশ এবং মাথা পিছু ভোগ ১১ শতাংশ।

১৯৫৬-৬১-র দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকার শিল্পের উপর প্রধান গুরুত্ব আরোপ করলো। শিল্পের জন্য কাঁচা মাল সরবরাহের বিষয়টি এবার কৃষি-পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। জাতীয় আয়ের ২৫% বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হলো। ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিশ্রেণীর শিল্প-বিকাশের উপর পক্ষপাত দ্বিতীয় পরিকল্পনায় পরিষ্কার ধরা পড়লো। অবশ্য তার ভ্রূণ নিহিত ছিল ১৯৪৮ সালের ''ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি রেজোলিউশনেই''।

এই রেজোলিউশনে ভারত সরকার একদিকে যেমন বিদেশী পুঁজিকে আমন্ত্রণ জানায়, আবার ভারতীয় শিল্পের বিকাশ সম্পর্কেও তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। এই প্রস্তাবে শিল্পসংস্থাগুলিকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। (১) পুরোপুরি সরকারি মালিকানাধীন, যেমন অস্ত্রনির্মাণ, আণবিক বিদ্যুৎ, রেল ইত্যাদি। (২) সরকার আগামী ১০ বছরের জন্য নানা সুবিধা দেবে এমন শিল্প, যথা কয়লা, লৌহ-ইস্পাত, এয়ারক্রাফট নির্মাণ, খনিজ তেল, জাহাজ নির্মাণ, টেলিকম, টেলিগ্রাফ ইত্যাদি। এগুলিকে পরিস্থিতি বুঝে সরকার অধিগ্রহণ করবে। (৩) রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে পরামর্শক্রমে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে এমন ১৮টি শিল্প। (৪) অন্যান্য সকল ক্ষেত্র যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন শিল্প গড়ে উঠবে। খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে শিল্পক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগ করা বৃহৎ পুঁজিপতিদের পক্ষে সম্ভব ছিল না এবং যেসব ক্ষেত্র লাভজনক ছিল না, অথচ দেশের সামগ্রিক শিল্পবিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, সেইসব শিল্পকে রাখা হলো সরকারি মালিকানায়। অর্থাৎ পরিকল্পনা এমনভাবেই করা হলো যাতে বৃহৎ পুঁজিপতি শ্রেণী দ্রুত মুনাফা অর্জন করতে পারে এবং দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চাহিদা বা সমাজের সাধারণ মঙ্গলের দিকে দৃষ্টি দেয়া হয় নি। কৃষি-নির্ভর একটি দেশে কীভাবে শিল্প গড়ে তুললে ব্যাপক মানুষের চাকুরি, খাদ্য, বস্ত্রের সংস্থান হবে সেদিকে নজর দেওয়া হলো না। আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ ও পরামর্শ অস্থায়ী যে এ দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিরা তাদের বিকাশের রূপরেখা তৈরি করেছিল, পরিকল্পনায় তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ছিল। আবার লক্ষণীয় যে একই সঙ্গে তা দেশীয় বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করতেও তত্পর ছিল ও তারজন্য নানা বিধিনিষেধ জারি করেছিল। এই শেষোক্ত বিষয়টি আমাদের ভারতীয় পুঁজি সংক্রান্ত তাত্ত্বিক-চর্চায় খুবই অবহেলিত। অথচ ভারতে দেশি পুঁজির বিকাশ বুঝতে এবং কংগ্রেস-নেতৃত্বের এ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে তা খুবই সহায়ক।

১৯৫১ সালে ভারত সরকার জারি করে ''শিল্প বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৫১''। অর্থাৎ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় থেকেই ভারত সরকার শিল্পোদ্যোগের লাইসেন্স, ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদি নিজের হাতে রাখলো। উত্পাদিত পণ্যের গুণমান, দাম, শিল্পোদ্যোগের আয়তন বৃদ্ধির মত বিষয়গুলি সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখলো। এইভাবে সরকারের মাধ্যমে প্রভাবশালী বৃহৎ শিল্পপতি গোষ্ঠীগুলি শিল্প বিকাশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখলো। ১৯৫৬-তে গ্রহণ করা হয় ''শিল্পনীতি সংক্রান্ত প্রস্তাব।'' বম্বে প্ল্যানের ছাপ এখানে সুস্পষ্ট। শিল্পগুলিকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। (১) বুনিয়াদী ও স্ট্র্যাটেজিক শিল্প— যেগুলি গড়ে উঠবে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র হিসেবে। (২) এমন সব শিল্প যেখানে সরকারি ও বেসরকারি দু ধরনেরই বিনিয়োগ হবে। (৩) শুধুমাত্র বেসরকারি বিনিয়োগের শিল্প। এ ধরনের বিভাজনের পিছনে ভারতের বৃহৎ পুঁজির কী স্বার্থ তা আমরা আগেই দেখেছি। এই প্রস্তাবে ক্ষুদ্র শিল্পের উপরও জোর দেওয়া হলো। ঘোষণায় বলা হলো ''জাতীয় অর্থনীতি'' বিকাশের উদ্দেশ্যেই এই জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল এর পিছনেও মূল স্বার্থ বৃহৎ শিল্পের সুবিধা। বৃহৎ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ নির্মাণ, শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের যোগান এবং অনেক সস্তায় শ্রমিক নিয়োগ— এই তিন ধরনের সুবিধাই তারা পেতে লাগলো। বলা হয়েছিল ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ দেশের জ্বলন্ত বেকার সমস্যার সমাধানে কাজে লাগবে। কিন্তু আসলে এ উদ্যোগ কখনই সেই স্তরে নিয়ে যাওয়া হয় নি যেখানে ''জাতীয় অর্থনীতি''র প্রকৃত বিকাশ ঘটিয়ে বেকার সমস্যার কার্যকরী সমাধান করবে। ১৯৬৪-তে গড়ে তোলা হলো ''মনোপলি এনকয়্যারি কমিশন''— যার লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা হলো যে এই কমিশন অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে বেসরকারি মালিকানার কেন্দ্রীভবনের উপর নজরদারি করবে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল এই বড় বড় ঘোষণার আড়ালে বৃহৎ পুঁজি বেড়েই চলেছে, দেশের দারিদ্র্য ও বেকারিত্বও বেড়ে চলেছে। দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার ও প্রতারণা করার শিল্পটি ভারতের শাসক শ্রেণী প্রথম থেকেই ভালভাবে আয়ত্ত করে ফেলেছিল।

ভারতের বৃহৎ পুঁজিকে সুরক্ষা দেবার জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ভারত সরকার বিদেশী পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক জারি করে। তার ফলে বিদেশ থেকে পণ্যের আমদানি যথেষ্ট কমে গিয়েছিল। আবার যেহেতু দেশি শিল্পের পক্ষে প্রয়োজনীয় ছিল বিদেশের প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের আমদানি, তাই বিদেশি পুঁজির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মারফৎ দেশি শিল্পপতিরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে পণ্য উত্পাদন করতে থাকলো। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিকল্পনায় শিল্পের উপর জোর দেওয়ার জন্যই শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি উত্পাদনের উপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হলো। এই উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের আমদানিকে উদার করা হলো। বিপরীত পক্ষে বহু বিদেশি পণ্যের আমদানির উপর এবং এ দেশে বিদেশি পণ্যের উত্পাদনের উপর বিধিনিষেধের পাশাপাশি বহু ক্ষেত্রে আমদানি পণ্যের উপর ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত কাস্টমস ডিউটি চালু করা হলো। সরকারের এই মনোভাব তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল যখন ১৯৬০-এর দশকে গাড়ি তৈরির বিদেশি কোম্পানি সহ অনেক বিদেশি কোম্পানিকে ভারতে উত্পাদনের ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেওয়া হলো এমনভাবেই যে বিদেশি পণ্যের তুলনায় ঐ একই পণ্যের দেশি ব্র্যান্ডগুলি অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। বেসরকারি দেশি বিনিয়োগকে উত্সাহিত করার জন্য ১৯৫২ সালের আগেকার ট্যারিফ বোর্ডকে প্রতিস্থাপিত করা হয় নব-গঠিত ট্যারিফ কমিশন দিয়ে। এই সংস্থার কাজই হলো বহিঃশুল্ক, দাম, ভর্তুকি, অতিপ্রয়োজনীয় কাঁচা মালের অন্তঃশুল্কের হ্রাস, সরকারের তরফে বড় পরিমাণ কাঁচা মাল ক্রয়, আমদানির পরিমাণের উপর বাধানিষেধ জারি ইত্যাদি বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া। ট্যারিফ বোর্ডের সুপারিশে অন্তত ৫০ টা শিল্প উপকৃত হয়েছিল যার মধ্যে ছিল ভোগ্যপণ্য উত্পাদনকারী শিল্প থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, আধ-সারা দ্রব্য (Semi-finished) (বিশেষ ধরনের ইস্পাত, নন-ফেরাস ধাতু, রাসায়নিক ও ঔষধ, বস্ত্রশিল্পের যন্ত্রপাতি) প্রভৃতি। এই মর্মে সরকার বাজেটেও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিল, যেমন নতুন শিল্পোদ্যোগে কর ছাড়, এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানিতে লভ্যাংশ চালান করার সুবিধা ইত্যাদি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কিছু আর্থিক সংস্থার গঠন যার উদ্দেশ্য ছিল শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিকে বেশি পরিমাণে অর্থ যোগান দেওয়া। ১৯৪৮-এ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিনান্স কর্পোরেশন (IFCI) ১৯৫৪ তে ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (NIDC) ১৯৫৫ তে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (ICICI) ১৯৬৪ সালে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (IDBI) ১৯৭১-এ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিকনস্ট্র্যাকশন কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া ইত্যাদি ব্যাঙ্কগুলি ভারতীয় উদ্যোগে গঠিত শিল্পকে পুঁজি সরবরাহ করার জন্যই তৈরি করা হয়। ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট (FERA) চালু করা হয় যাতে এ দেশের কোম্পানিতে সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ ৪০ শতাংশের বেশি না হতে পারে।

সরকারের আনুকূল্যে এইভাবে দেশীয় পুঁজিপতি শ্রেণী বিপুল মুনাফা অর্জন করতে থাকে। এর ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি আমাদের দেশের বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর অনেকগুলিই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। দেশের বুনিয়াদী শিল্পগুলিতে তারা পুঁজি বিনিয়োগের জন্য সক্ষম হয়ে ওঠে। দেশের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও শ্রমসম্পদকে ব্যবহার করে, দেশের কোটি কোটি জনসাধারণকে চরমতম দারিদ্র্যে রেখে কয়েকটি একচেটিয়া পুঁজিপতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার পরবর্তী ৬৫ বছরে অপরিমেয় সম্পদের মালিক হয়েছে। এদেরই মুনাফা ও শিল্পবৃদ্ধিকে দেশের জি ডি পি-বৃদ্ধি হিসাবে দেখানো হয়। প্রতিটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ধাপে ধাপে এই জি ডি পি-র শতকরা বৃদ্ধির হার লক্ষণীয়। চতুর্থ পরিকল্পনায় (১৯৬৭-১৯৭৪) ৩.৯ শতাংশ, পঞ্চম পরিকল্পনায় (১৯৭৪-৭৯) ৫.৫ শতাংশ, ষষ্ঠ পরিকল্পনায় (১৯৮০-৮৫) ৬ শতাংশ, এবং তার পরবর্তী পর্বে ৭ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত হারে তা বেড়েছে। ১৯৫৭ সালে ভারতের ২২টি একচেটিয়া গোষ্ঠীর সম্পদ ছিল ৩১২ কোটি টাকা, ১৯৯৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৫৮,০০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৪০ বছরে সম্পদ বৃদ্ধি ৫০০ গুণ! এই সম্পদ বৃদ্ধিকে অক্ষত রাখার জন্য সরকার বছরে বছরে করব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে।

অবশ্য আমাদের একবারের জন্যও ভুলে যাওয়া চলবে না যে ভারতের বৃহৎ শিল্পপতিরা যদিও নিজেদের বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য দক্ষতার সঙ্গে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সাজিয়েছিল তব সমগ্র পর্ব জুড়ে আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির পরামর্শ, সহযোগিতা এবং হস্তক্ষেপ কমবেশি পরিমাণে সর্বক্ষণই জারি ছিল।

ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক বিকাশে একেবারে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আমল থেকেই বৈদেশিক আর্থিক সহায়তার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই সহায়তার দুটি দিক ছিল। একদিকে এই সহায়তাকেই বৈদেশিক শক্তিগুলি ব্যবহার করত তাদের উপর আমাদের দেশকে নির্ভরশীল করে রাখতে; আবার এই সহায়তাদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শক্তিগুলির টানাপোড়েন একটি আপেক্ষিক স্বাধীনতার পরিসর তৈরি করতে সাহায্যকারী ভূমিকা পালন করতো। প্রথম পরিকল্পনার সময়ে অবশ্য এই সাহায্যের পরিমাণ খুবই কম ছিল। এর একটি কারণ হলো এই পরিকল্পনায় কোন বড় মাপের উন্নয়ন প্রকল্প ছিল না, অন্য কারণটি হলো এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রভাবাধীন আর্থিক সংস্থা ছাড়া আর কেউ সাহায্য করার মত অবস্থায় ছিল না, বা তার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারে নি। প্রথম পরিকল্পনায় উন্নয়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৯.৬ হাজার মিলিয়ন টাকা, আর বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল ১.৮৮ হাজার মিলিয়ন টাকা। এই সাহায্যের ৭১ শতাংশই এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় থেকে পরিস্থিতি বদলে গেল। এই পরিকল্পনায় শিল্প ও পরিবহনের খাতে বড় আকারে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বৈদেশিক সাহায্য মারফতই এর জন্য অর্থ জোগান দেওয়া সম্ভব ছিল। তাই পরিকল্পনায় বরাদ্দ ৪৮ হাজার মিলিয়ন টাকার মধ্যে ৮ হাজার মিলিয়ন টাকাই বৈদেশিক সাহায্য বাবদ ধার্য করা হয়। তৃতীয় পরিকল্পনার শেষে সমগ্র বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৮.৭ হাজার মিলিয়ন টাকা। কিন্তু এই দ্বিতীয় পরিকল্পনার সময় থেকে এক নতুন ঘটনা ঘটতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বেশ ভাল পরিমাণে সাহায্য ভারতকে দিতে শুরু করে। তৃতীয় পরিকল্পনার শেষে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণদানকারী দেশ হিসেবে উঠে আসে। পরিমাণের দিক থেকে এই সহায়তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম (১২.৮ হাজার মিলিয়ন এবং ৪.৮ হাজার মিলিয়ন টাকা); কিন্তু দুটি কারণে এর গুণগত মূল্য ছিল অপরিসীম। প্রথমত রাজনৈতিক বিচারে বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত একটি দেশের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক এবং কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কাছে মোটেই ভাল ঠেকেনি। অথচ লক্ষণীয় বিষয় এই প্রবণতা পরের দশকগুলিতেও সম্প্রসারিত হয় এবং ক্রমবর্ধমান থাকে। দ্বিতীয়ত সোভিয়েত সাহায্যের ধরনটিও ছিল একটু আলাদা, যা চালিত হতো প্রধানত পাবলিক সেক্টরে মৌলিক শিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে। ভারতে শিল্পের ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভরতা বৃদ্ধির জন্য সোভিয়েত ঋণ কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল। সোভিয়েত ঋণের সুদের হারও ছিল পশ্চিমী দেশগুলির তুলনায় কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের শর্ত ছিল অত্যন্ত কড়া: এক্সিস ব্যাঙ্ক-এর সুদের হার ছিল ৫.৭৫% সেখানে সোভিয়েতের সুদের হার ছিল ২.৫%। তাছাড়া মার্কিন ঋণ শোধ করতে হতো ডলারে, যেখানে সোভিয়েত ও তার ব্লকের অন্যান্য রাষ্ট্রের ঋণ 'রুপি'-তে পরিশোধযোগ্য ছিল। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মার্কিন যন্ত্রপাতি কিনতে অনেক বেশি চড়া দাম দিতে হতো। পাঁচের দশক থেকেই ভারত-সোভিয়েত সম্পর্ক অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। গোড়ায় যে মনোভাব নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সাহায্য করতে আরম্ভ করে, সেই মনোভাব বদলাতে শুরু করে যত বেশি ক্রুশ্চভ সংশোধনবাদীরা তাদের ক্ষমতা সংহত করতে থাকে। যে পরিমাণে সোভিয়েত রাষ্ট্র পুঁজিবাদ অভিমুখে এগোতে থাকে সে পরিমাণেই সে একটি আধিপত্যবাদী শক্তিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। ব্রেজনেভ আমলে ভারতীয় শাসক শ্রেণীর সঙ্গে সোভিয়েত শাসকদের বোঝাপড়া গুণগতভাবে বদলে যায় এবং সোভিয়েতের অর্থনৈতিক সহযোগিতা স্পষ্টতই জনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬৫ সালে বিশেষতঃ তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মস্কো সফরের পর সোভিয়েত ৬ হাজার মিলিয়ন টাকার একটি অতিরিক্ত ঋণ ভারতকে দেয় যার খানিকটা পুরনো প্রকল্পগুলিতে (ভিলাই, বোকারো) কাজে লাগাবার জন্য, বাকিটা সোভিয়েত থেকেই কাঁচা মাল যন্ত্রাংশ এবং বিমান নির্মাণ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ক্রয় করার জন্য। ১৯৬৫-তেই কলকাতার সোভিয়েত দূতাবাসের প্রতিনিধি বলেন যে তাদের দেশ বেসরকারি ক্ষেত্রেও বুনিয়াদী শিল্পে বিনিয়োগ করার জন্য প্রস্তুত। এ সবই ভারতে সোভিয়েত সাহায্যের এক নতুন বাঁকের সূচনা। ১৯৭০-এর দশকে ভারতের বুকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব এমন প্রবল হয়ে ওঠে যে তখনকার মতো মার্কিন প্রভাব ক্ষুণ্ণ হয়। সোভিয়েতের চরিত্রে যে পরিবর্তনই আসক না কেন দু অবস্থাতেই রুশ-মার্কিন টানাপোড়েন থেকে ভারতীয় পুঁজিপতিরা তাদের নিজস্ব শক্তিবৃদ্ধিতে সুবিধা পেয়েছে। দুটি বড় শক্তির এই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়ারা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, রাজনৈতিক ভাবেও সময় ও সুযোগ মত একটি আপেক্ষিক স্বাধীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে শুরু করে। ১৯৫০-এর দশকে ''পঞ্চশীল নীতি''র অন্যতম প্রবক্তা হওয়া থেকে শুরু করে ৭০-এর দশকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা তারই উদাহরণ।

এটা যে ভারতীয় বৃহৎ বুর্জোয়াদের পক্ষে সম্ভব হলো তার মূল নিহিত রয়েছে ভারতীয় পুঁজির বিকাশের মধ্যে— যা অন্যান্য পিছিয়ে পড়া দেশগুলির তুলনায় অনেক বেশি উন্নত ছিল এবং যার যাত্রা শুরু হয়েছিল গত শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই।

সবুজ বিপ্লব: ভারতের কৃষিতে পুঁজিবাদী উত্পাদন পদ্ধতির বিস্তার

ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের নেতৃত্বে গঠিত ভারত সরকার ১৯৪৭-এর পর থেকেই দেশে শিল্প-বিস্তারের উপর তাদের প্রধান ঝোঁক দেখিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলিতে বিশেষতঃ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় সরকার সচেতনভাবেই কৃষির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিল। প্রথম পরিকল্পনায় ভারত সরকার সমগ্র ব্যয়বরাদ্দের ৩৭ শতাংশ কৃষির ক্ষেত্রে নিয়োজিত করেছিল যা শতকরার হিসাবে আজও পর্যন্ত সর্বাধিক। এছাড়া আংশিক ভূমিসংস্কার ও ১৯৫০-৬৭ পর্যন্ত কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামও কৃষির উত্পাদনশীলতা বাড়াতে ব্যর্থ হয়। কৃষির উত্পাদনশীলতা বাড়াবার সরকারি প্রচেষ্টা ১৯৬৬-৬৭ সাল থেকেই এক চমকপ্রদ সাফল্য আনতে শুরু করে। এই সাফল্যের পিছনে যে সরকারি কর্মসূচিটি ক্রিয়াশীল ছিল তার নাম 'সবুজ বিপ্লব'। 'সবুজ বিপ্লব'কে এক সার্বিক প্রকল্প হিসেবে ভারত সরকার গ্রহণ করেছিল, যার মুখ্য বিষয়গুলি ছিল উচ্চফলনশীল (HYV) বীজের প্রয়োগ, ভূমির উপরের ও নীচের জল ব্যবহার করে উন্নত জলসেচ ব্যবস্থা, কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার, জমির সংহতিকরণ, সরকারি উদ্যোগে ভূমিসংস্কার, কৃষি-ঋণ-সরবরাহের জন্য সরকারি উদ্যোগ, গ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণ, গ্রামীণ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষিপণ্য বিক্রয়ের যথাযথ ব্যবস্থা, কৃষি খামারের যান্ত্রিকীকরণ ইত্যাদি। ''সবুজ বিপ্লব'' পরবর্তীকালে এই কর্মসূচী ভারতের কৃষিকে শুধু নয়, ভারতের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ও ভারতের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। যেহেতু উচ্চফলনশীল বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষিযন্ত্রপাতি ইত্যাদির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এই তথাকথিত বিপ্লবের অপরিহার্য অঙ্গ, তাই এর ফলে বিশাল পরিমাণে সাম্রাজ্যবাদী বিনিয়োগের পথ সুগম হয়, দেশের অভ্যন্তরে কৃষি উপকরণের বিরাট ব্যবসা কিছু সম্পন্ন লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। বড় মাত্রায় পুঁজির বিনিয়োগ, বাজারের সম্প্রসারণ, উদ্বৃত্তের পুনর্বিনিয়োগের ধরন সূচনা করে যে কৃষিতে সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন সম্পর্ক ভাঙছে, পুঁজিবাদী সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ''সবুজ বিপ্লব'' ভারতের কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষককে সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে এনে ফেলেছে এবং এর ফলাফল এমন সুদূরপ্রসারী হয়েছে যে এ বিষয়টি আরও একটু বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।

''সবুজ বিপ্লব''-এর কর্মসূচী রূপায়ণের জন্য সরকার ভারতের কয়েকটি বিশেষ অঞ্চল বেছে নিয়েছিল। প্রধানত এগুলি হলো পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশ। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এসব স্থানে জলসেচ ব্যবস্থা সহ সাধারণভাবে কৃষিব্যবস্থাই বহু আগে থেকে উন্নত ছিল। উৎপাদনশীলতাও ছিল অবশিষ্ট ভারত থেকে বেশি। ১৯৬৫ সালে ''সবুজ বিপ্লব'' শুরুর আগে যেখানে ভারতের উত্পাদনশীলতা ছিল হেক্টর প্রতি ৭৫৬ কেজি, সেখানে পাঞ্জাবের ছিল হেক্টর প্রতি ১২৩১ কেজি। ১৯৬০-র দশকের আগে থেকেই পাঞ্জাবের কৃষি উত্পাদন সম্পর্কে সামন্ততান্ত্রিক উপাদান ভারতের অন্য যে কোন অংশের তুলনায় কম ছিল। তাই পাঞ্জাবই ছিল 'সবুজ বিপ্লব' কর্মসূচী রূপায়ণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত রাজ্য। ''সবুজ বিপ্লব''-এর নির্ধারক উপাদান ছিল উচ্চ ফলনশীল বীজ। এই বীজ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হয় অনেক বেশি পরিমাণে সার, কীটনাশক, জল ও খামারের যন্ত্রপাতি। এর সব কটির ব্যবহার সাম্রাজ্যবাদী বিনিয়োগ ও ব্যবসাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভারত সরকার ১৯৬৬-৭১ চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিদেশ থেকে ঐ সকল সামগ্রী আমদানি করতে ২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছিল। লক্ষণীয় এই অর্থের পরিমাণ তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কৃষিতে মোট বরাদ্দের ৩ গুণ। আমেরিকার ফোর্ড ও রকফেলার ফাউন্ডেশন-এর তত্ত্বাবধানেই ভারতের বুকে চালু হয়েছিল উচ্চফলনশীল বীজ (HYV)। স্পষ্টতই সাম্রাজ্যবাদ এই বীজের ব্যবহার চালু করেছিল যাতে ভারতে তারা বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করতে পারে।

''সবুজ বিপ্লব'' তথা উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার এমনই একটি পদ্ধতি যেটি কৃষিতে বিনিয়োগের মাত্রা উত্তরোত্তর বাড়াতেই থাকে। কারণ এই বীজগুলির সাহায্যে যে চাষ হয় তাতে কীট-বীজাণুর আক্রমণ অনেক বেশি হয়। শুধু তাই না, এই আক্রমণ স্বাভাবিক খাদ্য শৃঙ্খলের নিয়মে অন্য খাদকের আক্রমণ দ্বারা প্রতিহত হয় না। তার জন্য দরকার পড়ে একটি সুনির্দিষ্ট ধরনের কীটনাশক। আবার কিছুদিন পরে ঐ নির্দিষ্ট বীজাণু যখন পুরনো কীটনাশককে সহ্য করে ফেলে, তখন আবার চাই আরও উন্নত কীটনাশক। রাসায়নিক সারের ব্যবহারও একই রকম দুষ্টচক্রের শিকার। মাটির উর্বরাশক্তি কেবলই কমতে থাকে। আর প্রয়োজন হয় আরও উন্নতমানের এবং আরও বেশি পরিমাণে রাসায়নিক সারের ব্যবহার। এই প্রক্রিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী ও ভারতীয় বৃহৎ পুঁজির ব্যবসা একদিকে ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল, অন্যদিকে ধ্বংস করে দিতে লাগল আমাদের দেশের হাজার হাজার প্রজাতির ধান, গম ও সবজির উচ্চফলনশীল বীজ যা আমাদের দেশের মাটি ও ভৌগোলিক পরিবেশের পক্ষে উপযোগী। এতে ভারতীয় কৃষির চিরস্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেল এবং এখনও এই ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। শুধু তাই নয়, এই পদ্ধতির প্রবর্তন স্থায়ীভাবে মাটির স্বাভাবিক উর্বরাশক্তি নষ্ট করলো, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করলো, মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করলো, এমনকি মত্স্যচাষেরও ক্ষতি করলো। এ কথা সত্য যে ''সবুজ বিপ্লব'' চালু হবার পর প্রথম দু'দশক কৃষির উত্পাদনশীলতা বেড়েছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে তা সৃষ্টি করে গেল ভবিষ্যতে ভারতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির ব্যবসার জন্য এক সুদূরপ্রসারী বন্দোবস্ত। ''সবুজ বিপ্লব''-এর এলাকাগুলিতে বিশেষত পাঞ্জাবে বিপুল পরিমাণে পুঁজির বিনিয়োগ কৃষিব্যবস্থায় পুঁজিবাদী রূপান্তরের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে উপস্থিত হয়। জমির কেন্দ্রীভবন, গরীব ও ক্ষুদ্র কৃষকের জমি হারানো, উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি, কৃষি-মজুরের আনুপাতিক সংখ্যা বৃদ্ধি— সমস্ত বিচারেই ''সবুজ বিপ্লব''-এর ফলে কৃষি ব্যবস্থার পুঁজিবাদী বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে ভারতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির তত্ত্বাবধানে ''সবুজ বিপ্লব''-এর এক নতুন পর্বের সূচনা হয়। আমরা পরে দেখবো এই সময়ে নতুন উদ্যমে বহুজাতিকদের তত্ত্বাবধানে পুঁজিবাদী বিনিয়োগ শুরু হয়— যা কৃষিতে পুঁজিবাদী রূপান্তর আরও বাড়িয়ে দেয়।

বিশ্বায়নের পর্বে ভারতের অর্থনৈতিক ''বিকাশ''

গত শতাব্দীর ৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারত দেশের অর্থনীতিতে উদারনীতির সূত্রপাত ঘটায়। এই নীতি ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের গ্রহণ করা কোন স্বাধীন নীতি নয়। ঐ সময় আন্তর্জাতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদ যে গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে প্রবেশ করেছিল তা থেকে উদ্ধার পাবার জন্য উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর বাইরে বিশেষতঃ উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারে বাধাহীনভাবে অনুপ্রবেশ জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছিল। এই প্রয়োজন মেটানোর জন্যই পুঁজির বাজারের 'বিশ্বায়ন'-কে একটি নতুন অর্থব্যবস্থা হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলা হয়। আমাদের দেশের শাসকশ্রেণী ধাপে ধাপে এই অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হবার জন্য তাদের অর্থনৈতিক নীতিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাবার জন্য এগোতে থাকে। ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালেই দু দফায় লাইসেন্সিং প্রথা শিথিল করা হলো। এর ফল হলো দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিরা অনেক স্বাধীনভাবে ভারতের বাজারে বিনিয়োগ করতে, শিল্পস্থাপন করতে ও ব্যবসা করতে পারবে। ১৯৯০ সালের ৩১ মে উদারীকরণ নীতিতে আর এক ধাপ এগিয়ে স্থায়ী সম্পদে ২.৪ কোটি টাকা বিনিয়োগকৃত এবং নতুন গড়ে ওঠা সকল শিল্পের জন্য লাইসেন্স প্রথা তুলে দেওয়া হলো, যে কোন শিল্পে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদন করে দেওয়া হলো আঞ্চলিক বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হলো, ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য সিলিং তুলে দেওয়া হলো। ১৯৯১-এর জুলাইতে ভারত সরকার 'নয়া অর্থনৈতিক নীতি' ঘোষণা করে। এর ফলে ভারতের বাজার আক্ষরিক অর্থেই আন্তর্জাতিক পুঁজির কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। একই সঙ্গে ভারতের বৃহৎ পুঁজিও এই নীতির ফলে প্রভূত লাভবান হলো। দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিদের একটি অংশ পুঁজির পরিমাণের বিচারে আগেই একটা উচ্চস্তরে পৌঁছে গিয়েছিল। ''নয়া অর্থনৈতিক নীতি'' ছোট ও মাঝারি শিল্পের যে সুরক্ষাগুলি ছিল তা তুলে দেওয়ার ফলে তাদের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়। বিদেশী প্রযুক্তি ও পুঁজির সাথে মৈত্রী করে শুধু দেশের বাজারে যে একচ্ছত্র আধিপত্য করতে থাকে তাই নয়, বিদেশের বাজারেও তারা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে এবং সাফল্য লাভ করে। ১৯৯৪ সালে ভারত সরকার 'গ্যাট' চুক্তিতে স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়াকে চরম পরিণতি দেয়।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলিকে এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ফেলে দেবার ফলে তাদের মধ্যে অসংখ্য শিল্প ও কারখানা রুগ্ন হয়ে পড়লো বা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। এমনকি বৃহৎ পুঁজিপতিদেরও বহু শিল্প ও কারখানা রুগ্ন বা বন্ধ হয়ে পড়লো। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার পরিচালিত বহু কারখানা প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে বন্ধ হয়ে গেল। বিগত ২০ বছরে সারা দেশে কয়েক লক্ষ কারখানা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজি কৃষির মত লাভজনক ক্ষেত্র ছাড়াও টেলিকম, বীমা, বিদ্যুৎ, লৌহ ও ইস্পাত, অটোমোবাইল, ওষুধ ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রেই হাত বাড়িয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ নীতিগতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ব্যাঙ্ক ও বীমা, বিমানবন্দর ও বিমান চলাচল, রেল, খনি, এমনকি অস্ত্র নির্মাণেও বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া কোথাও দ্রুত, কোথাও ধীরগতিতে চালু করা হয়েছে। দীর্ঘদিন লোকসানে চলা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকে বন্ধ করে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করা তো হয়েছেই এমনকি লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকেও বেসরকারিকরণের দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। একই সঙ্গে আমাদের এই চিত্তাকর্ষক ঘটনাটিরও স্বীকৃতি দিতে হবে যে গত পাঁচ দশক ধরে চলতে থাকা এই রাষ্ট্রীয় পুঁজির শক্তি ভারতীয় রাজনীতি-অর্থনীতিতে এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে য়ে বেসরকারিকরণের এই সুতীক্ষ্ণ আওয়াজের সময়ও তা কিন্তু বেড়েই চলেছে। ১৯৯৭-৯৮-তে যেখানে দেশে ২৩৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ছিল ২০০৬-০৭-এ তা বেড়ে হয়েছে ২৪৭টি। ঐ একই কালপর্বে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত মোট পুঁজির পরিমাণ ২৪৯৮৫৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬ৃ৬৫ৃ১২৪ কোটি টাকা; অর্থাৎ ঐ ৯ বছরে ভারতের আমলাতান্ত্রিক পুঁজি ২৬৬ শতাংশ বেড়েছে। VSNL, IPCL, মারুতি উদ্যোগ লিমিটেড CMCL-এর মত সংস্থা বেসরকারিকরণ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভারতের আমলাতান্ত্রিক পুঁজি এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী।

উদারনীতির সকল কার্যক্রমই সূচিত করে যে তার একমাত্র লক্ষ্য সাম্রাজ্যবাদী ও বৃহৎ পুঁজিকে আশু সঙ্কটের হাত থেকে রক্ষা করা। তার ঘোষিত নীতি হলো সাম্রাজ্যবাদী ও বৃহত্পুঁজির বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য কোনও বাধাই আর বরদাস্ত করা হবে না। তার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সরকারি বিধিনিষেধ থেকে তাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা। উদারনীতির সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো— শিল্প বা ব্যবসা চালানো সরকারের কাজ নয়, তাই সরকারকে এই সব কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। ভারতের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সরকারি বিধিনিষেধ থেকে বৃহৎ পুঁজিকে রক্ষা করতে চালু করা হলো ''বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন, ২০০৫।'' দেশের প্রচলিত শ্রম-আইনের নানা বিধিনিষেধের বেড়ি যাতে বল্গাহীন শোষণের ক্ষেত্রে বাধা না হয়ে উঠতে পারে তার জন্যই এই আইন। এই আইনের পিছনে রয়েছে নানা ছলচাতুরি। যেমন সেজ-অঞ্চলে কেবল রপ্তানিকেন্দ্রিক শিল্প-উত্পাদন হবে বলা হলেও বিনোদন, আবাসন তৈরি ইত্যদিকেও নানা অছিলায় এর আওতাভুক্ত করা হয়েছে। একইভাবে অসংখ্য পণ্য যা আগে শহর এবং গ্রামীণ কুটির শিল্পে উত্পাদন হতো, বৃহৎ পুঁজি সেখানে অনুপ্রবেশ করে সেগুলিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নিজের তাগত বাড়িয়েছে। খুচরো বিপণনেও দেশি-বিদেশি বৃহৎ কোম্পানিগুলিকে ঢুকে পড়ার সুযোগ করে দিয়ে অসংখ্য ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের তাদের উপার্জন ক্ষেত্র থেকে ছিটকে দেওয়া হয়েছে। এক কথায় এই নীতির ফলে দেশি-বিদেশি বড় পুঁজির কাছে দেশের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, উত্পাদন ক্ষেত্র ও লাভজনক ব্যবসা তুলে দেওয়া হয়েছে। ভারতে একচেটিয়া পুঁজির (বিশেষতঃ বিদেশি একচেটিয়া পুঁজি) বৃদ্ধির সামনে দুটি বড় বাধা ছিল কৃষিতে আধা-সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কের উপস্থিতি এবং শিল্প-বাণিজ্যের বহু ক্ষেত্রে ছোট পুঁজির চলাচল ও সুযোগ। উদারীকরণের নীতির ফলে তার অনেকটাই অপসারিত হলো। ফলে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ ও বৃদ্ধি হয়ে উঠলো অভূতপূর্ব। মোট পুঁজির পরিমাণ ও পুঁজির বিকাশের গতির দিক থেকে আমাদের দেশ অনেক পুঁজিবাদী দেশের সাথে তুলনীয় হয়ে উঠেছে, অনেক পণ্যের উত্পাদনে অন্যান্য উন্নত পুঁজিবাদী দেশকে ছাড়িয়ে গেছে, কৃষি-শিল্প-পরিষেবা— সকল ক্ষেত্রেই উত্পাদন পদ্ধতি ও প্রযুক্তি মূলতঃ পুঁজির নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। ২০১০-এ আমাদের দেশ মোটর সাইকেল উত্পাদনে পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর প্যাসেঞ্জার কার ও মানববাহী গাড়ি উত্পাদনের পৃথিবীতে অষ্টম স্থান অধিকার করেছে। ভারতে শিল্প বিকাশের হার গত শতাব্দীর ৭০-৮০-র দশক থেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলির বিকাশের হারের সাথে তুলনীয় তো বটেই, কখনও কখনও আদর্শ স্থানীয়।

ভারতীয় পুঁজির এই ধরনের বিকাশের বিকৃতির দিকটিতেও আমাদের গভীর মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে। না হলে মূল্যায়ন পূর্ণাঙ্গ হবে না। ভারতীয় পুঁজির এই বিকাশের প্রকৃতি কোন সনাতনী পুঁজিবাদী ধরনের নয়। এটি হচ্ছে দেশের সমাজ ও অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রয়োজনের বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া পুঁজির উপর নির্ভরশীল একটি বিশেষ প্রকৃতির, এক কথায় যাকে বলা যায় বিকৃত পুঁজিবাদী বিকাশ। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পর্যায়ে এই পুঁজির জন্ম ও বিকাশ হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ পুঁজির হাত ধরে। তার পরবর্তী পর্বে ১৯৯০ পর্যন্ত তা নির্ভরশীল থেকেছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির প্রযুক্তির উপর। বিশ্বায়নের পর্বে, অর্থাৎ ১৯৯১-এর পর থেকে এই পুঁজি আন্তর্জাতিক পুঁজির সাথে প্রতিযোগিতা ও মৈত্রীর মাধ্যমে তার বিকাশ ঘটিয়েছে এবং তার নিজস্ব প্রয়োজন ও সমস্যাকে মোকাবিলা করছে আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে সংপৃক্ত হয়েই। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে বুর্জোয়া বিপ্লবের কালে বা মৌলিক বুর্জোয়া সংস্কারের সময়ে নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তন ঘটে এবং সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ থেকে যাওয়া সত্ত্বেও সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিকাঠামোয় বুর্জোয়া ধরনের রূপান্তর সাধিত হয়। যে কোন ধরনের পুঁজিবাদেই কিছু না কিছু বিকৃতি থাকেই। বাজার তৈরির জন্য সে সমাজে 'ভোগবাদ' ছড়িয়ে দেয়, সমাজের প্রয়োজনে নয়, তার নিজস্ব মুনাফার তাড়নায় চালিত হয়ে সে ঠিক করে কোন পণ্যের উত্পাদনে বিনিয়োগ করবে। একটি সুস্থ, সুন্দর ও সর্বাঙ্গীন সামাজিক বিকাশের দিকে তার নজর দেবার অবকাশ নেই, প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার দিকেও তার কোন মনোযোগ নেই। এই ধরনের বিকৃতি পুঁজির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এগুলি সহই দেশটির নিজস্ব প্রয়োজন, বৈশিষ্ট্য ও বিকাশের স্তর অনুযায়ী সে দেশ তার পুঁজিবাদী বিকাশের নিজস্ব যাত্রাপথ করে নেয়। ভারতীয় পুঁজির বিকাশের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী উত্পাদন ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত এই বিকৃতি ছাড়াও অন্য একটি বিকৃতিও যুক্ত হয়েছে। এখানে পুঁজি মৌলিকভাবে বৈদেশিক পুঁজি ও প্রযুক্তির দ্বারা প্রভাবিত ও তার উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে তা ভারতীয় সমাজ অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য দ্বারা যত না প্রভাবিত হয়েছে, তার তুলনায় বেশি প্রভাবিত হয়েছে বৈদেশিক প্রযুক্তির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও তার প্রয়োজন ও পরিকল্পনা দ্বারা। এ থেকে দুটি ফলই পাওয়া গেছে। কোন কোন পর্বে তা এদেশের পুঁজিবাদী বিকাশের বেগ বাড়িয়েছে, উল্টোদিকে অর্থনীতির পুঁজিবাদী বিকাশের স্বাভাবিক চাহিদা ও চরিত্র অনুযায়ী রূপ পেতে তা বাধারও সৃষ্টি করেছে। এর ফলে নানা ধরনের পশ্চাত্পদতা ভারতের সমাজ-অর্থনীতির উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। ফলে অদ্ভুত এক দ্বৈত প্রকৃতি ভারতীয় অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। একবিংশ শতাব্দীর ভারত তাই সারা বিশ্বের সামনে ''উন্নয়ন'' ও পশ্চাত্পদতার যুগপৎ বিস্ময়!

বিশ্বায়নের পর্বে ভারতীয় কৃষি

গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে ভারতের কৃষিব্যবস্থা এক গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। 'সবুজ বিপ্লব'-এর এলাকাগুলিতে উত্পাদনের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়ে আসে। কৃষির বিকাশের হার ২ শতাংশের নীচে নেমে আসে। সমগ্র দেশে খাদ্য সঙ্কট বাড়তে থাকে। এমনই এক খারাপ পরিস্থিতিতে ১৯৯৪ সালে ভারত সরকার 'গ্যাট' চুক্তিতে সই করে। এই চুক্তির অন্তর্গত হবার অর্থ দাঁড়াল দেশের কৃষিব্যবস্থা তথা গোটা অর্থনীতি দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির দখলে চলে গেল।

এই চুক্তির ফলে ভারতের কৃষিতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির নিয়ন্ত্রিত বীজ, কীটনাশক ও সারের অনুপ্রবেশ এক সামগ্রিক চেহারা নিল। HYV বীজ কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী ও বৃহৎ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার চাষীর পক্ষে বাধ্যতামূলক করে তুলেছিল তা আমরা আগে দেখেছি। এবার নতুন সংযোজন হলো ''টার্মিনেটর বীজ' যা একবারই মাত্র ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ কৃষক চাষ করে ফলাবে বন্ধ্যা বীজ যা থেকে পরের বার আর ফসল উত্পাদন করা যাবে না। এর ফলে কৃষকের উত্পাদন খরচ বিপুল পরিমাণে বেড়ে যেতে লাগলো, আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ফলে ফেঁপে উঠতে লাগলো। বহুজাতিক সংস্থাগুলি যাতে তাদের ব্যবসার পক্ষে অনুকূল এইসব নানান জাতের বীজের আইনসিদ্ধ ব্যবসা ভারতের বুকে ফাঁদতে পারে তার জন্য ২০০৪ সালে ভারত সরকার সংসদে নিয়ে এল ''সীড বিল ২০০৪''।

এইভাবে গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক থেকে এক ''নতুন সবুজ বিপ্লব''-এর সূচনা করা হলো যার মূল বৈশিষ্ট্য হলো রসায়নাগারে জিন প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত ''জি এম বীজ''-এর ব্যবহার সারা দেশ জুড়ে ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে দেওয়া। তাতে সারা দেশব্যাপী বীজের আনুষঙ্গিক সার, কীটনাশক, সেচের জল, ট্র্যাক্টর-পাম্পসেট ইত্যাদির ব্যবহার ছড়িয়ে পড়বে এবং সাম্রাজ্যবাদ-বৃহত্পুঁজির বাজার হু হু করে বেড়ে উঠবে। লক্ষণীয় যে এই ''নতুন সবুজ বিপ্লব'' পুরনো সবুজ বিপ্লবের মতো নির্দিষ্ট এলাকা বেছে সংহত করা হয় নি। দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির হিসাবে ''যথাযথ'' ভাবে ''নতুন সবুজ বিপ্লব''-এর এলাকা সৃষ্টি করতে যে অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে বা তার জন্য কৃষি ব্যবস্থায় যে আমূল সংস্কার সাধন করতে হবে তার থেকে অনেক সহজে পণ্যের বাজার বাড়িয়ে নেওয়া যায় যদি অপরিকল্পিত ও বিক্ষিপ্তভাবে গোটা দেশ জুড়ে সার, বীজ, কীটনাশক, ট্র্যাক্টর আর পাম্পসেটের ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়া যায়। বিগত দু দশক ধরে এই প্রক্রিয়াই চলছে। এসময় থেকেই ভারতের কৃষি-ক্ষেত্রে উত্পাদিকা শক্তির একটি ধারাবাহিক বিকাশ ঘটছে এবং কৃষিতে পুঁজির ভূমিকাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

একেবারে সাম্প্রতিকতম তথ্য না পাওয়া গেলেও বিগত কয়েকটি দশকের যেটুকু হিসাব পাওয়া যায় তাতে কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগের ধারাবাহিক বৃদ্ধি স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে এই প্রবণতা আজও বিদ্যমান। ২০০৪ সাল পর্যন্ত হিসাবে দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে যত ট্র্যাক্টর আছে তাতে ট্র্যাক্টর পিছু জমির পরিমাণ ১১৯ হেক্টর, যা কিনা একটি ট্র্যাক্টর দিয়ে ১ মাসে চাষ করে ফেলা যায়। ১৯৯৯-২০০০ সাল থেকে ২০০৩-২০০৪ সালে ভারতে ট্র্যাক্টর বিক্রি হয়েছে ১১,৮৮,৭৩৫টি। ঐ একই সময়ে পর্বে পাওয়ার টিলার বিক্রি হয়েছে ৭৫,৫৬৬টি। ১৯৮২-৮৩ তে যেখানে কৃষিতে বিদ্যুতশক্তির ব্যবহার হয়েছিল ১৭৪১৭ মিলিয়ন কিলো ওয়াট ঘন্টা, সেখানে ১৯৯৮-৯৯তে হয়েছিল ৯৭,১৭৫ ঘন্টা, ২০০১-২০০২-এ তা একটু কমে হয়েছিল ৮১,৬৭৩ ঘন্টা যা দেশে মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রায় ৩০ শতাংশ। নাইট্রোজেন-ফসফেট-পটাশিয়াম সারের ব্যবহারে বৃদ্ধির মাত্রা আরও চমকপ্রদ। ১৯৫১-৫২ তে ৬৫ হাজার টন, ১৯৮২-৮৩ তে ৬,৩৮৮.৩ হাজার টন এবং ২০০২-০৩-এ ১৬,০৯৪ হাজার টন। অর্থাৎ ১৯৫১-৫২-র তুলনায় ২০০২-০৩-এ বৃদ্ধির পরিমাণ ২৪৫.৬ গুণ। কীটনাশক বিষের ব্যবহার ১৯৬০ সালে ছিল ২০০০ টন, যেটা ১৯৯৩-৯৪ তে হয়েছে ৯০,০০০ টন। HYV বীজ ব্যবহার হয় এমন জমির পরিমাণ ১৯৯৩-৯৪ সালে ধানের ক্ষেত্রে ছিল ৭০% এবং গমের ক্ষেত্রে ১৯৯২-৯৩ তেই ছিল ৯০.৮%। ১৯৫০-৫১ সালে মোট কর্ষিত জমি ছিল ১১৮.৭৫ মিলিয়ন হেক্টর, যার মধ্যে সেচ-সেবিত জমি ছিল ২২.৫৬ মিলিয়ন হেক্টর, আর ২০০০-২০০১ সালে মোট কর্ষিত ১৪১.১০ মিলিয়ন হেক্টর জমির মধ্যে ৭৫.১৪ মিলিয়ন হেক্টর জমি ছিল সেচ-সেবিত। এ প্রসঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের বৃদ্ধির পরিমাণটিও উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৯৭-৯৮-তে এই ঋণের (সমবায় ব্যাঙ্ক, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ও বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক সম্মিলিতভাবে) পরিমাণ ছিল ৩১,৯৫৬ কোটি টাকা যা ২০০৩-২০০৪-এ বেড়ে হয়েছে ৮০,০০০ কোটি টাকা।

কৃষিতে পুঁজির বিনিয়োগের বৃদ্ধির সাথে সাথে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন গ্রামীণ জীবনে বেড়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর ঋণগ্রস্ততা। ২০০৩-এর সংগৃহীত তথ্য থেকে দেখা যায় ঐ সময়ে ভারতে গ্রামীণ পরিবারের সংখ্যা ছিল ১৪.৭৯ কোটি, তার মধ্যে ৮.৯৪ কোটি (৬০.৪%) পরিবারই ছিল কৃষির সঙ্গে যুক্ত। এই ৮.৯৪ কোটি পরিবারের মধ্যে ৪.৩৪ কোটি (৪৮.৬%) পরিবারই ছিল ঋণগ্রস্ত। এক হেক্টর বা তার কম জমির মালিকের পরিবারের সংখ্যা ছিল মোট জমির মালিক পরিবারের ৬৬ শতাংশ। এদের মধ্যে ৪৫ শতাংশই ঋণগ্রস্ত। এই ভয়ংকর ঋণগ্রস্ততা সাবেকী মহাজনী ঋণের থেকে একেবারেই আলাদা। কৃষিক্ষেত্রে বিশ্বায়িত পুঁজির দাপটে এই ঋণ কৃষককে নিঃস্বে পরিণত করেছে। এই ঋণ মূলত নেওয়া হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির কাছ থেকে বীজ-সার-কীটনাশক কিনতে। তাই পরিবার পিছু ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও কেরলে। উল্লেখযোগ্য এই পর্বে ব্যক্তিগত সুদখোরদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ প্রভূত পরিমাণে কমেছে। ২০০৩-এর হিসাব অনুযায়ী মোট ঋণের মাত্র ২৬ শতাংশ সুদখোরদের কাছ থেকে নেওয়া। গত ২০ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ঋণগ্রস্ত কৃষক পরিবারগুলির শতাংশের হিসেবে প্রথম কয়েকটি রাজ্য হলো— অন্ধ্রপ্রদেশ ৮২%, তামিলনাড়ু ৭৪.৫%, পাঞ্জাব ৬৫.৪%, কেরালা ৬৪.৪%, কর্ণাটক ৬১.৬%, মহারাষ্ট্র ৫৪.৮%। এছাড়া ৫০% – ৫৩% ঋণগ্রস্ত পরিবার পাওয়া যায় হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে। ঋণগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যার বিচারে অনেক পিছনে রয়েছে বিহার (৩৩%), ওড়িশা (৪৭.৮%), ঝাড়খণ্ড (২০.৯%), ও ছত্তিসগড় (৪০.২%)।

সাম্রাজ্যবাদ-বৃহত্পুঁজি নিয়ন্ত্রিত নতুন কৃষি প্রকরণের সঙ্গে এই ঋণগ্রস্ততা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এই ঋণের ফাঁদ সবুজ বিপ্লব এলাকার কিছু কিছু সম্পন্ন কৃষক থেকে শুরু করে মাঝারি ও ছোট জোতের মালিক মধ্য ও ক্ষুদ্র কৃষককেও বিপন্ন করে তুলেছে। ব্যাপকভাবে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ কৃষিপণ্যের বাণিজ্যে উদারীকরণের জন্য কৃষিপণ্যের বিক্রয়মূল্যর উপর গুরুতর আঘাত নেমেছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা উচ্চভর্তুকিপ্রাপ্ত কৃষিপণ্যে বাজার ছেয়ে যাচ্ছে। কৃষিপণ্যের আমদানি শুল্কর উপর থেকে ''পরিমাণগত বাধা'' তুলে নেবার ফলে কৃষিজাত পণ্যের আমদানি হু হু করে বাড়ছে এবং আচমকাই কৃষিপণ্যের দাম পড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া কৃষি বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয়ে রোগ পোকার সর্বনাশা আক্রমণে, কখনও খারাপ বীজের কারণে, কখনও পর্যাপ্ত জলের অভাবে কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। ফলে চাষের জন্য নেওয়া ঋণ শোধ করতে না পেরে হাজারে হাজারে কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। যারা বেঁচে থাকছে তারা আবার নতুন ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র জোতের কৃষকদের উপর ঋণের বোঝা আরও মর্মান্তিক। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই খারাপ থাকে যে তাদের ক্ষুদ্র জোতে অনেক বেশি ফলন করতে না পারলে তাদের অস্তিত্বই সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। তাই তারা চেষ্টা করে অনেক বেশি পরিমাণে বাহ্যিক উপকরণ এবং নিজেদের শ্রম ও মনোযোগ ব্যবহার করে নিবিড় চাষের সাহায্যে উত্পাদন বাড়িয়ে নিতে। ক্ষুদ্র জোতে যে তুলনামূলকভাবে বেশি উত্পাদনশীলতা লক্ষ্য করা যায় এটিই তার কারণ। কিন্তু যেহেতু ক্ষুদ্র চাষী প্রয়োজনীয় পুঁজি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংগ্রহ করতে পারে না তাই তাকে ধারে সার-বীজ-কীটনাশক ইত্যাদি কিনতে হয়। ট্র্যাক্টর-পাম্প ইত্যাদিও ধারে ব্যবহার করতে হয়। উত্পন্ন ফসল বিক্রি করে তাকে ধার শোধ করতে হয়। উপকরণ কেনার সময় তাকে বেশি দামে কিনতে হয় (ধারে কেনে বলে), আবার ফসল ওঠার পরে পরেই যখন দাম কম থাকে তখন বিক্রি করতে হয়। ক্ষুদ্র কৃষক প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ তুলনায় কম পায় বলে ব্যবসায়ীর কাছে ধার রাখতে বেশি বাধ্য হয়। এতে একদিকে যেমন বৃহৎ পুঁজির পক্ষে যাবতীয় কৃষি-উপকরণের বাজার নিশ্চিত হয়, অন্য দিকে তার স্থানীয় দালাল কৃষি উপকরণের ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিক লাভের উপরেও কিছু বাড়তি উদ্বৃত্ত লাভ করে। খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে উত্পাদনের জন্য যারা ধারে উপকরণ দেয় তারা প্রাক-পুঁজিবাদী মহাজন নয়। ''সবুজ বিপ্লব'', পুঁজিনিবিড় চাষ, কৃষি-বাস্তুতন্ত্রে বিপর্যয়— ইত্যাদি হচ্ছে এদের ব্যবসার জন্ম ও বিকাশের পিছনে ক্রিয়াশীল কারণ। এরা ঋণী কৃষককে আবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে কম মজুরিতে কাজ করিয়ে নেয় এমন ঘটনাও প্রায় চোখে পড়ে না। তাই এই ঋণদাতারা কোন অর্থেই সাবেকী মহাজন নয়। বরং এদের বলা যায় সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সাম্রাজ্যবাদী ও বৃহৎ পুঁজির স্থানীয় এজেন্ট। সেই জন্য এই ঋণগ্রস্ততাকে সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন সম্পর্কের নজির হিসেবে দেখার কোন উপায় নেই।

কৃষির এই সঙ্কট জোতের বিন্যাসেও গুরুতর সব পরিবর্তন আনে। কৃষিতে ''সবুজ বিপ্লব'' যা পরবর্তীকালে ৯০-এর দশকের ''নতুন সবুজ বিপ্লব'', কৃষিব্যবস্থার সার্বিক সংস্কার বা উন্নয়নের কোনো ধরনের পরিকল্পনাই গ্রহণ করলো না। 'সবুজ বিপ্লব' প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগের সম্ভাবনা খারিজ করে ভারত সরকার গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে এসে নির্বিচারে সারা দেশ জুড়ে বহুজাতিকদের পণ্য বীজ-সার-কীটনাশক প্রয়োগ করার পলিসি গ্রহণ করে। ফলে বাছাই করা কয়েকটি ক্ষেত্রে 'চুক্তি চাষ' ইত্যাদির মাধ্যমে লাভজনক ফসলের বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে সার্বিক অর্থে কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগের প্রবণতা নাকচ হয়ে যায়। তার বদলে লাভজনক বিনিয়োগ শুরু হলো কৃষি উপকরণের বাণিজ্যে। এতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির শিল্প পুঁজি ও বাণিজ্যিক পুঁজির মুনাফা নিশ্চিত থেকেছে। আর কৃষি উত্পাদনের সমস্ত ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা, বিপর্যয় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মূলতঃ প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের উপর, কিছুটা মাঝারি-কৃষকদের উপর। জমির খণ্ডীভবনই প্রধানতঃ ভারতীয় কৃষিজোতের মূল বৈশিষ্ট্য। এই খণ্ডীভবনের চরিত্রটি অনুধাবন করা ভারতীয় কৃষির পর্যালোচনায় সবিশেষ গুরুত্ব সহকারে উপস্থিত হয়েছে। আগের আলোচনায় আমরা দেখেছি প্রান্তিক-ক্ষুদ্র-মাঝারি জোতের কৃষকরা যে সঙ্কট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে চাষ করে তাতে যতই পুঁজি তারা কৃষিতে বিনিয়োগ করুক না কেন তারা উদ্বৃত্ত অর্জন করতে পারে না। ফলে জমির পুঁজিবাদী কেন্দ্রীভবন এখানে অনুপস্থিত। আবার বিপরীত পক্ষে এই খণ্ডীভবন সামন্ততান্ত্রিক জমিদারতন্ত্রের বিলোপেরও সূচনা করে। এটা স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় ২০০২-০৩ সালে বৃহৎ জমির মালিকদের (সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী উভয়ে মিলিতভাবে) দখলে আছে মোট জমির মাত্র ১৩.১ শতাংশ। ১৯৫৩-৫৪ সালে প্রান্তিক চাষির সংখ্যা ছিল মোট চাষির ৩৮ শতাংশ। ২০০২-০৩-এ এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশ। ১৯৫৩-৫৪ সালে প্রান্তিক ও ছোটচাষির মোট জমির মধ্যে মালিকানা ছিল ১৬.৩ শতাংশ। ২০০২-০৩ সালে এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩.৫ শতাংশ। ভারতের ২৭টি রাজ্যের মধ্যে ১২টিতে প্রান্তিক ও ছোট চাষির জমির পরিমাণ মোট জমির ৯০ শতাংশ। ১৭টি রাজ্যে তারা ৫০ শতাংশ জমির মালিক। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এটা স্পষ্টই বলা যায় যে এই বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মধ্য কৃষকদের সামনে মূল শোষক হিসেবে হাজির হয়েছে সার-বীজ-কীটনাশক সহ কৃষিপ্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণকারী ও মালিক দেশি-বিদেশি বহুজাতিক গোষ্ঠীগুলি। এর সঙ্গে সহযোগী শক্তি হিসেবে রয়েছে আঞ্চলিক ব্যবসাদার, ঋণদাতা বিভিন্ন সংস্থা, এই নতুন কৃষিনীতির সমর্থক ও মদতদাতা বড় জমির মালিক, আঞ্চলিক পুঁজিপতি শ্রেণী ইত্যাদি। এই বিশেষ পরিস্থিতিটি সৃষ্টি হয়েছে গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক থেকে, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন যখন ভারতের কৃষি-ব্যবস্থাকে প্রধানত তার নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছে, ভূমি সংস্কারের প্রশ্নটি যখন ভারতীয় কৃষির সামনে তার কেন্দ্রীয় সমস্যা নয়, যখন সামন্ততান্ত্রিক শোষণ নানাভাবে টিকে থাকলেও তা সহযোগী দ্বন্দ্ব হিসেবে কৃষকের সঙ্গে নানা ধরনের সংঘাত তৈরি করেছে। এই সময় থেকেই আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদীদের উপর নির্ভরশীল ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণীর সাথে কৃষি মজুর, প্রান্তিক ও ছোট চাষির দ্বন্দ্ব মূল সমস্যা হিসাবে ভারতের কৃষিব্যবস্থায় উপস্থিত হয়েছে। মধ্য কৃষকের সঙ্গেও ঐ শক্তিজোটের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, যদিও তা অন্যদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের মত অত তীব্র নয়।

জোতের মাত্রা ও পরিমাণের উপর এই দ্বন্দ্বের মাত্রা অনেকটা নির্ভর করছে। অর্জুন সেনগুপ্তর রিপোর্ট অনুসারে ২০০৩ সালের কৃষির অবস্থা থেকে দেখা যায় ০.০১ হেক্টরের কম জমির মালিক থেকে শুরু করে ২ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিকদের মাসিক আয় থেকে মাসিক ব্যয় অনেক বেশি। ২ হেক্টর থেকে ৪ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিকদের মাসিক আয় থেকে মাসিক ব্যয় সামান্য বেশি, ৪ থেকে ১০ হেক্টর এবং তার থেকে বেশি জমির মালিকরা কৃষি থেকে সঞ্চয় করতে পারে। এই হিসাব থেকে পরিষ্কার হচ্ছে যে ২ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিকেরা তীব্র সঙ্কটের শিকার। ৪ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিকেরা ক্রমশই সঙ্কটের মুখোমুখি হচ্ছে এবং বর্তমানের বিপজ্জনক কৃষি-প্রযুক্তি তাদের অস্তিত্বকে দ্রুত বিপন্ন করে তুলছে। তাই কৃষকদের এই সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বর্তমান কৃষি-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সামিল হতে পারে। আবার ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে 'সবুজ বিপ্লব'-এর অঞ্চলগুলিতে উত্পাদনশীলতা ও মোট উত্পাদনের পরিমাণ কার্যত স্থগিত হয়ে গেছে। ২০০৪ সালে পাঞ্জাবে মোট ফলন এবং কৃষির উত্পাদনশীলতা দুই-ই ২০০১, ২০০২, ২০০৩ সালের থেকে কমে গিয়েছিল। এখানকার সঙ্কটের চেহারা অন্যান্য কৃষি-অঞ্চল থেকে ভিন্ন। এখানে প্রান্তিক ও ছোট চাষির সংখ্যা ভীষণভাবে কমে গেছে। ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি এবং ধনী চাষিরা প্রধানতঃ বৃহৎ একচেটিয়া বহুজাতিক গোষ্ঠীগুলির পুঁজি ও প্রযুক্তির আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে। এখানে কৃষি মজুরদের প্রলেতারিয়েত চরিত্র অনেক স্পষ্ট।

ভারতে আমূল ভূমি সংস্কার কখনই হয় নি। তাই দেশি বিদেশি বৃহৎ পুঁজি ভারতের কৃষি-ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রধান নিয়ন্তাশক্তি হলেও সামন্ততন্ত্র গ্রামীণ ভারতে, বিশেষত পশ্চাদপদ এলাকাগুলিতে নানাভাবে টিকে রয়েছে। এই অঞ্চলগুলিতে কৃষি অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হিসেবে এখনও দেখা যায় বাঁধা মজুর, সুদখোর মহাজন, উত্পাদিত কৃষি-পণ্যের আঞ্চলিক ভোগ, উদ্বৃত্ত বা মুনাফা উত্পাদনে বা ব্যবসায়ে পুনর্বিনিয়োগ না হওয়া। এই ধরনের অঞ্চলগুলিতে সামন্ততন্ত্রের অচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে জাতপাত ব্যবস্থাও অর্থনৈতিক ভিত্তির অঙ্গ হিসেবে টিকে আছে। আজকের ভারতে বেশিরভাগ জায়গাতেই জাতপাতের প্রভাব উপরিকাঠামোর উপাদান হিসেবে রয়ে গেছে। সে সব জায়গায় সামাজিক স্তরে শোষণ-জুলুম নিপীড়িত জাতের লোকেদের উপর সমানে চলছে। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যটিকে অর্থনীতিতে জাত-ব্যবস্থার সূচক হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। অনেক জায়গায় আবার সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী উপাদান একই সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। যেমন কৃষি উত্পাদন ব্যবস্থার পুঁজিবাদী বাজার ও পুঁজিবাদী উত্পাদন পদ্ধতির সঙ্গে বহু সামন্ততান্ত্রিক রীতি পদ্ধতিও যুক্ত হয়ে থাকে। তবে কোন একটি অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থার মূল চরিত্র নির্ধারণ করতে গেলে শ্রমশক্তি ক্রয়-বিক্রয়ের চরিত্র, কৃষিপণ্য ও উত্পাদনের উপকরণের ক্রয় বিক্রয় ও ব্যবহারের চরিত্র এবং কৃষির উদ্বৃত্তের ব্যবহার এবং তার সাথে পুঁজিবাদী বাজারের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়গুলি বিবেচনা করতে হয়। এই প্রসঙ্গে যেটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হলো কৃষি ক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত যদি কৃষিতে পুনর্বিনিয়োগ না হয়ে অন্য কোন ব্যবসায়ে বা শিল্পে বিনিয়োগ হয়, তবে তাকেও পুঁজিবাদী উত্পাদনের সূচক হিসেবে দেখতে হবে। বর্তমান ভারতের কৃষি-ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিশেষ মনোযোগী দাবী করে। কারণ এই বৈশিষ্ট্যটি ভারতের বৃহৎ জোতের মালিকদের ক্ষেত্রে খুব বেশি পরিমাণে দেখা যায়। কৃষিতে বিনিয়োগ যথেষ্ট লাভজনক না হওয়ায় এদের মধ্যে কৃষির উপকরণের ব্যবসা, কোল্ড স্টোর, রাইস মিল বা কৃষির সঙ্গে যুক্ত নয় এমন নানা ধরনের ব্যবসায়ে বা শিল্পে বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে। এদের মধ্যে অনেকেই পুরনো আমলের জোতদারদের বংশধর, কৃষকদের শোষণ করা টাকা এখন ব্যবসায়ে ঢালছে। বর্তমানে পুঁজিবাদী ব্যবসায়ই এদের আয়ের প্রধান উত্স বলে এখন আর এদের সামন্ততান্ত্রিক জোতদার বলা যাবে না।

২০০৪-০৫ সালের NSSO-র ৬১তম রাউন্ডের এবং ঐ একই সময়ে সরকার দ্বারা নিযুক্ত অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশনের রিপোর্টের নির্যাস উপস্থাপিত করে আজকের ভারতের মেহনতি মানুষের (শ্রমিক ও কৃষক) কর্মে নিযুক্তির একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবো। অত্যন্ত নির্মোহভাবে এ চিত্র বিচার করেই কেবল ভারতের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে একটি বস্তুনিষ্ঠ সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব।

২০০৪-০৫ সালে, ভারতের জনসংখ্যা ছিল ১১১ কোটি। এর মধ্যে কাজে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা (সমস্ত ধরনের কাজ) ছিল ৪৫.৫৭ কোটি। তার মধ্যে শিল্প ও পরিষেবায় নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা ১৯ কোটি। এর মধ্যে পুঁজিপতিদের সেবায় নিযুক্ত ম্যানেজমেন্টের লোক যদি সর্বাধিক ১ কোটিও ধরা হয়, তবুও দেখা যাচ্ছে এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রটিতে ১৮ কোটি মানুষ সর্বহারা-আধা সর্বহারা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাবে NSSO-র দেওয়া। পাঠকদের বিচারের জন্য আমরা ওই একই সময়ে অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশনের দেওয়া তথ্যও জুড়ে দিচ্ছি: কাজে সক্ষম এমন মানুষের সংখ্যা ৪২.৯৮ কোটি। কাজে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা ৪০.১২ কোটি। বেকার ২.৮৭ কোটি। শিল্পে নিযুক্ত ৭.৮ কোটি, তার মধ্যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত (formal) শ্রমিকের সংখ্যা ২.৩২ কোটি, অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিকের সংখ্যা (informal) ৫.৪৮ কোটি। পরিষেবায় মোট নিযুক্তি ১১ কোটি, তার মধ্যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৩.০৪ কোটি। অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৭.৯৬ কোটি। কমিশনের ব্যাখ্যায় উপরোক্ত হিসাবে অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত ও অসংগঠিত (unorganised) একসঙ্গে ধরা হয়েছে।

NSSO এর পর ২০০৪-০৫ সালে ভারতে কর্মে নিযুক্তির আর একটু বিস্তারিত হিসেব দিচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে ৪৫.৫৭ কোটি কর্মে নিযুক্ত মানুষের মধ্যে অসংগঠিত /অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রের মোট নিযুক্তি ৩৯.৩২ কোটি। তার মধ্যে কৃষিতে নিযুক্ত ২৫.১৭ কোটি এবং অকৃষি ক্ষেত্রে নিযুক্তি ১৪.১৫ কোটি। সমগ্র অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রের মধ্যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কর্মী হলেন মাত্র ১৪ লাখ (শতকরা ০৪ জন) যারা নিয়মিত বেতন এবং পি এফ ইত্যাদি সামাজিক সুরক্ষা পান। আর অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রের অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত কর্মী হলেন ৩৯ কোটি ১৮ লক্ষ যা হচ্ছে শতকরা ৯৯.৬ জন। এই বিশাল অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রের মধ্যে ধরা আছে ৮.৭ কোটি কৃষি-মজুর সহ মেহনতি কৃষক জনতার সমগ্র অংশ। NSSO-র দেওয়া তথ্য অনুসারে আনুষ্ঠানিক/সংগঠিত ক্ষেত্রের মোট নিযুক্তি ৬.২৬ কোটি। এর মধ্যে অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত কর্মী হলেন (যেমন বড় কারখানার ঠিকা শ্রমিক) ২.৮৯ কোটি (৪৬.২%) এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিক হচ্ছেন ৩.৩৭ কোটি (৫৩.৮%)।

NSSO এবং অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশনের রিপোর্টে কৃষিতে নিয়োগের পরিস্থিতি কী তা একবার দেখা যাক। জমির মাপ অনুসারে কৃষকদের পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়। ১ হেক্টর পর্যন্ত জমি আছে এমন কৃষকদের প্রান্তিক চাষি (marginal) বলা হয়। ১.১ হেক্টর থেকে ২ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিককে বলা হয় ছোট চাষি। ২.১ থেকে ৪ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিকরা হলো আধা-মাঝারি চাষি (semi-medium)। ৪.১ থেকে ১০ হেক্টর জমির মালিক মাঝারি চাষি (medium) আর ১০ হেক্টরের উপরে যাদের জমি আছে তাদের বলা হয় বড় (large) চাষী। NSSO-র হিসাব মত কর্মে নিযুক্ত মোট মানুষের মধ্যে ৫৬.৫৬% নিযুক্ত রয়েছে কৃষিতে। কৃষিতে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা স্থির গতিতে কমছে কয়েক দশক ধরে। ১৯৭২-৭৩-এ ছিল ৭৩.৯%, ১৯৯৩-৯৪ তে ছিল ৬৩.৯%, ২০০৪-০৫ হয়েছে ৫৬.৫%। লক্ষণীয় ১৯৭৩-৭৪ তে ছিল ৬৩.৯%, ২০০৪-০৫ হয়েছে ৫৬.৫%। লক্ষণীয় ১৯৭৩-৭৪-এ জি ডি পি-র ৪৪.১% ছিল কৃষি-জাত উত্পাদন যা ২০০৪-০৫-এ কমে হয়েছে ২০.৫%। নারীদের ক্ষেত্রে ১৯৭৭-৭৮-এ প্রতি ১০০০ গ্রামীণ নারীর মধ্যে কৃষিতে যুক্ত ছিল ৮৬৮ জন, ১৯৯৩-৯৪ তে ৮৪৭ জন, ২০০৪-০৫-এ ৮১৪ জন। শহরের নারীদের ক্ষেত্রে সংখ্যার এই হ্রাস আরও তীব্র: ১৯৭৭-৭৮-এ ২৫১ জন, ১৯৯৩-৯৪-এ ১৯৩ জন এবং ২০০৪-০৫-এ ১৪৭ জন। গ্রামীণ পুরুষদের কৃষিতে নিযুক্তি ছিল ১৯৭৭-৭৮-এ ৮০৪ জন, ১৯৯৩-৯৪ তে ৭৩৭ জন ও ২০০৪-০৫-এ ছিল ৬৬২ জন। শহুরে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হ্রাস প্রাপ্তি নিম্নরূপ। ১৯৭৭-৭৮-এ ১০২ জন, ১৯৯৩-৯৪ তে ৮৭ জন, ২০০৪-০৫-এ ৬০ জন। ১৯৯৩-৯৪ থেকে ২০০৪-০৫-এর সময় পর্বে গ্রামীণ পুরুষের কৃষিতে অংশগ্রহণ ৭৩.৭% থেকে ৬৬.২% এ নেমে এসেছে। অর্থাৎ বছরে গড়ে .৬৮% কমেছে। শহরে এই হ্রাস ২.৪৫%। নারীদের ক্ষেত্রে এই হ্রাস তুলনায় কম হলেও সব ক্ষেত্রেই ১৯৭৭-৭৮ থেকে ২০০৪-০৫-এর পর্বে কৃষি কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাবার গতি অনেক বেশি। NSSO-এর আর একটি হিসাবে দেখাচ্ছে অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিকদের মোট সংখ্যার মধ্যে অকৃষি-ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংখ্যা ১৯৯৯-২০০০-এ ছিল ৩২%, যা ২০০৪-০৫-এ বেড়ে হয়েছে ৩৬%, অর্থাৎ ৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিকদের মধ্যে কৃষিতে নিযুক্তি ঐ ৪%-ই কমেছে। দেখা যাচ্ছে কয়েক দশক ধরেই কৃষি ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার নিযুক্তিই স্থির গতিতে কমেছে। তার অর্থ এই নয় যে কৃষিক্ষেত্রে কাজ হারানো মানুষেরা শহরের সংগঠিত ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিল্পক্ষেত্রে কাজ পেয়ে যাচ্ছে। এই মানুষেরা শহর ও গ্রামের এক বিপুল অসংগঠিত ও অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রে যোগদান করছে যারা সৃষ্টি করছে সর্বহারা ও আধা-সর্বহারাদের বিশাল এক বাহিনী। এদের মধ্যে আছে ভ্যান রিক্সা বা অটো চালক, চায়ের দোকান, রেস্টুরেন্টের কর্মচারী, হকার, বাড়ির পরিচারক পরিচারিকা, ছোট ছোট ম্যানফ্যাকচারিং ইউনিটের শ্রমিক। ভারতের শ্রমিকশ্রেণীকে তার সংখ্যা ও শক্তির বিচারে ঠিক মতো বুঝতে এই বিশেষ ক্ষেত্রটি আমাদের মনোযোগ দাবি করে।

এবার আলাদা করে শুধু কৃষকদের হিসাবে আসা যাক। বৃহৎ চাষিদের (১০ হেক্টর-এর বেশি) সংখ্যা মোট চাষীদের ০.৯%। এরা মোট কৃষি জমির ১৩.১% জমিতে চাষ পরিচালনা করে। মাঝারি চাষিরা (৪.১ থেকে ১০ হেক্টর) মোট চাষিদের ৬%। এই দুটি অংশ মিলিতভাবে মোট জমির ১/৩ অংশ চাষ করে। লক্ষণীয় বৃহৎ চাষিরা তো বটেই এমনকি বৃহৎ ও মাঝারি চাষি মিলিত হয়েও মোট কৃষিযোগ্য জমির মধ্যে খুব অল্প জমিতেই ভৌমিক অধিকার ভোগ করছে। কিন্তু এই দুটি গোষ্ঠীই কৃষি থেকে সঞ্চয় করে। ২ থেকে ৪ হেক্টর জমির মালিক মধ্যমাঝারি কৃষকেরা সরকারি তথ্য অনুযায়ী কৃষি থেকে পাওয়া উপার্জন থেকে কিছুই সঞ্চয় করতে পারে না। বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায় এরাও গভীর সঙ্কটে জড়িয়ে পড়ছে, এর নীচে যে বিপুল সংখ্যক ছোট ও প্রান্তিক চাষিরা রয়েছে তাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আধা মাঝারি কৃষকের সংখ্যা ২.৩০ কোটি এবং তারা মোট কৃষকদের ১৩ শতাংশ। এর পরে আছে ১ থেকে ২ হেক্টর জমির মালিক ছোট কৃষক যাদের সংখ্যা ১.৬৫ কোটি এবং মোট কৃষকদের মধ্যে ১০ শতাংশ। প্রান্তিক কৃষককূল, যাদের জমির পরিমাণ ১ হেক্টরের কম, তারা মোট কৃষকের ৭০ শতাংশ। প্রান্তিক ও ছোট চাষীরা মিলিতভাবে মোট চাষীর ৮০ শতাংশ এবং এরা মোট চাষ হওয়া জোতের সংখ্যার ৮০ শতাংশ চাষ করে। লক্ষণীয় ১৯৬০-৬১ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৬১%। দেশে গ্রামীণ কর্মনিযুক্তির যে সামগ্রিক চিত্রটি পাওয়া যাচ্ছে তাতে খেয়াল করার মতো বিষয় হচ্ছে মোট কৃষকের মধ্যে প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা অত্যধিক গতিতে বেড়ে চলেছে। প্রান্তিক চাষির মধ্যে ক্ষেতমজুরদেরও ধরা আছে। সরকারি নথিতে প্রান্তিক চাষি, ছোট চাষি এবং ক্ষেতমজুরদের মিলিয়ে কৃষি-কর্মী (agricultural worker) বলে একটি বর্গ করা হয়েছে। ২০০১ এর জনগণনায় ১৯৭১ থেকে ২০০১ এর মধ্যে কৃষি কর্মীদের মধ্যে ক্ষেতমজুরদের অংশ ৩৭.৮% থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৫.৬%। ঐ পর্যায়ে (১৯৭১-২০০১) ক্ষেতমজুরদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৭৫ লক্ষ থেকে ১০ কোটি ৬৮ লক্ষ, বৃদ্ধির হার বছরে ২.৭৪%। একই সময়ে কৃষিকর্মীর বৃদ্ধির হার বছরে ২.০৭%। জনগণনা অনুযায়ী ২০০১-এই যদি ক্ষেতমজুরের সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি হয়ে থাকে তবে পরবর্তী দশ বছরে অর্থাৎ আজকের দিনে তার সংখ্যা কী ভীষণ বেড়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। (২০০৪-০৫-এর NSSO-র হিসাবে ক্ষেত মজুরের সংখ্যা ছিল ৮.৭ কোটি)। সরকারি হিসেবেই বলা হচ্ছে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে কৃষককে অন্তত ৪.০১ হেক্টর জমির মালিক হতে হবে। NSSO-র হিসাব মতো এই মাঝারি (৫.১%) ও বৃহৎ (০.৯) মিলিতভাবে মোট চাষীদের ৬%। এর অর্থ ৯৪% কৃষক বিভিন্ন মাত্রার প্রবল দারিদ্র্যে বাস করছে এবং দুবেলা পেট ভরে খেতে পাচ্ছে না। ২ থেকে ৪ হেক্টর জমির মালিক মধ্য মাঝারি কৃষকদের অংশটুকু বাদ দিয়ে যে অংশটি থাকে তার মধ্যে ভূমিহীন ক্ষেতমজুর যদি গ্রামীণ সর্বহারা হয় তবে কৃষকদের বাকী অংশটি অর্থাৎ ১ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিক প্রান্তিক চাষি ও ১ থেকে ২ হেক্টর জমির মালিক ছোট চাষিরা আধা-সর্বহারা বলে বিবেচিত হবে। এরা মোট কৃষক-কূলের ৮০ শতাংশ। শিল্প-পরিষেবায় নিযুক্ত ১৮ কোটি মানুষকে ধরে কর্মে নিযুক্ত মানুষের মধ্যে অ-কৃষি সর্বহারা, আধা সর্বহারা ও কৃষি সর্বহারা এবং আধা সর্বহারা অবস্থানে পড়ে থাকা মানুষের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৩৮ কোটির কাছাকাছি। এর সঙ্গে যদি আমরা সর্বহারার দৃঢ় মিত্র ছোট কৃষকের সংখ্যা ১.৬৫ কোটি ও দোদুল্যমান মিত্র আধা-মাঝারি কৃষকের সংখ্যা ২.৩০ কোটি যোগ করি তবে দেখা যাবে কর্মে নিযুক্ত ৪৫.৫৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৪১.৯৫ কোটি মানুষ বর্তমান সমাজব্যবস্থা দ্বারা শোষিত ও নির্যাতিত। এ প্রসঙ্গে আমাদের আর একবার খেয়াল করতে হবে যে পূর্বে উল্লেখিত পরিসংখ্যানগুলি ইতিমধ্যেই বেশ পুরনো হয়ে গেছে— ২০০৪-০৫ অথবা ২০০১ সালের। বিগত বছরগুলিতে পরিস্থিতি আরও সঙ্গিন হয়েছে, কারণ বিগত দশকগুলির পরিসংখ্যান দেখিয়েছে ভূমিহীন কৃষক প্রান্তিক ও ছোট কৃষক এবং অ-স্বীকৃতি প্রাপ্ত ক্ষেত্রের এক বিপুল সংখ্যক অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

ভারতীয় কৃষি-ব্যবস্থার বর্তমান চরিত্র

আমরা এই প্রবন্ধের শুরুতেই দেখাতে চেষ্টা করেছি ভারতে পুঁজির বিকাশ একেবারে উপনিবেশিক আমল থেকেই অন্যান্য উপনিবেশগুলির সাধারণ ছকের থেকে কিছুটা ভিন্ন ধারায় ঘটতে শুরু করেছিল। যার বহিঃপ্রকাশ ছিল অন্যান্য উপনিবেশগুলি থেকে এখানে পুঁজি বিকাশের মাত্রার আধিক্য। আমরা এটা দেখেছি যে এই আপেক্ষিক বিকাশ সমগ্র ব্রিটিশ শাসনের যুগে বেড়েই চলেছে যা দুটি সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের কালে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে এবং তার সুযোগ নিয়ে এই বৃদ্ধিতে উল্লম্ফন ঘটিয়েছে। ভারতীয় পুঁজির এই বাড়বাড়ন্ত গোটা ইংরাজ রাজত্বের কাল জুড়ে তার রাজনৈতিক ইতিহাসেও নানা তাত্পর্য নিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। এমন অনেক পর্যায় এসেছে যখন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ঠিক যে মাত্রায় ভারতীয় পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা তাদের ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব কায়েম রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল তা পারে নি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা কারণে পরিস্থিতি অনেক সময়ই তাদের হাতের বাইরে চলে গেছে। তাদের পক্ষে এরকমই একটি কঠিন সময়ে ইংরাজ শাসকেরা বাধ্য হয়েছিল বৃহৎ পুঁজিপতিদের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করতে। ১৯৪৭-এর পরেও ভারতীয় পুঁজির এই বিকাশের প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। একেবারে প্রথম বছরগুলিতে উদীয়মান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মার্কিনীদের সঙ্গে ক্ষয়িষ্ণু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব এবং তার ঠিক পরের বছরগুলিতে মার্কিনীদের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরিস্থিতি ভারতের বৃহৎ পুঁজিকে একটা আপেক্ষিক স্বাধীনতা ভোগ করার বাস্তব অবস্থা তৈরি করে দিয়েছিল। গত শতাব্দীর ৮০-র দশক থেকে শুরু হয় নতুন কাহিনী। ভারতের শাসক শ্রেণী দেশের অর্থনীতিতে উদারীকরণ নীতির সূত্রপাত ঘটায়। পরিকল্পনাটি মার্কিন পরিচালিত আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের। ঐ সময়কালে আন্তর্জাতিকভাবেই পুঁজিবাদ এক গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত হয়েছিল। ফলে নতুন বাজার দখল করার তাড়নায় উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বাজার খোঁজার ও নতুন নতুন ক্ষেত্রে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠলো। এই দেশগুলিতে বাধাহীন অনুপ্রবেশের জন্যই তৈরী হলো ''বিশ্বায়ন'' যাকে গোটা বিশ্বে জনপ্রিয় করায় ''বিশ্বায়নের'' পক্ষে এক উন্মাদনা সৃষ্টি করা হলো। ১৯৯১-এ ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বায়নের অংশীদার হয়ে ঘোষণা করলো 'নয়া আর্থিক নীতি'। এতে শুধু সাম্রাজ্যবাদই লাভবান হলো না। আমাদের দেশের বৃহৎ পুঁজি যা ইতিমধ্যেই মোটামুটি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল তারা বিদেশী পুঁজির সঙ্গে মৈত্রী করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বেড়ে উঠতে লাগল। দেশের ছোট-মাঝারি পুঁজিকে গিলে ফেলে একদিকে তারা দেশের বাজারে আধিপত্য করতে থাকলো, অন্যদিকে বিশ্বের বাজারেও তারা সক্ষম ও সম্ভাবনাময় প্রতিযোগী হিসেবে সফলভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করলো। তাদের বিকাশ ও বৃদ্ধির জোরেই ভারতে বৃদ্ধির হার অনেক সময় প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী দেশগুলির সঙ্গে তুলনীয়। এগুলি তথ্য, তাই এ সত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতেই হবে।

এ যদি সত্যের একটি দিক হয়, তবে অন্য দিকটিতেও আমাদের হিসাবে রাখতে হবে। তা আমরা রেখেছি এবং দেখিয়েছি কীভাবে একে ''বিকৃত পুঁজিবাদ'' হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। আমরা বলেছি ভারতীয় পুঁজির এই বিকাশ কোন সনাতনী ধরনের নয়। এ বিকাশ ভারতীয় সমাজের ও অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রয়োজন অনুসারে ঘটেনি, ঘটেছে সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া পুঁজির হাত ধরে। ভারতীয় বৃহৎ পুঁজির ইতিহাসটাই এই রকম। স্বাধীনতার আগে সে বেড়ে উঠেছে ব্রিটিশ পুঁজির ছায়ায়, পরবর্তী সময়ে সে বেড়ে উঠেছে বিদেশী পুঁজির হাত ধরে। বিশ্বায়ন পর্বে এ মৈত্রীবন্ধন আরও বেড়েছে। তাই এই বিকৃতি। কিন্তু এখানে যে প্রশ্নটির জবাব আমাদের দিতে হবে তা হলো ''বিকৃত পুঁজিবাদ'' কী মূলগতভাবে পুঁজিবাদ? যদি পুঁজিবাদ না হয় তবে কী? যদি এর মৌলিক চরিত্র পুঁজিবাদী হয় তবে অবশ্যই এর যাত্রা পথে অর্থনীতির সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি ক্ষয় পেতে থাকবে এবং অর্থনৈতিক ভিত্তিতে তা এমন দুর্বল হয়ে পড়বে যে রাষ্ট্রক্ষমতায় তার কোন প্রতিনিধি থাকবে না। সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি কি আমাদের দেশে মূলতঃ ক্ষয় পেয়েছে? আমাদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় কি সামন্ততন্ত্রের প্রতিনিধি নেই? যদি না থাকে তবে কি বৃহৎ পুঁজিপতিরা এককভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন? তবে কি ভারতকে একটি পুঁজিবাদী দেশই বলতে হবে? একটি আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশ কি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া পুঁজিবাদী দেশে পরিণত হতে পারে? যদি কেউ বলেন হয়, তবে কি তিনি আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশ সম্বন্ধে মাও সে তুঙের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করছেন না?

আমরা NSSO ৬১ রাউন্ড (২০০৪-০৫), অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশনের রিপোর্ট (২০০৪-০৫) এবং ২০০১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট থেকে ঐ সময় আমাদের দেশে শ্রমিক-কৃষকের কর্মনিযুক্তির পরিমাণগত ও গুণগত একটি সামগ্রিক চিত্র এবং তার সঙ্গে গ্রামীণ কৃষিজোতের বিন্যাস এবং তার সঙ্গে কৃষকদের সম্পর্কের একটি হিসাব পাই। আমাদের প্রশ্নগুলির অনেকটা উত্তরই সেখান থেকে পাওয়া যাবে। কিছু আবার নতুন করে আলোচনাও করতে হবে। ভারতের কৃষিতে পুঁজিবাদ বা সামন্ততন্ত্র কোনটি প্রাধান্যকারী অবস্থায় রয়েছে তার একটি বিচার দিয়ে আমরা প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করবো। প্রথমেই উত্পাদন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা যাক, কারণ অনেকেরই মতে একটি সমাজ ধনতান্ত্রিক না সামন্ততান্ত্রিক তার নির্ধারক মানদণ্ড হচ্ছে উত্পাদন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত শ্রম মূলতঃ অবাধ না সবাধ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমও যেহেতু পণ্য হয়ে ওঠে তাই অন্যান্য পণ্যের মতোই শ্রমও একটি পণ্য হিসাবে নির্দিষ্ট মূল্যে শ্রমের বাজারে ক্রয়-বিক্রয় হয়। সেখানে েক্রতা বিক্রেতাদের মধ্যে অবাধে শ্রম কেনাবেচা হয়। উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করার জন্য অর্থনীতি বহির্ভূত ক্ষমতা প্রয়োগের কোন অবকাশ থাকে না। বিপরীত পক্ষে সামন্ততান্ত্রিক সম্পত্তির মালিকেরা তাদের সামাজিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ব্যবহার করে, অর্থাৎ অর্থনীতি বহির্ভূত বলপ্রয়োগ করে উদ্বৃত্ত আহরণ করে। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশে বর্তমানে কোন ব্যবস্থাটি প্রাধান্যকারী অবস্থায় আছে? প্রথম কথা হলো শ্রম সবাধ না অবাধ-এ প্রশ্নটি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ওঠেই না কারণ শ্রমিক মানেই সে প্রধানতঃ পুঁজিবাদী উত্পাদন সম্পর্কের সাথে যুক্ত। তাই কোন একটি সমাজে কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা যত কমবে তত সেখানে অবাধ শ্রমের প্রচলন বাড়বে। আমরা ২০০৪-০৫ সালের পরিসংখ্যানেই দেখেছি কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা ৫৬.৫৬%। তার মধ্যে ক্ষেত মজুর অর্থাৎ গ্রামীণ সর্বহারার সংখ্যা ৮.৭ কোটি। প্রান্তিক ও ছোট চাষি যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্যের জমিতে মজুরি খাটতে বাধ্য হয় তারা সংখ্যার দিক থেকে সারা দেশের মোট চাষির ৮০%। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই বিপুল সংখ্যক সর্বহারা-আধা-সর্বহারার উপস্থিতি সবাধ শ্রমের বৈষয়িক ভিত্তিটিকে বহুলাংশে নষ্ট করে দেয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ক্ষেত মজুর বা প্রান্তিক চাষি হলেই তার দেওয়া শ্রম অবাধ হবে। তারা যদি কোনও জমির সঙ্গে বা নির্দিষ্ট কোন মালিকের সঙ্গে বাধা পড়ে থাকে তবে তার শ্রম নিশ্চয়ই অবাধ হবে না। তা হতে গেলে তাকে মচলেখাবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু আমরা সকলেই জানি আজকের ভারতে এই প্রথা একেবারেই বিরলদৃষ্ট। কৃষি-কাজ-ছেড়ে অন্য কাজে যাওয়ার ইচ্ছা বা উপায় না থাকাটা নিশ্চয় সবাধ শ্রমের লক্ষণ নয়, কারণ শ্রমিক বা চাকরীজীবীদের ক্ষেত্রেও এই অভিজ্ঞতা দেখা যায়। মাহিন্দার হিসেবে বাত্সরিক চুক্তি বা পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বিশেষ কাজের জন্য বাইরে যাওয়াটাও স্রেফ চুক্তিবদ্ধতার কারণে সবাধ শ্রমের সূচক নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও বিশেষত আজকের এই বিশ্বায়ন পর্বে শ্রমিকদের চুক্তিতে কাজ ভীষণরকম বেড়ে গেছে। চুক্তিতে কাজের ক্ষেত্রে শ্রম কতটা সবাধ বা অবাধ তা মালিকের সঙ্গে সম্পর্কের অন্য কিছু বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত হতে পারে। কিন্তু চুক্তিবদ্ধতা বা চুক্তির মেয়াদের উপর নির্ভর করে না। আমরা পরিসংখ্যানে দেখিয়েছি গ্রামের নিয়োগ স্থিরগতিতে কমেই চলেছে এবং যে বেকার বাহিনীর উদ্ভব হচ্ছে তারা গ্রামের বাইরে বিশেষত বড় বা ছোট শহরে অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রের অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। এই সর্বহারাকরণই এখনকার প্রধান প্রবণতা, সাথে সাথে অবাধ শ্রমেরও তাই।

পুঁজিবাদী উত্পাদন ব্যবস্থার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ উত্পাদিত পণ্য বাজারে যায় কিনা, বাজারে বিনিময়ের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত হাসিল হয় কিনা এবং এই প্রক্রিয়ায় উত্পাদনকারী মুনাফা অর্জন করে কিনা। উল্টো দিকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাজারের প্রচলন অত্যন্ত সীমিত থাকে, ভূসম্পত্তির মালিকেরা বাজারের মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করে, কৃষকেরা বাজারের বাইরে তাদের উত্পাদিত সামগ্রীর একটা অংশ বিনিময় করে তাদের সাংসারিক প্রয়োজন মেটায়, আর একটা অংশ, বিশেষত খাদ্যশস্য নিজেরাই ভোগ করে। আবার উত্পাদিত শস্যের একটা বড় অংশ তাকে রাখতে হয় পরের বছরে চাষের জন্য বীজ হিসেবে, ক্ষেত মজুরদের মজুরি হিসেবে, মালিককে দেয় ভাগ হিসেবে (payment in kind)। এক কথায় বাজারের প্রচলন এতই কম থাকে যে বাজারে বিনিময়ের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত হাসিলের ঘটনা সমাজে গৌণ স্থানে থাকে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট দেশে একটি নির্দিষ্টকালে বাজারের ভূমিকা কতটা তা নিয়ে বহুলাংশে নির্ণয় করা যায় সমাজবিকাশের স্তর।

আজকের সময়ে ভারতে বাজারের ভূমিকা কতটা তা একবার বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে বাজারে পাঠানোর মত উদ্বৃত্ত (marketed surplus) আজও তুলনামূলকভাবে বেশ কম। ২০০৪ সালে ভারত সরকারের একটি বাজারের জন্য উদ্বৃত্তের অনুপাত নির্ণয়ের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে দেখা যাচ্ছে ২০০২-০৩ সালে ধান ৪৩%, গম ৫১.৫%, ডাল ৭২.৪%, তৈলবীজ ৭৯.৬% উদ্বৃত্ত হিসেবে বাজার-জাত হয়েছিল। বাণিজ্যিক ফসলের ক্ষেত্রে এ অনুপাত অত্যন্ত বেশি, যেমন আখ এবং তুলার ক্ষেত্রে ৯৩%। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে HYV বীজ-কেন্দ্রিক যে নতুন কারিগরি ভারতের কৃষিতে আমদানি করা হলো তারপর থেকে কৃষিপণ্যের বাজার-জাত হবার প্রবণতা হঠাৎ করেই বাড়তে শুরু করেছিল, যার একটা উল্লম্ফন ঘটলো ''বিশ্বায়ন'' পরবর্তী ভারতীয় কৃষিব্যবস্থায়। বিশ্বায়িত পুঁজির মুনাফার এক মৃগয়া-ক্ষেত্র হিসেবে যে পরিমাণে ভারতীয় কৃষিকে নিশানা করা হলো, সে পরিমাণেই ভারতীয় কৃষির বাজার সম্প্রসারিত হলো হু হু করে। বীজ-সার-কীটনাশক-পাম্পসেট-ট্র্যাক্টর ইত্যাদি পুঁজিবাদী বিনিয়োগের বাজার উদ্দাম গতিতে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্পাদিত কৃষি-সামগ্রী বিক্রির বাজারও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে। বিশ্বায়নের ফলে যে পরিমাণে খাদ্যশস্যর উত্পাদন হ্রাস করে বাণিজ্যিক পণ্যের চাষ বেড়েছে, রপ্তানি যোগ্য কৃষিপণ্যের চাষ বেড়েছে, চুক্তি চাষ ও আগাম বাণিজ্যের প্রচলন বেড়েছে, সেই পরিমাণে কৃষিপণ্য বাজারে চলে যাচ্ছে। বড় জোতে নতুন কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের দরুন যে পরিমাণে উত্পাদন বাড়ছে সে পরিমাণে বর্ধিত উদ্বৃত্ত বাজারে চলে যাচ্ছে। ছোট জোতের চাষীরা নতুন পদ্ধতিতে চাষ করতে গিয়ে য়ে পরিমাণে ঋণগ্রস্ত হচ্ছে সে পরিমাণে তাদের অভাবী বিক্রি (distress sale) বাড়াতে হচ্ছে, যাতে সে নিজের ব্যবহারের জন্য খাদ্যশস্যও বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে, আবার পরবর্তীকালে ঐ খাদ্য শস্যই তাকে অনেক বেশি চড়া দামে কিনে খেতে হচ্ছে। সব দিক মেলালে এটা বুঝতে খুব অসুবিধা হবার কথা নয় যে ১৯৯০-৯১-এর পরের ভারতে কৃষিপণ্যের বাজারে চলে যাওয়াটা প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। ভারত সরকারও এই পর্যায়ে কৃষিপণ্য বাজারজাত করার জন্যে নানা উদ্যোগ দেখিয়েছে। মূলত বাজারের জন্য (marketing) তৈরি করা ''অ-ঋণ সমবায় সমিতির সংখ্যা ১৯৯৯ সালেই হয়েছিল ৩ লক্ষ ৬১ হাজার, তার সদস্য সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৬০ লক্ষ, সেখানে নিয়োজিত ছিল ৬ লক্ষ ১৬ হাজার কর্মচারী। বাজারের উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ''কৃষি প্রক্রিয়াকরণ সমবায় সমিতি।'' যার সংখ্যা ১৯৬২-৬৩ তে ছিল ৩২৬টি, আজ তা হয়েছে ২৫০০০টি। সরকারের এই বিপুল উদ্যোগ ভারতের কৃষিপণ্যের বাজার যে অবিশ্বাস্য গতিতে বিকাশমান তাই সূচিত করছে। আবার একই সঙ্গে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে যেহেতু ভারতের পুঁজির বিকাশ ''বিকৃত'' ভাবে ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে তাই তার ছাপ অবশ্যই এখানকার বাজার-ব্যবস্থার মধ্যেও থাকবে। দু একটা উদাহরণ দিলে ভারতের বাজারের পশ্চাত্পদতা বোঝা যাবে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে কৃষকরা তাদের উত্পাদিত পুরো ফসলটাই বাজারে বিক্রি করে। আমাদের এখানে কৃষকেরা এখনও তাদের নিজেদের খোরাকিসহ আরও কিছু কাজের জন্য ফসলের একটা অংশ বিক্রি করে না। তাছাড়া পারিবারিক প্রয়োজনে নিজেই উত্পাদন করাটা তাদের এমন অন্ধ অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় যে তারা কখনই হিসাব করে দেখে না খাদ্য শস্যের বদলে অন্য কিছু চাষ করলে লাভ বেশি কিনা। ভারতীয় কৃষকের এ অভ্যাস এখনও রয়ে গেছে এবং এটা স্পষ্টতই পুঁজিবাদী বাজার-ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অবাধ শ্রম যে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করে তা বাজারে গিয়ে মুনাফা অর্জন করে এবং সেই মুনাফা আবার উত্পাদনের কাজে নিয়োজিত হয়ে পুঁজিপতিদের পুঁজির অবিরাম বৃদ্ধি ঘটায়। পুঁজিবাদী উত্পাদন ব্যবস্থার এই প্রকরণ অনিবার্যভাবে দুটি ফলাফল সৃষ্টি করে। (১) উদ্বৃত্ত পুঁজি পুনরায় উত্পাদনে নিয়োজিত হওয়া। (২) উদ্বৃত্তের পরিমাণকে তীব্রভাবে বাড়িয়ে তোলার তাগিদে উত্পাদন ব্যবস্থার মানকে, অর্থাৎ উত্পাদন শক্তিকে ক্রমান্বয় উন্নত করে যাওয়া। সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন ব্যবস্থায় এ দুটি বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত থাকে। সামন্ততান্ত্রিক সম্পত্তির মালিক উদ্বৃত্ত উত্পাদনে নিয়োজিত করে না। সে উদ্বৃত্ত ব্যয় করে ভোগের জন্য বা কখনও যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য, বা বড় জোর জনহিতকর বা ধর্মীয় কোন কাজের জন্য। ফলে উত্পাদিকা শক্তি উন্নত হয় অত্যন্ত ধীর গতিতে। যেমন সামন্তবাদী কৃষি উত্পাদন ব্যবস্থায় যুগ যুগ ধরে শুধু লাঙ্গল বলদের ব্যবহার। আমরা একটু আগেই আলোচনা করেছি ভারতে ১৯৬০-এর দশকের ''সবুজ বিপ্লব''-এর সময় থেকে এবং বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকের ''বিশ্বায়ন''-এর কালপর্বে পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার প্রসার ঘটেছে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে। এর অর্থ ব্যাপক হারে পুঁজিবাদী মুনাফার সৃষ্টি। দ্রুত জায়মান এই পুঁজিবাদী মুনাফা যে পুঁজির স্বাভাবিক নিয়মেই উত্পাদিকা শক্তির উন্নতির জন্য পুনর্বিনিয়োগ হয়েছে তা আমরা আমাদের দেশের কৃষিতে বিগত চার দশকে, বিশেষতঃ গত দু দশকে ক্রমবর্ধমান পুঁজি বিনিয়োগের যে পরিসংখ্যান দিয়েছি তাতেই স্বতঃপ্রমাণিত। ভারতের কৃষিতে পুঁজিবাদী উত্পাদন ব্যবস্থা বিকশিত হয় নি এ কথা যারা অত্যন্ত জোরের সাথে বলেন তারা কয়েকটি কারণ উপস্থাপিত করেন যেগুলি অবশ্যই আমাদের বিচার করে দেখা উচিত। তাঁরা এগুলির মধ্যে সব বেশি জোর দেন এখনো আমাদের কৃষিতে বেশ ভাল পরিমাণে ভাগচাষ প্রথা টিকে রয়েছে এ তথ্যটির উপর। কিন্তু ভাগচাষ মানেই তা সামন্ততান্ত্রিক ভূমিবাজনার জনক তা তত্ত্ব ও তথ্য কোনটির দ্বারাই প্রমাণিত হয় না। ভাগচাষ প্রথা সামন্ততান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী যে কোন ব্যবস্থারই অঙ্গ হতে পারে। তার মধ্যে কোনটি হবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে একটি নির্দিষ্ট দেশে একটি নির্দিষ্ট সময়ে তার চরিত্রের উপর। এ কথা ঠিক যে ঐতিহাসিকভাবে আমাদের দেশে যে ধরনের ভাগচাষ প্রথা বিদ্যমান ছিল তা সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন ব্যবস্থারই সূচক ছিল। এখানে জমির মালিকেরা উত্পাদন নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামেই বাস করতো না। যা উদ্বৃত্ত হতো তাকে পুঁজিতে পরিণত করে উত্পাদন বৃদ্ধিতে তাকে নিয়োজিত করার কথা ভাবতো না। তা ব্যয় করতো নানা ভোগ-বিলাসে।

নিঃসন্দেহে এ ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক। কিন্তু ভাগচাষে জমির মালিক যদি উত্পাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে আগ্রহী থাকে, যদি উত্পাদন খরচের সবটাই ভাগচাষীর উপর না চাপিয়ে নিজেই কিছুটা খরচ করে উত্পাদন সামগ্রী বা কাঁচামাল কেনার জন্য ভাগচাষীকে ঋণ দেয় বা কৃষিকাজ তদারকি করার জন্য চাষের এলাকা থেকে দূরে বাস না করে, চাষের এলাকায় বাস করতে থাকে তবে স্পষ্ট প্রমাণিত হবে যে জমি মালিকের মনোভাবে উত্পাদন বৃদ্ধি করে মুনাফা অর্জনের ইচ্ছা তৈরি হয়েছে। তখন আর এ প্রবণতাকে সামন্ততান্ত্রিক বলা যাবে না, তাকে পুঁজিবাদীই বলতে হবে। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশক থেকে ভাগচাষের জমির মালিকেরা এ প্রবণতা দেখাতে শুরু করেছে এবং পরবর্তীকালে তা অনেক বেড়েছে। ভাগ-চাষ প্রথার সাথে যে পুঁজিবাদী প্রথার চাষের কোন প্রকৃতিগত বিরোধ নেই তার প্রমাণ ভারতে যে সব অঞ্চলে (পাঞ্জাব-হরিয়ানা ইত্যাদি) পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যবস্থার তুলনামূলক বিকাশ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কোন বিতর্ক নেই, সেখানে কৃষিতে ভাগচাষ প্রথা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ছোট জোতের মালিকরা কৃষির জন্য ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যাবার ফলে নিজেরা চাষ করতে না পেরে কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে সক্ষম বড় কৃষকের কাছে ভাগে জমি দিয়ে দিচ্ছে এমন ঘটনা সবারই জানা। এই ভাগচাষ অবশ্যই পুঁজিবাদী।

এ রকম আর একটি ভুল ধারণা হচ্ছে কৃষিতে ছোট জোতের প্রাধান্য মানেই তা সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন ব্যবস্থায় দ্যোতক। তাত্ত্বিক যুক্তি হিসাবে যেটা বলা হয় তা হলো যেহেতু পুঁজিবাদী কৃষিতেও পুঁজির স্বাভাবিক নিয়মে কেন্দ্রীভবন ঘটে, তাই চাষের জমিরও কেন্দ্রীভবন ঘটা অনিবার্য। অর্থাৎ কৃষিতে প্রযুক্ত পুঁজি যদি ক্রমান্বয়ে অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে, তবে কৃষিযোগ্য জমিকেও সেইভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে উঠতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ ইংল্যান্ডের পুঁজিবাদী বিকাশের সময় ক্ষুদ্র কৃষকদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা বলা যায়। তত্ত্বগতভাবে এ যুক্তি একেবারে নিশ্ছিদ্র নয়, কারণ পুঁজিবৃদ্ধির মাপ শুধু জমির বৃদ্ধি দিয়ে না হয়ে একই জমিতে উন্নত পদ্ধতিতে চাষের জন্য অন্যান্য উপকরণের অনেক বেশি ব্যবহারের মাধ্যমেও হয়। ভারতের পুঁজিবাদী কৃষির বিকাশ মূলত এইভাবেই হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি আয়তনের জোত মালিকদের পুঁজিনিবিড় চাষ বাড়িয়ে বড় জোতের মালিকের গ্রাস থেকে রক্ষা পাবার ঐতিহাসিক উদাহরণ হচ্ছে ফ্রান্স। ভারতের ক্ষুদ্র জোত সম্পর্কে দুটি পর্যবেক্ষণ এখানে করে নেওয়া যেতে পারে। প্রথমতঃ বিশ্বায়নের জাঁতাকলে পিষ্ট ছোট জোতের মালিক চাষি ঋণভার থেকে মুক্তির আশায় উত্পাদন বাড়াবার জন্য সর্বস্ব পণ করে। সে একদিকে যেমন আবার ধার করে চাষের উন্নততর উপকরণ জমিতে প্রয়োগ হবে, অন্য দিকে পারিবারিক শ্রমকে আরও বেশি মাত্রায় জমিতে নিয়োগ করে। এর ফলে ছোট জোতের উত্পাদনশীলতা বড় জোতকে ছাপিয়ে গেছে। এর ফলে ছোট জোতও পুঁজিবাদী চাষের আওতায় চলে এসেছে। দ্বিতীয়তঃ বিশ্বায়নের প্রকোপেই চাষের খরচা এমন বেড়ে গেছে এবং উত্পাদিত পণ্যের দাম কমে গেছে যে ভারতে বড় চাষিদের পক্ষেও এখনও আর কৃষি কাজ চালিয়ে যাওয়া লাভজনক নয়। ফলে তারা উদ্বৃত্ত পুঁজি কৃষিতে বিনিয়োগ না করে কৃষি-উপকরণের ব্যবসা বা অন্যান্য নানা ধরনের ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করছে। ছোট জোতের কেন্দ্রীভবন না হওয়ার এটা একটা বড় কারণ এবং তা পুঁজিবাদের সঙ্কটকেই সূচিত করছে।

আধাসামন্ততান্ত্রিক কৃষি-ব্যবস্থাই ভারতে আজও প্রাধান্যকারী রয়েছে এ কথা যাঁরাই বলেন তাঁরা এ দেশে মহাজনী কারবারের ব্যাপক প্রচলনের উদাহরণ দেন। এ কথা ঠিক মহাজনী কারবার বলতে যা বোঝায় অর্থাৎ পুঁজি উত্পাদনে নিয়োগ না করে অনত্পাদক সুদের কারবারে নিয়োজিত করা ও ঋণগ্রহীতাকে অর্থনীতি বহির্ভূত উপায়ে দাবিয়ে রাখা— তা নিঃসন্দেহে প্রাক-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। ভারতের মহাজনী সমগ্র ঋণ ব্যবস্থার এক চতুর্থাংশে পরিণত হয়েছে এ হিসেব আমরা আগেই দেখিয়েছি। তার সঙ্গে যেটা যোগ করা উচিত তা হচ্ছে যে কোন ব্যক্তিগত ঋণই মহাজনী ঋণ নয়। ধনী চাষি যখন উত্পাদন ব্যবস্থাকে মৃসণ রাখার লক্ষ্যে বা উত্পাদন বাড়াবার লক্ষ্যে ঋণ দেয় তখন তাকে আর প্রাকপুঁজিবাদী মহাজনী ঋণ বলা যাবে না। ক্ষেতমজুরদের দাদনও অনেক সময় পুঁজিবাদী ধনী চাষি দিয়ে রাখে যাতে চাষের সময় মজুর নিয়োগ নিশ্চিত থাকে। ভাগচাষীদের ঋণ দিয়ে উত্পাদন বাড়াবার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই ঋণ চরিত্রগতভাবে পুঁজিবাদী। কিন্তু যে পরিমাণে এ ঋণ প্রাতিষ্ঠানিক নয়, সেই পরিমাণে তা নৈব্যক্তিকও নয়। তাই একে আবার পুরোপুরি পুঁজিবাদী চরিত্রেরও বলা যাবে না। আমাদের দেশের ধনী চাষীরা বেশিরভাগই সুদের কারবার করে কারণ তাতে লাভ বেশি হয় বলে একটা কথা চালু আছে। এ কথাটিও আংশিক সত্য, কারণ কৃষিতে গত কয়েক দশক ধরে উত্পাদিকা শক্তি বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ মূলত ধনী চাষিরাই করে গেছে।

পূর্বের আলোচনাগুলি থেকে এবার আমরা বোধহয় কয়েকটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি—

১) প্রাক-ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক আমল থেকেই ভারতে শিল্প পুঁজি বিকাশের এক ধারাবাহিক ইতিহাস আছে, যা অন্যান্য ঔপনিবেশিক দেশগুলি থেকে আলাদা।

২) প্রাক-স্বাধীনতা যুগে যে শিল্প ভিত্তি তৈরি হয়েছিল তাতে ভর করে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে লাগাতার শিল্প-বিকাশ ঘটতে থাকে যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুঁজির দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে আরও বেগবান হয়।

৩) বিশ্বায়নের পর্বে ভারতের বৃহৎ পুঁজি বিশ্বায়িত আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পুঁজি-বৃদ্ধির মাত্রা এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে ভারতের বৃদ্ধির হার পশ্চিমী পুঁজিবাদী দেশের হারকে অনেক সময় পিছনে ফেলে দেয় এবং সে নিজেও আন্তর্জাতিক পুঁজির বাজারে রীতিমতো এক প্রতিযোগী শক্তি হয়ে ওঠে।

৪) স্বাধীনতার পর থেকে কৃষি-ক্ষেত্রে ওপর থেকে নানা ধরনের কৃষি-সংস্কারের উদ্যোগ চালু হয়, ভূমি সংস্কারের আধা-খ্যাঁচরা উদ্যোগ যার মধ্যে প্রধান।

৫) ১৯৬০-এর দশক থেকে প্রধানত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বাবধানে ভারতে শুরু হয় ''সবুজ বিপ্লব'' যাতে ভারতের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রদেশে কৃষি ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি বিনিয়োগ হয় এবং সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন-সম্পর্ক ভাঙতে শুর করে।

৬) বিশ্বায়ন পর্বে ভারত সরকারের তরফে ''গ্যাট'' চুক্তিতে সই করার পর ভারতের গোটা কৃষি ক্ষেত্রকে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সামনে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এখন তার কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে নয়, গোটা দেশের কৃষিতে পুঁজিনিয়োগ বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। বহুজাতিক সংস্থাগুলি যেমন ফলে ফেঁপে ওঠে তেমনি এক ধীর প্রক্রিয়ায় কৃষিতে সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক ভাঙতে থাকে।

৭) কৃষি ক্ষেত্রে সর্বহারা-আধা-সর্বহারারা সংখ্যাধিক হয়ে ওঠে; উত্পাদিত পণ্যের সিংহভাগ বাজারে চলে গিয়ে মুনাফা সৃষ্টি করে এবং তা অনেক ক্ষেত্রে কৃষিতেই পুনর্নিয়োজিত হয়ে ক্রমান্বয়ে কৃষিক্ষেত্রে উত্পাদিকা শক্তির বৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে, কখনো বা অন্য কোন পুঁজিবাদী উদ্যোগে ব্যবহার হচ্ছে।

৮) কৃষি-ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কের এই ভাঙন বা শিল্প পুঁজির এই বিকাশ কোন বুর্জোয়া সংস্কার বা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ঘটেনি, ঘটেছে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপে এবং উপর থেকে। এই বিকাশ তাই 'বিকৃত' বিকাশ, যা সামন্তবাদী অবশেষকে বহুল পরিমাণে টিকিয়ে রেখেই ঘটেছে।

৯) এই প্রবন্ধে দেওয়া পরিসংখ্যান এবং তা থেকে যে যে পর্যবেক্ষণ সমূহ বেরিয়ে আসছে তা অনিবার্যভাবে আমাদের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয় যে ভারতে পুঁজিবাদের বিকাশে সমস্ত বিকৃতি ও পশ্চাত্পদতা সত্ত্বেও ১৯৮০-র দশকের শেষ থেকে ১৯৯০-এর দশকের শুরুর পর্বে পুঁজিবাদ প্রাধান্যকারী স্থান নিয়ে নিয়েছে এবং দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিরাই দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এই সময় থেকেই ভারতকে চিহ্নিত করতে হবে একটি অত্যন্ত পিছিয়ে পুঁজিবাদী দেশ হিসেবে।

একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া কি একটি আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশ পুঁজিবাদী দেশ হয়ে উঠতে পারে?

এখনও পর্যন্ত কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরে এই রকম একটি প্রশ্ন উত্থাপন করাটাকেই গর্হিত কাজ বলে বিবেচনা করা হয়। এর মূল নিহিত রয়েছে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যেই। ১৯৬০ বা ১৯৭০ দশকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের অঘোষিত কিন্তু অবিসংবাদী নেতৃত্ব কমঃ মাও সে তুঙের নেতৃত্বাধীন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (CPC) বিশ্বপরিস্থিতি এবং পশ্চাত্পদ দেশগুলিতে বিপ্লবের প্রকরণ হিসেবে প্রাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, প্রাক-চীন বিপ্লবের মডেলটিকেই এমন জোরে সোরে উত্থাপন করে গেছে যে ঐ দুটি যুগান্তকারী ঘটনার পরে সাম্রাজ্যবাদের কর্মপদ্ধতিতে যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে এবং সেগুলি নিয়ে যে গভীর চর্চা শুরু করার প্রয়োজন তার ইঙ্গিত-মাত্রও দেয়নি। ফলে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা অন্য কিছু ভাবার সাহস দেখাবে কি করে? একে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের পুরনো অভ্যেস বিদেশী কোন পার্টির প্রতি অন্ধ আনুগত্য একটি ঐতিহ্য হিসেবে চেপে বসেছিল। অন্যদিকে জন্মকালীন মতাদর্শগত দুর্বলতা দৃষ্টিভঙ্গীর ক্ষেত্রে এক ধরনের বদ্ধমূলতা (fixedness) উপহার দিয়েছিল। এর বিষম ফল এখনও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। পৃথিবী উল্টে গেলেও তৃতীয় বিশ্বের যে কোন দেশকে আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক ধরে নেওয়া এবং তদনুযায়ী নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী গ্রহণ করা প্রায় বুক দিয়ে আগলে রাখার মত বিষয় হয়ে রয়েছে। তাঁদের যুক্তি কাঠামোটি এই রকম। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হবার পরেও সাম্রাজ্যবাদের চেষ্টা থাকবে প্রভাবাধীন দেশটিতে পশ্চাত্পদতা বজায় রেখে পুঁজির আঙ্গিক গঠনকে কম রাখতে যাতে সেখানে লগ্নী পুঁজি বিনিয়োগে তার মুনাফার হার বেশি থাকে। এই পশ্চাত্পদতা বজায় রাখতে তার নির্ভরযোগ্য সহায় সেই দেশের কমপ্রাডর বৃহৎ বুর্জোয়া যারা সাম্রাজ্যবাদ ও নিজেদের স্বার্থে সেদেশে মৌলিক ভূমিসংস্কার করবে না। গ্রামীণ ভূসম্পত্তির মালিকেরা সামন্ততান্ত্রিক হবার ফলে জমি থেকে প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত মূলতঃ ভোগ করে ফেলে। সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় খুঁটি এরাই, কারণ দেশে পশ্চাত্পদ অর্থনীতি বজায় রাখতে এরাই বড় সহায়ক। সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-বৃহৎ কমপ্রাডর পুঁজির এই অক্ষ সাম্রাজ্যবাদী লগ্নী পুঁজির স্বার্থ সব চেয়ে ভালভাবে দেখে এবং যতদিন না নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে এই জোটকে চূর্ণ করা যাবে ততদিন এই ব্যবস্থা একটা পরিবর্তনীয় রূপ নিয়ে দীর্ঘকাল বজায় থাকবে। দেশে শিল্পের বিকাশ এবং কৃষিতে পুঁজিবাদের বিকাশ একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আটকে থাকবে এবং উত্পাদন সম্পর্কের কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটা অসম্ভব হবে। বিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রথমভাগে পশ্চাত্পদ দেশের বিপ্লব সম্পর্কে তৃতীয় আন্তর্জাতিক এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির এই বিধান একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে একইভাবেই আঁকড়ে রয়েছেন বহু কমরেড।

চীন বিপ্লবের বিজয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কতগুলি গুরুতর পরিবর্তন সাধন করেছে। তার প্রতি মনোযোগ না দিয়ে আজকের বিশ্বকে কোনমতেই বোঝা যাবে না, তার সাথে বোঝা যাবে না আজকের সময়ের বিপ্লবের পদ্ধতি-প্রকরণ। প্রথমে চীন বিপ্লবের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা যাক। চীন বিপ্লবের বিজয় সাম্রাজ্যবাদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। নিতান্ত পিছিয়ে পড়া দেশেরও বুভুক্ষু কৃষক কীভাবে মার্কিন বা জাপানী সাম্রাজ্যবাদকে সমূলে উৎপাটিত করতে পারে তার এক জ্বলন্ত নিদর্শন হিসেবে চীন বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদের কাছে বিভীষিকা হয়ে গেছিল। এ ঘটনার যাতে আর পুনরাবৃত্তি না হয় তার জন্য সাম্রাজ্যবাদ অত্যন্ত সচেতনভাবে পশ্চাত্পদ সদ্যস্বাধীন দেশগুলির গ্রামাঞ্চলে কিছু সংস্কার কর্মসূচী নিয়েছিল। এই দেশগুলিকে ''কলম্বো প্ল্যানের'' অন্তর্ভুক্ত করা থেকে শুরু করে এ সব দেশে ভূমিসংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করা এবং পুঁজি বিনিয়োগ করে খাদ্যোত্পাদন বাড়িয়ে ক্ষুধাকে খানিক প্রশমিত করা— এ সবই সেই কর্মসূচীর অন্তর্গত। আমাদের দেশে ''সবুজ বিপ্লব'' প্রবর্তন করার অন্য অনেক কারণের মধ্যে এটিও একটি। আমাদের দেশের শাসকশ্রেণী যে ১৯৫০-এর দশক থেকেই ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমিদারি প্রথা বিলোপ করলো বা জমির উর্ধ্বসীমা বেধে দেবার মত ভূসম্পত্তির মালিকদের বিরুদ্ধে যায় এমন সব আইন করলো তার পশ্চাত্পটে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিসংস্কারের প্রবক্তাদের পরামর্শ ছিল না তা মনে করার কোনও কারণ নেই। ১৯৪০-এর দশকের শেষভাগে জাপান সরকারও ভূস্বামীদের কাছ থেকে জমি কিনে নিয়ে ভাগচাষীদের কাছে বিক্রি করেছিল। চীন বিপ্লবের পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পশ্চাত্পদ দেশে উপর থেকে ভূমিসংস্কার কর্মসূচী সাম্রাজ্যবাদ নিতে বাধ্য হয়েছিল এবং তার ফলে সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন ব্যবস্থার ক্ষয় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তবে এই ক্ষয় ছিল খুব শ্লথগতি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পুঁজিবাদী দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ এক কঠিন সঙ্কটের মুখে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্পষ্ট বোঝা যায় যে জাতিরাষ্ট্র-ভিত্তিক একচেটিয়া পুঁজি দেশের বাইরে পুঁজি রপ্তানি করে বা পুঁজি রপ্তানির ক্ষেত্র দখল করার জন্য যুদ্ধ করেও তার সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার বদ্ধ দশা থেকে বেরোতে পারছে না। জাতি-রাষ্ট্র-ভিত্তিক একচেটিয়া যখনই তার নিজস্ব উত্পাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার সুযোগ হারালো তখনই তার সঙ্কট শুরু হলো। তাই দেখা যায় ১৮৮১ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত (য়ার মধ্যে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ মারফৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের পুঁজিরপ্তানির ক্ষেত্রগুলিকে পুনর্বিভাজিত করেছে) শিল্পোত্পাদনের বৃদ্ধির নিম্নমুখী হার রোধ করতে পারে নি। এর মূল কারণ সঞ্চয়ন প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে তাকে যে ক্রমাগত বর্ধিত হারে ভোগ্যদ্রব্য উত্পাদন করতে হয় দেশের অভ্যন্তরে তার বাজার ফরিয়ে যাবার পর সে ভোগ্যদ্রব্যের চাহিদা আছে এমন অন্য ক্ষেত্র নতুন করে আর পায় নি। যুদ্ধ করেও এ সমস্যার মীমাংসা হলো না। অতীতে একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও পুঁজি তার একচেটিয়ার যাত্রা পথে একটা সময় সঞ্চয়নের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। পৃথক পৃথক বিদ্যমান পুঁজিগুলি নিজ নিজ ঘনীভবন প্রক্রিয়ার (concentration of capital) মাধ্যমে আর বৃদ্ধি পাচ্ছিল না, প্রক্রিয়াটি এত ধীর হয়ে গিয়েছিল এবং পুঁজিপতিদের উত্তরাধিকারী মধ্যে বিভাজনের কারণে এত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল যে মুনাফা অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়োজনেই ভিন্ন ভিন্ন পুঁজির পারস্পরিক মিলনের মাধ্যমে পুঁজির কেন্দ্রীভবন (centralisation of capital) এক অনিবার্য সমাধান সূত্র হিসেবে হাজির হয়েছিল। পুঁজির সঞ্চয়নের ক্ষেত্রে এটি একটি দ্রুতগতি প্রক্রিয়া। ঐ সময় প্রয়োজন ছিল আরও বৃহত্তর পরিসরে উত্পাদন এবং তার সাহায্যে শ্রমের উত্পাদনশীলতা বাড়িয়ে তোলা। এইভাবেই কেবলমাত্র সম্ভব হয়েছিল মুনাফার উর্ধ্বমুখী হারকে বজায় রাখা। দেখা যাচ্ছে পুঁজির সঙ্গে পুঁজির সহজাত দ্বন্দ্ব সংঘর্ষ যেমন থাকে (যা দু'দুটো বিশ্বযুদ্ধের সৃষ্টি করেছে) তেমনই তার মধ্যে থাকে পরস্পরের সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া। একটা সময় আসে যখন পুঁজির অস্তিত্বের প্রাণভোমরা মুনাফার ক্রমিক উচ্চতর হারকে বজায় রাখতে পুঁজিপতিরা তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের অহংটিকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিরাষ্ট্র-ভিত্তিক একচেটিয়াগুলি আবার পুঁজির সঞ্চয়ন, শ্রমের উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বৃহত্তর পরিসরে উত্পাদনকে ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে সঙ্কটে পড়লো। বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে বা বিশ্বে প্রভাবাধীন এলাকার পুনর্বিন্যাস করে যে এ সঙ্কট থেকে মুক্তি নেই তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। এখন একমাত্র সমাধান হতে পারে জাতিরাষ্ট্রের গণ্ডি ভেঙেচুরে আন্তর্জাতিক স্তরে একচেটিয়া পুঁজির কেন্দ্রীভবন। হলোও তাই। ভিন্ন ভিন্ন জাতিরাষ্ট্র-ভিত্তিক একচেটিয়াগুলির মধ্যে কেন্দ্রীভবন মারফৎ বহুজাতিক সংস্থার উদ্ভব বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে হয়ে উঠলো পুঁজিবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। জাতিরাষ্ট্রের বাইরে পুঁজির চলে যাওয়া এখন আর পুঁজির বহির্গমন নয়, তা হয়ে উঠলো আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির আভ্যন্তরীণ চলাচলেরই অংশ। পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন এই প্রক্রিয়ারই আনুষ্ঠানিক রূপ।

পুঁজির সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার, শ্রমের উত্পাদনশীলতার এবং ভোগ্যপণ্যের বাজারের সঙ্কট সাময়িকভাবে হলেও অতিক্রম করা গেল। পুঁজির এই বিশ্বজোড়া চলাচল একদিকে পৃথিবী জুড়েই পুঁজিবাদের বিকাশধারার আরও বিস্তৃতি, আরও গভীরতা লাভ করলো, অন্যদিকে এই পুঁজি নিজের অস্তিত্বের স্বার্থেই বাজার সম্প্রসারণের অভিযানে নামালো। এটা করতে গিয়ে পিছিয়ে পড়া দেশের বাজার তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। তারমধ্যে আবার ভারতের বাজার তার কাছে লোভনীয়। কারণ অন্যান্য পিছিয়ে পড়া দেশের তুলনায় ভারত ইতিমধ্যেই অগ্রসর অবস্থায় ছিল। নানাধরনের কৃষিসংস্কার ভারতের সামন্তবাদী উত্পাদন ব্যবস্থায় নানা ক্ষয় ধরিয়ে ছিল। বিশ্বায়িত পুঁজি ভারতের কৃষিতে যখন হুহু করে ঢকতে থাকলো তখন তা আরও দ্রুত আরও ব্যাপকভাবে ভারতের কৃষিতে সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন সম্পর্ক ভাঙতে লাগলো। পুঁজির আঙ্গিক গঠন বাড়ার ফলে মুনাফার হার নিম্নমুখী যেমন হলো, তেমনি পশ্চাত্পদ দেশগুলিতে বাজার সম্প্রসারণ করে পণ্যের রপ্তানি বাড়িয়ে সামগ্রিক মুনাফা বাড়াবার দরজাও খুলে গেল। উন্নত দেশগুলিতে যেসব পণ্যের বাজার সংকুচিত হয়ে পড়েছে ভারতের মতো দেশে সেই পণ্যের বাজার তৈরি করা হলো। যেমন নাইট্রোগ্লিসারিনের চাহিদা বিশ্বযুদ্ধের অবসানে কমে যাওয়ার পরে ''সবুজ বিপ্লব''-এর অঙ্গ হিসেবে ভারতে নাইট্রোজেন সারের বিপুল বাজার খুলে গেলো। বিশ্ব-একচেটিয়া তার বাজার সম্প্রসারণশীল রাখার জন্য ''মেধাস্বত্ব আইন''-সহ নানা বৈষম্যমূলক আইন চালু করে পুঁজির আঙ্গিক গঠনের সাথে সাথে মুনাফার হারও বাড়িয়ে চললো। ফল, সবজি, ফুল, চিংড়ি, মাছ ইত্যাদি যে পণ্যগুলির বিদেশে চাহিদা আছে তার উত্পাদনের জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলি পরিকাঠামো গড়তে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করলো। পরিবেশগত কারণে যে সব পণ্য উত্পাদন সাধারণ মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক (পরমাণু বিদ্যুত) সেগুলি ভারতের মতো দেশে স্থাপন করে পুঁজির বাজার আরও সম্প্রসারিত করলো। দেখা যাচ্ছে বিশ্বায়নের কালে আমাদের দেশে পুঁজির বিকাশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, খুব সীমিতও নয়। আবার এই বিকাশ যেহেতু বিশ্বায়িত পুঁজির স্বার্থে, আমাদের দেশের উন্নয়নের স্বার্থে নয়, তাই তা বিকৃত চরিত্র নিয়ে উপস্থিত।

তাই ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য ভারতের ''বিকাশে''র দিকটি, তার পুঁজিবাদী চরিত্রকে যেমন বোঝা দরকার তেমনই এর পশ্চাত্পদতার মাত্রা, চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যকে গভীরভাবে বোঝা প্রয়োজন। ভারতীয় সমাজ ও অর্থনীতি চরম বিপরীতের ঐক্যের এক অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক গবেষণা-ক্ষেত্র।

বর্তমান ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে আরও কিছু কথা

জাতিবর্ণভেদ প্রথা, জাতিসত্তার শক্তিশালী উপস্থিতি, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও নারীর উপর পুরুষতন্ত্রের মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব— এগুলি ভারতীয় সমাজে এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রেখেছে যে তার সম্পর্কে কিছু কথা না বললে ভারতীয় সমাজকে তার বৈচিত্র্যময়তায় বোঝা যাবে না।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে বর্ণাশ্রম ও জাতিবর্ণভেদ ব্যবস্থা দুটি পৃথক কালে উদ্ভুত সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যার সঙ্গে তুলনীয় কিছু অন্য কোন দেশে পাওয়া যাবে না। খৃষ্টপূর্ব ৩০০ সালের পরবর্তী ৮০০ বছরে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা ধীরে ধীরে জাতিবর্ণভেদ প্রথায় রূপান্তরিত হয়। খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে যখন কৃষির উপর নির্ভর করে ব্যবসাবাণিজ্য, রেশম চাষ, হস্তশিল্পের বিকাশ ঘটে তখন শূদ্রদের মধ্যে কৃষি ত্যাগ করে হস্তশিল্পে যোগ দেবার প্রবণতা বাড়ে। তাকে প্রতিহত করার জন্য খ্রিস্টীয় ২০০ সাল নাগাদ মনর বিধানকে ভিত্তি করে বর্ণাশ্রম প্রথার জায়গায় পেশাভিত্তিক বর্ণভেদ প্রথার সূত্রপাত ঘটানো হয়। এটাই ছিল মনুসংহিতার ব্রাহ্মণ্যবাদী মীমাংসা। ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রথাসমূহ ও সামাজিক রীতিনীতিগুলির দ্বারা সুরক্ষিত জাতিবর্ণভেদ প্রথা খ্রিস্টীয় ৬০০ সাল নাগাদ ভারতীয় সমাজের সর্বস্তরে আধিপত্য স্থাপন করে। ভারতীয় সামন্তবাদী উত্পাদন পদ্ধতির বিশেষত্ব হিসেবে বর্ণভিত্তিক উত্পাদন ব্যবস্থার এক সুদীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর জন্ম, গঠন ও বিবর্তনে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে শূদ্র, অতিশূদ্রদের মধ্যযুগ থেকে চলে আসা সংগ্রাম-সংঘর্ষ ভারতের সমাজ-জীবনে শ্রেণী সংগ্রামের এক বিশেষ ধরন তৈরি করেছে যাকে ঠিক মতো বুঝতে না পারলে সচেতন শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে তোলার কাজ অসম্ভব। স্বাধীনতার পর শিল্পে-নিযুক্তি নিম্নজাতিবণের মানুষদের জীবনে বিশেষ কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি। 'সবুজ বিপ্লব'-এর সূচনায় এই মানুষেরা নিজ নিজ পেশা থেকে ছিটকে গিয়ে কৃষি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কৃষকদের মতই বেশিরভাগ অসংগঠিত, অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রে নিয়োজিত হল। অকৃষিক্ষেত্রের সর্বহারা শ্রেণীর ৮০% মানুষ হচ্ছে ST, SC ও OBC ভক্ত। এদেরই এক বিশাল অংশ বেকার বা ছদ্ম বেকার। এর সাথেই উল্লেখ করা দরকার আদিবাসীদের কথা যারা সবচেয়ে বঞ্চিত, বিচ্ছিন্ন ও নিপীড়িত। এরা মোট জনসংখ্যার ৮%।

ভারত প্রকৃত অর্থে একটি বহুজাতিসত্তার দেশ, ''ভারতীয় জাতি'' হিসেবে গোটা দেশকে গড়ে তোলার এক কর্মসূচী ভারতের শাসকদের থাকলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিসত্তার লড়াইগুলি ভারত রাষ্ট্রের গঠন-বৈচিত্র্যকে সামনে তুলে ধরেছে। শাসকশ্রেণী বৃহৎ জাতিসত্তাগুলিকে ভারতীয়ত্ব হিসেবে তুলে ধরছে ও অন্যান্য অবদমিত জাতিসত্তাগুলিকে লুপ্ত করার চেষ্টা করছে। তার বিরুদ্ধে চলছে নিরবচ্ছিন্ন এক মরণপণ লড়াই, তা কখনও সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ ধরছে। কখনও এই লড়াইগুলির পিছনে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য ও মৌলবাদী চিন্তা থাকছে, কখনও বা থাকছে আঞ্চলিক মাঝারি বুর্জোয়াদের স্বার্থ। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের বা সাম্রাজ্যবাদী ইন্ধনও কখনও থাকছে। এ সব সত্ত্বেও সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে এই জাতি-সত্তাগুলির অবদমিত অনুভূতি ও জাতিসত্তা হিসাবে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। যদিও পৃথক পৃথক ছোট রাষ্ট্রের গঠন শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের কাছে কাম্য নয়, তবু অধিকারের প্রশ্নে একটি জাতিসত্তার বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার, এমনকি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের অধিকারকেও শ্রমিক শ্রেণী সমর্থন করবে।

ভারতের মেহনতি মানুষের মধ্যে ধর্ম, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গভীর প্রভাব ও শিকড় রয়েছে। মানুষের ধর্মবিশ্বাসের পিছনে রয়েছে একদিকে অসহায়ত্ব, নিজের ও মানুষের শক্তি সম্পর্কে অনাস্থা ও অবিশ্বাস অন্যদিকে কয়েক শ'বছর ধরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের ভাববাদী দর্শন চিন্তা ও আধুনিক বিজ্ঞানচর্চ্চায় অজ্ঞেয়বাদের তুমুল প্রভাব। তাই একেবারে অজ্ঞ, অশিক্ষিত মানুষ থেকে শুরু করে, শহুরে ''শিক্ষিত'' মানুষের মধ্যেও এর প্রভাব অবিসংবাদী। তাই আমাদের বুঝে নিতে হবে সমাজ বিপ্লবের প্রাক-মুহূর্তেও বিপ্লবের সমর্থক মানুষদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই থাকবেন ধর্ম ও ঈশ্বরে বিশ্বাসী। ধর্মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জাড়িয়ে রয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদ। ধর্মের আদিমতম আচার, অভ্যাস, রীতিনীতি, প্রথা ও অনুশাসনের ভিত্তিতে ধর্মে বিশ্বাসী মানুষকে সুসংগঠিত নির্দিষ্ট ছাঁচে গড়ে তোলা এবং ধর্ম বিশ্বাসে এক উগ্রতা সঞ্চার করা ধর্মীয় মৌলবাদের বৈশিষ্ট্য। সাধারণভাবে ধর্মের সাথে শাসকশ্রেণীর মতাদর্শ মিশে থাকে। ধর্ম চলমান শ্রেণী সংগ্রামকে দেখতে পায় না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বদলে ঈশ্বর বা আল্লার কাছে প্রতিকার চাইতে শেখায়, সমাজের বা শাসকশ্রেণীর যে কোন নিপীড়নকে পূর্বজন্মের পাপের ফল হিসাবে দেখায় ও ক্ষোভের আগুনকে নিষ্প্রভ করে দেয়। ধর্মীয় মৌলবাদ এই চিন্তার উপর মানুষকে সংগঠিত করে সমাজকে পিছনে টেনে রাখে। ধর্মের নাম করেই শাসকশ্রেণীর দলগুলি নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে উস্কে দেয়, দাঙ্গা সৃষ্টি করে। আমাদের দেশে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই শাসকশ্রেণী এই সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডল তৈরি করতে প্রথমত কাজে লাগিয়েছে এবং অনেকটা তার প্রতিক্রিয়াতেই অন্য সব ধর্মের মানুষদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। ধর্মবিশ্বাস দূর করা এক জরুরি গণতান্ত্রিক কর্তব্য। এর জন্য কখনও সরাসরি ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে হবে, কখনও বিশ্বাসে প্রত্যক্ষ আঘাত না দিয়ে যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা দিয়ে ধর্মবিশ্বাসকে প্রতিস্থাপিত করতে হবে।

শ্রেণীগত নিপীড়নের সঙ্গে নারীর জীবনে পিতৃতন্ত্রের নিপীড়ন সব সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ভারতে এই নিপীড়ন এক বিশেষ তীব্রতায় উপস্থিত। পুরুষের তুলনায় নারী অক্ষম— এই মৌলিক ভ্রান্তির উপর গড়ে উঠেছে পিতৃতন্ত্রের ধারণার সৌধ। পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পরিবার, বংশপরম্পরা, যৌন আকাঙ্ক্ষা, মানসিক ও শারীরিক তৃপ্তি চরিতার্থ করার জন্য নারীদের দাসসুলভ শ্রমদান ও বশ্যতা— এই হলো পিতৃতন্ত্রের মূলকথা। ভারতের ক্ষেত্রে মনুসংহিতা জাতিধর্ম ব্যবস্থার সাথে নারীর উপর নির্দিষ্ট করে দিয়েছে ধর্মীয় নানা বিধির অনুশাসন। তার মধ্যে আছে বাল্য বিবাহ, সতীদাহ, বৈধব্যদশার কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা। বর্তমান সময়ে এরই বিবর্তিত বহুবিচিত্র রূপ পণপ্রথা, কন্যাভ্রূণ হত্যা, বধূ নির্যাতন, ধর্ষণ, পরিবারের ভিতরে ও বাইরে যৌননিগ্রহ। পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে বুর্জোয়ারা ব্যক্তিগত সম্পত্তির সুরক্ষা ও শ্রেণী শাসনের স্থিতিশীলতা টিকিয়ে রাখতে বিবাহ ব্যবস্থাকে গৌরবান্বিত করছে, আবার স্ত্রীশিক্ষার প্রসার ঘটাচ্ছে পণপ্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইন করছে সংসদীয় বিভিন্ন ব্যবস্থায় নারীদের জন্য সংরক্ষণ। আবার পুঁজির বাজার সম্প্রসারণের জন্য নারীদেহকে পণ্য হিসাবে উপস্থিত করে বেশ্যাবৃত্তি, রূপচর্চা, ফ্যাশন শিল্প, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা, পর্ণোগ্রাফি, সেক্স ট্যুরিজম ইত্যাদিকে অবাধে প্রসারিত করছে। সব সমাজ ব্যবস্থাতেই বিবাহ ও পরিবার ব্যবস্থা পিতৃতন্ত্রের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। এই ব্যবস্থা ব্যক্তিগত মালিকানা ও শ্রেণী বৈষম্যের সাথে অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। বুর্জোয়া সংস্কারের ফলে বিবাহিত নারীদের উপর নির্যাতনের ক্ষেত্রে কিছু আইন রয়েছে, কিন্তু পুঁজিপতি শ্রেণী বা আধুনিক রাষ্ট্র বিবাহবন্ধন থেকে মুক্তির জন্য নারীর ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে বা বিবাহবিচ্ছিন্না নারীর দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। নারীর যৌনতার উপর অধিকার হরণ করতেও বিবাহ-ব্যবস্থা এক শক্তিশালী হাতিয়ার। অবিবাহিত নারীর জীবনে যৌনতার কোন সামাজিক স্বীকৃতি নেই। পিতৃতন্ত্রের নির্মাণ হিসেবেই সমগ্র সমাজে যৌন সম্পর্কের ধারণা গড়ে উঠেছে। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক নিরবচ্ছিন্ন লড়াই সমাজের অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। মনুসংহিতার বিধান আজও ভারতীয় মনোজগতে এমন গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে রয়েছে যে এখানে এই সংগ্রাম হবে অনেক বেশি জটিল ও কষ্টসাধ্য।

বর্তমান নিবন্ধে আমরা ভারতের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যের উপর আমাদের মনোযোগ প্রধানতঃ কেন্দ্রীভূত করায় অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে কেবল রূপরেখা বর্ণনা করা হলো। এগুলি নিয়ে বারান্তরে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা রইল।

শেষের কথা

ভারত সম্পর্কে আমাদের এই পর্যবেক্ষণ যে কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরের সাধারণভাবে গৃহীত ধারণার প্রায় বিপরীতধর্মী হিসেবে উপস্থিত হবে সে সম্পর্কে আমরা সচেতন। কিন্তু আমাদের বিচার ও উপলব্ধিতে, মনে হয়েছে অকুণ্ঠ চিত্তে সবার সামনে আমাদের বক্তব্য উপস্থিত করা প্রয়োজন। দুটি প্রত্যাশা নিয়ে আমরা এ কাজে হাত দিয়েছি। প্রথমতঃ আমরা মনে করি আমাদের দেশটি সম্পর্কে কতগুলি অনড় ধারণা থেকে বেরোবার একটি প্রক্রিয়া শুরু করা ভারতীয় বিপ্লবের রণনীতি ও রণকৌশল রচনার জন্য সবচেয়ে জরুরী কাজ। এ কাজে হাত দিয়ে আমরা অন্ততঃ এটুকু বোঝাতে পারবো যে এই বিষয়ে নতুন করে ভাবার ও গবেষণা করার যথেষ্ট অবকাশ আছে। দ্বিতীয় প্রত্যাশাটিও আমাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হচ্ছে বর্তমান প্রবন্ধটি একটি বড় প্রকল্পের সূত্রপাত মাত্র। যদি এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের শিবিরে ব্যাপক বিতর্ক, সমালোচনা, অনুসন্ধান ও গবেষণা শুরু হয় তবেই আমরা আমাদের ভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতাগুলি কাটিয়ে তুলতে পারবো এবং শুরু হবে একটি সম্মিলিত উদ্যোগ। একমাত্র তার সাহায্যেই ভারতীয় বিপ্লবের কর্মসূচীর রূপরেখা ক্রমশ পরিস্ফুট হতে থাকবে। এই প্রক্রিয়াটি শুরু হবার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকবো।


ভারতে মাওবাদী আন্দোলনের পেছনের কথাযাযাদি ডেস্ক ভারতে চলমান মাওবাদী আন্দোলন বলতে যা বোঝায় তার সূচনা ২০০৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর, দেশটির সশস্ত্র বামপন্থী দুটি দল জনযুদ্ধ (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী) এবং মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টারের একীভূতকরণের মধ্য দিয়ে। একই বছরের ১৪ অক্টোবর দল দুটি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইনডিয়া (মাওবাদী) নামে তাদের আন্দোলন চালানোর ঘোষণা দেয় এবং বর্তমানেও এই দলটিই ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তবে ২০০৪ সালই ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের সূচনাকাল নয়। মাওবাদী গেরিলাদের সক্রিয় তৎপরতার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ষাট এবং সত্তর দশকের ভারতের দিকে তাকালেই তার পরিচয় পাওয়া যায়।

মাওবাদী আন্দোলন : ৬০-৭০ দশক থেকে বর্তমান

ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের এক বছর আগে ১৯৪৬ সালে ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইনডিয়ার নেতৃত্বে জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে একটি সফল কৃষক বিদ্রোহ পরিচালিত হয়। বিদ্রোহে ৩ হাজার গ্রামের কৃষক জায়গিরদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পান এবং ১০ হাজার একর জমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। তেলেঙ্গানা বিদ্রোহের এই সাফল্য বিশ্লেষণ করে ১৯৪৮ সালে চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সেতুঙ-এর গেরিলা যুদ্ধের পথকে নবগঠিত ভারত রাষ্ট্রে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার পথ হিসেবে নির্বাচিত করে কমিউনিস্ট পার্টি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টিরই একটি বড় অংশ সে পথ থেকে সরে আসে।

গত শতাব্দীর ৬০-৭০ দশকের দিকে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি নামে একটি গ্রাম থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে ছত্তিশগড় এবং অন্ধ্রপ্রদেশের প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৭ সালের ৫ মে নকশালবাড়ি গ্রাম থেকে শুরু হওয়ার কারণে এই মাওবাদী আন্দোলনের প্রচলিত নাম নকশাল আন্দোলন। সে আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চারু মজুমদার, কানু স্যানাল, সরোজ দত্ত এবং আজিজুল হক। এরা সবাই কমিউনিস্ট পার্টি অব ইনডিয়ার (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বেশ কিছু 'সংস্কারপন্থী' সিদ্ধান্ত বয়কট করে দলটি থেকে বেরিয়ে আসেন। নকশাল আন্দোলনের কৃষক কর্মীরা স্থানীয় ভূস্বামী, তাদের শোষণ এবং তাদের ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জোর আন্দোলন গড়ে তোলেন। নকশালপন্থীদের নীতি ছিল_ জমির মালিকানা ভূস্বামীদের থেকে কেড়ে নিয়ে সেখানে চাষিদের পুনর্বাসন করা এবং পুলিশ বা প্রশাসন যদি ভূস্বামীদের পক্ষ নেয়, তবে তাদের ওপরও সশস্ত্র হামলা করা।

কলকাতার বিপুলসংখ্যক ছাত্র নকশালবাড়ি আন্দোলনকে সমর্থন করে এবং নির্দ্বিধায় শিক্ষাজীবন বিসর্জন দিয়ে তাতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেয়। প্রথমদিকে শিক্ষিত বোদ্ধা শ্রেণিরও সমর্থন পায় তারা। নকশাল আন্দোলন এবং নকশালপন্থীদের ওপর গল্প, উপন্যাস লেখা এবং সিনেমা তৈরির যে আগ্রহ দেখা যায় শুরু হয়, তা এখনো চলছে। তবে ভারত সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই আন্দোলন এবং সরকার কঠোর হাতে আন্দোলন দমনের নীতি গ্রহণ করে। এছাড়া পরবর্র্তী সময়ে নকশালপন্থীদের কিছু সহিংস কর্মকা-ের কারণে আন্দোলনটি জনসমর্থন হারাতে শুরু করে। অন্যদিকে সরকার নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েক হাজার ছাত্রকে বিনা বিচারে হত্যা করে। ভাঙন ধরে আন্দোলনের নেতৃত্বেও। ১৯৭১ সালে চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীর সিপিআই (মাওবাদী) ভেঙে যায় এবং ১৯৭২ সালে চারু মজুমদার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। বন্দী অবস্থাতেই তিনি নিহত হন। ষাট দশকের শেষার্ধে শুরু হওয়া এবং সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে নিষপ্রাণ হয়ে পড়া মাওবাদী আন্দোলনটিই মূলত ২০০৪ সালে, একটি নতুন শতাব্দীর সূচনালগ্নে প্রাণ ফিরে পায়।

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা 'রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং' (র)-এর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশটিতে প্রায় ২০ হাজার মাওবাদী সেনা সক্রিয়ভাবে তাদের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের সাহায্য করছে আরো প্রায় ৫০ হাজার কর্মী। ২০০৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মাওবাদীদের ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিরুদ্ধে 'সবচেয়ে বড় হুমকি' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মাওবাদীদের নির্মূল করতে ২০০৯ সাল থেকে ভারত সরকার শুরু করেছে তার স্ট্রাকো, কোবরা, 'গ্রিন হাউন্ড'সহ আধা-সামরিক বাহিনীগুলোর নিয়ে পরিচালনা করছে 'অপারেশন গ্রিন হান্ট'। এছাড়া মাওবাদী প্রভাবিত অঞ্চলগুলোয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে মাওবাদী প্রভাব থেকে দূরে রাখতে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কৌশলগত অর্থনৈতিক কর্মসূচি। এতসব পদক্ষেপে মাওবাদীদের সংখ্যা কমছে বলে জানাচ্ছে মূলধারার মিডিয়া। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে অপারেশন গ্রিন হান্টে বিপুলসংখ্যক আদিবাসীর মৃত্যু হয় বলে শোনা যায়। অরুন্ধতী রায়সহ ভারতের বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বোদ্ধা সরকারের এই নীতির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

কি চায় মাওবাদীরা

বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে ভারত সরকারের স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারক ও বিভিন্ন চুক্তি অনুযায়ী ছত্তিশগড়, ঝাড়খ-, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু অঞ্চলে খনিজ উত্তোলন, লৌহজাত দ্রব্য নিষ্কাষণ, ড্যাম ও ব্যারাজসহ নানাবিধ শিল্প কারখানা তৈরি করতে সরকার সেখানে বসবাসকারী স্থানীয় আদিবাসীসহ ভারতীয় নাগরিকদের উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর বিরুদ্ধে আদিবাসীরা যে আন্দোলন গড়ে তোলে, তার সঙ্গে যোগ দেয় মাওবাদীরা। মাওবাদ-নকশালবাদ ও আদিবাসীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর যুদ্ধের সূচনা এখান থেকেই। তবে কেবলমাত্র সরকারের উচ্ছেদ-নীতির বিরুদ্ধেই মাওবাদীদের আন্দোলন নয়। গোটা ভারতের পুঁজিবাদী কাঠামোটিকে 'আধা-সামন্তবাদী, আধা-উপনিবেশবাদী' হিসেবেই দেখেন মাওবাদীরা এবং তারা এর উচ্ছেদ ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। ২০০৮ সালে বিবিসির এক সাংবাদিককে ভারতের ছত্তিশগড়ের এক মাওবাদী নেতা কোবাদ ঘ্যান্ডি তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, যা থেকে মাওবাদীদের লক্ষ্য সম্পর্কে কিছুটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। কোবাদ ঘ্যান্ডির ভাষায়, 'আমরা ভারতের আদিবাসী জনগোষ্ঠী আর দরিদ্র গ্রামবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছি। প্রথমে আমাদের চাষিদের মাঝে জমি বিতরণ করতে হবে। কাজেই আমাদের লড়াই হচ্ছে জমি দখলের বিরুদ্ধে, গরিবদের শোষণের বিরুদ্ধে।' তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট- See more at: http://www.jjdin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=27-05-2013&type=single&pub_no=492&cat_id=3&menu_id=15&news_type_id=1&news_id=68644#sthash.PfzdQq0I.dpuf


কৃষক সংগ্রামে এক অমর অধ্যায়, তেভাগার লড়াই

Posted by bangalnama on September 13, 2010

2 Votes


- লিখেছেন বিনয় চৌধুরী


পটভূমি–


হান্টার তাঁর স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গলে দেখিয়েছেন, ১৮৭০ সালের আগে বাংলার গ্রামে ভূমিহীন কৃষক ছিল না। অল্পবিস্তর জমি সকল কৃষকেরই ছিল। কিন্তু ১৮৫৯ সালের রেন্ট অ্যাক্ট-এর পর খাজনা যথেচ্ছ ভাবে বাড়ানোর হাত থেকে মকরুরী স্বত্ব ও স্থিতিবান স্বত্বের রেহাই পেলেও, অধস্তন প্রজা বিলির অধিকার দেওয়ায় ক্রমশ নানা ধরনের অধস্তন প্রজা এবং ভাগ চাষ বাড়তে থাকল। ১৮৭০ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত উপর্যুপরি দুর্ভিক্ষ হওয়ায়, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র কৃষকরা ক্রমশ ঋণগ্রস্ত হয়ে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হলো, অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত ধনী কৃষকেরা জমি কিনে ক্রমশ জোতদারে পরিণত হতে থাকল। এছাড়া জমিদারদের ধান জমিতে, যেহেতু কৃষকদের কোন অধিকার দেওয়া হয়নি সেখানে অধস্তন প্রজা ও ভাগচাষী ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকল। এই সময়কালে অভাবের সময়ে কৃষকদের ধান ধার দেওয়ার প্রথা চালু হয়। প্রথম দিকে এক মণে দশ সের ধান সুদ হিসাবে নেওয়া হতো। পরে তা বেড়ে মণে ২০ সের হয়। ফলে গরীব অধস্তন প্রজা ও ভাগচাষীদের অবস্থা খুবই খারাপ হতে থাকে। এদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত এই ধারা চালু থাকে। জমিদার ও জোতদারদের শহরে গিয়ে বাস করার অভ্যাস বাড়তে থাকে। শহরে বাস করার বর্ধিত খরচ সঙ্কুলানের জন্য এদের উপর চাপ আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইতিমধ্যে ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩৩ সালে গভীর ও ব্যাপক আর্থিক সংকট দেখা যায়। ধানের দর চার-পাঁচ টাকা মণ থেকে নেমে দেড় টাকা-দু'টাকা মণে নেমে আসে। এর ফলে শুধু কৃষক ও ভাগ চাষী নয়, মাঝারি কৃষকের বড় অংশ ভীষণভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই দরিদ্র সময়ে জমিদার ও মহাজন-বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বাংলার ফজলুল হক সাহেবের নেতৃত্বে 'কৃষক প্রজা পার্টি'র সরকার গঠিত হয়। ইতিমধ্যে ১৯৩৭ সালে বাংলায় কৃষকদের সংগঠন – সারা ভারত কৃষক সভা- র অন্তর্ভুক্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সমিতি গঠিত হয়। ১৯৩৮ সালে ফজলুল হক সাহেব বঙ্গীয় প্রজা স্বত্ব আইনের সংশোধন করেন এবং যারা নির্দিষ্ট হারে খাজনা দিতেন এই ধরণের কোর্ফা প্রজাকে স্বত্ব দেন। অন্যদিকে ঋণ সালিসি বোর্ড গঠন করে এবং চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ নেওয়া বেআইনি করে এবং ঋণের সুদের ঊর্ধ্বসীমা বঁেধে দেওয়ায় কৃষকদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি হয়। সেই সময়েই ৫ থেকে ৬ হাজার বিপ্লবী পোড়খাওয়া নেতা ও কর্মী জেল ও বন্দী শিবিরগুলি থেকে মুক্তি পেয়ে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তখনই ভূমিব্যবস্থা সম্বন্ধে অনুসন্ধানের জন্য 'ফ্লাউড কমিশন' গঠিত হয়। এই ফ্লাউড কমিশন ভাগচাষীদের অধস্তন প্রজা হিসাবে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য এবং ভাগচাষীদের ভাগ তিন ভাগের দু'ভাগ করার অনুমোদন করে। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধে। এই সময়ে 'না এক পাই না এক ভাই' এই শ্লোগানে কৃষক সভা আন্দোলন করে। বহু কর্মী ও নেতা গ্রেপ্তার হন। তারপর ১৯৪২ সালে যুদ্ধের মোড় ঘুরে ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধে পরিণত হয় এবং তখন অগাস্ট থেকে কুইট ইন্ডিয়া সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯৪৩ সালে (বাংলা ১৩৫০) ভয়াবহ মণ্বন্তর হয়। পার্টি এবং কৃষক সমিতি ও অন্যান্য গণসংগঠন এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে নামেন। কাজেই এই পরিস্থিতিতে তেভাগা সংগ্রামের দিকে তেমন নজর দেওয়া যায়নি যদিও প্রাদেশিক কৃষকসভার সম্মেলনগুলিতে এই বিষয়ে প্রস্তাব নেওয়া হতো। ১৯৪৬ সালের গ্রীষ্মকালে খুলনা জেলার মৌভোগে তেভাগা বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয় এবং প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা ধান কাটার মরসুম হতে তেভাগা সংগ্রাম শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও ইতিমধ্যে ১৬ই আগস্ট কলকাতায় এবং পরে নোয়াখালিতে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। আন্দোলনে শ্লোগান তোলা হয় 'নিজ খোলানে ধান তোল, তেভাগা চাই'।


তেভাগা সংগ্রাম প্রথম পর্ব (১৯৪৬-৪৭)


প্রথমে সংগ্রাম শুরু হয় দিনাজপুরে। খুলঝারি সিং-এর ধান সকলে সমবেত হয়ে কাটতে গেলে পুলিশ আসে এবং সুশীল সেনকে গ্রেপ্তার করে। দ্বিতীয় দিনে আবার বেশী সংখ্যায় ভাগচাষী জমায়েত হয় এবং সংঘর্ষ বাঁধে। এরপর ঠাকুরগাঁয়ে নেতৃস্থানীয় কর্মীরা গোপনে মিটিং করে আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে সংগ্রাম পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এক মাসের মধ্যে আন্দোলন ও সংগ্রাম ৩০টি থানার মধ্যে ২২টি থানায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্গাদারদের মধ্যে প্রচুর উৎসাহ দেখা দেয়। এর প্রভাবে পার্শ্ববর্তী রংপুর ও জলপাইগুড়ি জেলায় এই সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। সর্বত্র ঐ এক দাবি, নিজ খোলানে ধান তুলতে হবে এবং তেভাগা আদায় করতে হবে। জলপাইগুড়ি জেলাতে প্রধানত ৪টি থানায় — দেবীগঞ্জ, কোতোয়ালি ও বোদা, পচাগড়ে তেভাগা সংগ্রাম পরিচালিত হয়। পরে মাল ও মোটলীতে শুরু হয়। এই সময় এক বৃদ্ধা রাজবংশী বিধবা মেয়েদের নিয়ে এক মিছিল বের করেন। পরে তিনি বুড়িমা নামে সকলের প্রিয় হয়ে ওঠেন। পচাগড়ে তখন চারু মজুমদার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।


রংপুর জেলায় নীলফামারি মহকুমায় তেভাগা সংগ্রাম সীমাবদ্ধ ছিল। এই নীলফামারি মহকুলা ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ডিমলার একজন মুসলমান জোতদার বন্দুক নিয়ে লোকজনসহ গুলি চালায়। তৎনারায়ণ রায় নামে এক রাজবংশী কৃষক প্রাণ হারায় এবং এখানে বাচ্চা মহম্মদ ও ১২ জন বর্গাদার আহত হয়। প্রায় ৩০০ কৃষক লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রাম ঘিরে ফেলেছিল। কিন্তু মুসলিম গ্রাম বলে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধতে পারে এই আশঙ্কায় তাদের সংযত করা হয়। জোতদাররা গ্রাম ছেড়ে পালায়। এরপরে নীলফামারি একটা কৃষক আন্দোলনের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়।


এরপর তেভাগা সংগ্রাম মালদহ ও বগুড়া জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। মালদা জেলায় প্রধানত গাজোল, ওল্ড মালদা, হবিবপুরে প্রধানত সাঁওতাল ও রাজবংশী বর্গাদাররা এই আন্দোলনে যোগ দেয়। প্রায় ১০০ জন সাঁওতাল বর্গাদার গ্রেপ্তার হয়। বগুড়া জেলার ডালাহরে এই আন্দোলন হয়। কিন্তু মুসলিম জোতদারদের বিরুদ্ধে মুসলিম বর্গাদারদের নামাতে ব্যর্থ হওয়ায় এখানে আন্দোলন জমে না। এই সময়ে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি মহকুমায় তেভাগা আন্দোলন নকশালবাড়ি অঞ্চলে শুরু হয়।


দক্ষিণবঙ্গে মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায় তেভাগা হয়। নন্দীগ্রাম ও পাঁশকুড়ায় বিশেষ ভাবে এই আন্দোলন হয়। বিমলা মাজীর নেতৃত্বের বহু সংখ্যক মহিলা কৃষক এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন।


ঘাটাল অঞ্চলেও এই সংগ্রাম গড়ে ওঠে।


১৯৪৭ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঠাকুরগাঁর ঠুমনিয়া গ্রামে পুলিশ ডোমা সিংকে গ্রেপ্তার করতে এলে ২০০ কৃষক প্রতিরোধ করে। এটি কৃষক সমিতির একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। পুলিশের গুলিতে সুফুর চাঁদ ও তাঁর স্ত্রী প্রাণ হারান। মকটু সিং, নেনদেলি সিং গুলিতে আহত হন এবং হাসপাতালে মারা যান।


এরপর দিনাজপুর জেলার বৃহত্তম সংগ্রাম হয় খাঁপুরে। এখানে ২২ জন সাঁওতাল, মুসলমান ও রাজবংশী বর্গাদার পুলিশের নির্মম আক্রমণে শহীদের মৃত্যুবরণ করেন।


রংপুর জেলায় এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সুধীর মুখার্জী, মণিকৃষ্ণ সেন। দিনাজপুর জেলায় নেতৃত্বে ছিলেন গুরুদাস তালুকদার, অবনী লাহিড়ী, অবনী বাগচী, চারু মজুমদার, সুনীল সেন, জলপাইগুড়ি জেলায় সমর গাঙ্গুলী।


তেভাগা সংগ্রামের দ্বিতীয়পর্ব (১৯৪৮-৪৯)


১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলো এবং দেশ বিভাজন হলো। ইতিমধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দ্রাবাদে অঞ্চলের তেলেঙ্গানায় বিখ্যাত তেলেঙ্গানা সংগ্রাম শুরু হয়েছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জমি দখল করে মুক্ত অঞ্চল গড়ে উঠেছে। নিজামশাহীর রাজাকার এবং ভারত সরকারের সৈন্যবাহিনীর সাথে সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এই পটভূমিতে কলকাতায় ১৯৪৮ সালের ২৬শে জানুয়ারী হতে ৬ই মার্চ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস শুরু হয়। এই সময়ে সংগ্রামের নতুন লাইন নেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ২৬শে মার্চ কমিউনিস্ট পার্টিকে বে-আইনী করা হয়। অনেক নেতা ও কর্মী গ্রেপ্তার হন। বাকিরা আত্মগোপন করে কৃষক সংগ্রাম পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই দ্বিতীয় পর্বে তেভাগা সংগ্রাম নতুন মাত্রা লাভ করে। সেই সময়ে দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপ অঞ্চলে তীব্র সংগ্রাম তেলেঙ্গানার প্রেরণায় গড়ে ওঠে। এছাড়া মেদিনীপুর, হুগলী ও বর্ধমানে আন্দোলন গড়ে ওঠে। তেভাগা সংগ্রামের প্রথম পর্বের চাপে ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে, কলকাতা গেজেটে 'বর্গাদার অর্ডিন্যান্স' ছাপানো হলেও তাকে মুলতুবি করে রাখা হলো। এ বিষয়ে সরকারের আর কোনো উদ্যোগ দেখা গেল না। কাকদ্বীপের সংগ্রাম ১৯৪৮ সালের ধান কাটার মরসুমে শুরু হয় বুধাখালী, চন্দনপঁিড়ি এবং লায়ালগঞ্জ এলাকায়। জোতদার ও লাটদারদের তীব্র আক্রমণের মুখে ক্রমশ এই সংগ্রাম সশস্ত্র সংগ্রামের চেহারা নিতে থাকে। সুন্দরবনের এই দরিদ্র অঞ্চলের বাস্তব পরিস্থিতি এই সংগ্রামের সহায়ক হয়। এখানে একদিকে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ বিঘা জমির মালিক লাটদার, জোতদার, অন্যদিকে দরিদ্রতম ডর্গাদার, যাদের উপর শোষণের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল অপরিসীমভাবে। এই অনুকূল পরিস্থিতিতে 'শিশু তেলেঙ্গানা' গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে দুর্জয় সাহস নিয়ে অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কাকদ্বীপ অঞ্চলের সংগ্রামে। কংগ্রেস জোতদার লাটদারদের সমর্থনে সেবাদল গঠন করে। সরকার থেকে কৃষকদের উপর উচ্ছেদের নোটিস দেওয়া হলো। ৩০শে ডিসেম্বর বহুসংখ্যক কৃষক সমবেত হয়ে সমস্ত ফসল নিজ খামারে তুললেন। ১৯৪৯ সালের গ্রীষ্মে কৃষকদের সশস্ত্র স্কোয়াড, লাটদার ও জোতদারদের আক্রমণ করে সমস্ত ধান, গরু-বাছুর, বাসন কোসন সব দখল করে নিল।


১৯৪৯ সালের ১৫ই আগস্ট 'কাউন্সিল অব অ্যাকশন' ঘোষণা করলো, তারা ৫,০০০ বিঘা জমির দখল নিয়েছে। এই জমি গরীব কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। কয়েকজন লাটদার ও জোতদারদের হত্যা করা হয়। ১৯৪৯ সালের কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে পুলিশ এসে এই গ্রামগুলির উপর আক্রমণ চালায় এবং ১৭ জন কৃষককে হত্যা করে, এদের মধ্যে ৪ জন মহিলা। এই আক্রমণ প্রধানত বুধাখালী এবং চন্দনপঁিড়িতে হয়। গজেন মালী সমেত ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলতে থাকে স্পেশ্যাল ট্রাইবুনালে। এদের পরে দীর্ঘ কারাবাস হয়। কংসারি হালদার, অশোক বসু, হরিপদ শাসমল, ঈশ্বরচন্দ্র কামিল্যা, যোগেন্দ্রনাথ গুড়িয়া, ভাগু দাস — এরা আত্মগোপন করে সংগ্রাম চালাতে থাকে। ১৯৫০ সালের পর আর এই সংগ্রাম চালানো সম্ভব হয় না। ডিফেন্স কমিটি করে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করেন প্রভাস রায়, পলাশ প্রামাণিক প্রমুখ। কাকদ্বীপের সংগ্রাম বাংলার তেভাগা সংগ্রামের এক অমর অধ্যায় রচনা করে। যার ফলে কমরেড রবি নারায়ণ রেড্ডির মত কমরেড কংসারি হালদারও আত্মগোপনে থেকে বহু ভোটে জিতে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন ওই এলাকা থেকে।

_________________________________________________

*লেখক বাংলার কৃষক আন্দোলনের অন্যতম েনতা ও রাজ্যের প্রাক্তন সিপিএম মন্ত্রী।

(পুনর্মুদ্রণ ঃ তেভাগা লড়াই ও গণশক্তির সৌজন্যে প্রাপ্ত)

'নানারঙে' পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।

http://bangalnama.wordpress.com/2010/09/13/krishak-sangrame-ek-amar-adhyay/


বর্তমান ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহ — একটি প্রাথমিক আলোচনা

অগাষ্ট 19, 2013 মন্তব্য দিন

 

পূর্ব-কথা

ভারতীয় বিপ্লবের সামনে হাজার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর একটা বড় অংশই অবশ্য বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের যে সামগ্রিক বিপর্যয় চলছে তার সাথে অঙ্গীভূত হয়ে রয়েছে। এত দিনের সমাজতন্ত্র অনুশীলনের ব্যর্থতার কারণগুলি গভীরভাবে অনুসন্ধান এবং তার থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুনভাবে চলার একটা সাধারণ রূপরেখা নির্ণয়ের উপর বহুলাংশে নির্ভর করবে এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার উপায়। কিন্তু ভারতীয় বিপ্লবের ক্ষেত্রে এই সাধারণ সমস্যা ছাড়াও একটি অতিরিক্ত সমস্যা আছে। শুধু এর বিশালত্ব নয়, বহু জাতিসত্তার এই দেশের সীমাহীন বৈচিত্র্য, বহু বর্ণাঢ্য আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, অর্থনৈতিক বিকাশের জটিল ইতিহাস, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও জাতপাত প্রথা সহ ধর্ম ও সংস্কৃতির এক একান্ত নিজস্বতা, সর্বোপরি বহু জাতিসত্তার একটি দেশ হয়েও একটি একক ভারতীয় মানসিকতা এবং একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার মধ্যে যে টানাপোড়েন— এ সবই এই দেশটিকে ঠিক মতো বুঝে ওঠার ক্ষেত্রে এক বিশাল বাধা। এ বাধা অতিক্রম করে সম্পূর্ণ নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিতে এই দেশকে বিশ্লেষণ করে একে ঠিক ঠিক বুঝতে পারা এমনিতেই এক দুরূহ কাজ। এ কাজ করার মতো একটি কমিউনিস্ট পার্টি তো নেই-ই, এমনকি এটি আংশিকভাবে করতে গেলেও আত্মমুখিনতাকে যেভাবে পরাস্ত করতে হবে, যে সাহসভরে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তা করতে সক্ষম বা ধাপে ধাপে সেই সক্ষমতা অর্জনের দিকে এগোচ্ছে এমন কোন স্পষ্ট ছবি দেখা যাচ্ছে না।

এমনিতেই আত্মমুখিনতার ঝোঁক ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বরাবরই লক্ষিত হয়েছে। তারই পরিণতিতে হয় দক্ষিণপন্থী নয়ত অতিবামপন্থী বিচ্যুতি ধারাবাহিকভাবে এ আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ১৯৬৭-তে শুরু হওয়া ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবী আন্দোলনও এ রকম একটি জটিল দেশকে দেখতে শুরু করেছিল ঐ ঐতিহ্যের পরম্পরা বহন করেই। ফলে এই মহান আন্দোলন ভারতের বুকে চেপে বসা সংশোধনবাদের একচ্ছত্র আধিপত্যকে এক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেললেও, সশস্ত্র সংগ্রামের ও কৃষি বিপ্লবের প্রশ্নটি আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে অত্যন্ত জোরের সাথে উত্থাপিত করলেও, আমাদের দেশটিকে ঠিক মত বোঝার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই একপেশে হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হলো যখন তখনকার অবিসংবাদী আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব চীনের কমিউনিস্ট পার্টিও তার ভারতীয় কমরেডদের একপেশেপনা, আত্মমুখিনতা ও অদূরদর্শিতাকে প্রকারান্তরে উত্সাহ দিয়ে ফেললো। এ সবের যোগফলে বিগত চার দশকের বেশি সময় জুড়ে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের রণনীতি ও রণকৌশল নির্ণয়ে বারবার ভুল হয়েই চলেছে এবং এখনও এই দুষ্টচক্র থেকে বেরোবার কোন স্পষ্ট লক্ষণ নেই।

প্রতিটি দেশের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। তাই প্রতিটি দেশেরই বাস্তব অবস্থার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেই সে দেশের বিপ্লবের প্রকরণ নির্ণয় করতে হয় এবং এ কাজটির দায়িত্ব সব চেয়ে ভালভাবে নিতে পারে সেই দেশেরই কমিউনিস্ট পার্টি, অন্য কোন দেশ নয়, অন্য কোন আন্তর্জাতিক কেন্দ্রও নয়। কাগজে কলমে কোথাওই এ সত্য অস্বীকার না করেও অনুশীলনের সময়ে তাকে লঙ্ঘন করাই যেন একটি বড় পর্যায় জুড়ে পৃথিবীর কমিউনিস্ট আন্দোলনের দস্তুর হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশেও প্রায় প্রথম থেকেই ভিন্ন দেশের কোনও কমিউনিস্ট পার্টি বা আন্তর্জাতিক কেন্দ্র দ্বারা পরিচালিত হবার সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। এটি শুধু আমাদেরই সীমাবদ্ধতা নয়, যাঁরা পরিচালিত করার চেষ্টা করেছেন তাঁদেরও ভ্রান্তি। এ ভুলেরই একটি মূর্ত প্রকাশ যা গত কয়েক দশক পৃথিবীর কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পীড়িত করেছে, তা হচ্ছে যে কোন দেশের বিপ্লবকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে দেবার চেষ্টা। মতাদর্শগতভাবে দুর্বল (যেটা প্রায় ধরেই নেওয়া যায়) একটি কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে বিপদ হলো যখনই সে বুঝতে পারলো কোনও একটি দেশের ধাঁচে তার দেশের বিপ্লব সংঘটিত হবে তখন অনিবার্যভাবে সেই 'মডেল' দেশটির মত করে নিজের দেশকে ভাবতে শুরু করা। সেই দেশের সাথে তার নিজের দেশের মিলগুলিকেই সে দেখতে পায়। যেন তীব্রভাবে দেখতে চায় বলেই দেখতে পায়। অমিলগুলিকে দেখতে চায় না বলেই দেখতে পায় না। এটি কোনও সততা অসততার প্রশ্ন নয়। এটি দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। আমাদের দেশে এই সমস্যাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি। ১৯৬৭ থেকে '৭০ পর্যন্ত এখানকার কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের এমন দ্বিধাহীন ও অকুণ্ঠ সমর্থন সে দিয়ে গেছে যে এখানকার কমিউনিস্টরা ভাবতে শুরু করলো ঠিক চীনের মত করেই আমাদের দেশের বিপ্লব হবে। তারপর বিপদ যখন ঘনীভূত হয়ে গেছে তখন সিপিআই(এমএল)-এর প্রতিনিধিদের দেওয়া নিজের দেশকে চেনার পরামর্শ তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। '৬৭-র মে থেকে শুরু হওয়া সিপিসি-র লাগাতার সমর্থন ভারতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত এমনভাবে এখানকার কমরেডদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে যে তারপর আর রাশ টানার অবকাশ ছিল না। আন্দোলনের একেবারে প্রথম পর্বে যে মোহাচ্ছন্নতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যে মোহাচ্ছন্নতা একটি বিশেষ দৃষ্টিতে ভারতকে দেখতে শিখিয়েছে তা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের একটা বড় অংশকে আজও আক্রান্ত করে রেখেছে। আমাদের দেশকে, বিগত দশকগুলিতে যে সব গভীর পরিবর্তন এ দেশে ঘটে গেছে তা সহই মুক্ত মনে, নতুন করে দেখার ক্ষেত্রে বিশাল প্রতিবন্ধকতা আজও থেকে গেছে।

এরই সঙ্গে একবিংশতি শতকের কমিউনিস্টদের বহু কিছুই একটু নতুন করে দেখা ও ভাবা ও একটু সাহস ভরে অতীতের অবস্থানগুলি নতুন করে মূল্যায়ন করার ব্যাপারে যে সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি হয়েছে তাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিরাট বিপর্যয় একদিকে যেমন হতাশার আবহাওয়া তৈরি করেছে একই সঙ্গে তা মডেল সর্বস্বতাকে ভেঙে নতুন সৃষ্টির বৈষয়িক ভিত্তি তৈরি করেছে। কোন পূর্বধারণায় আচ্ছন্ন না থেকে আমাদের দেশকে বোঝার চেষ্টা করাই সম্ভবত এই দশকে ভারতের কমিউনিস্টদের অন্যতম একটি বড় কাজ, এ কাজে অবশ্যই বিপদ আছে। আত্মমুখিনতা যখন একটি চিহ্নিত ব্যাধি তখন এ কাজ করতে গিয়ে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা তো থাকবেই! সে ব্যাপারে সাধ্যমত সতর্ক থেকেই আমরা বর্তমান নিবন্ধে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। উল্লেখ করে নেওয়া ভালো যে বর্তমান ভারতকে বোঝার জন্য আমরা ২০০৪-০৫ এর তথ্যকেই হাতিয়ার করতে বাধ্য হয়েছি। এর পরের কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য আমরা পাই নি।

প্রথমে ঔপনিবেশিক আমলের ভারতীয় অর্থনীতির কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে শুরু করা যায়। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে ঐ গোটা পর্যায় জুড়ে ব্রিটিশ শাসন ভারতের অর্থনীতিতে পুঁজির স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করে এক বিকৃত বিকাশ চাপিয়ে দিয়েছিলো। এ ব্যাপারেও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতের কৃষিক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন সম্পর্কে টিকিয়ে রেখেছিল। দেশে উত্পাদিত কাঁচামাল নিজেদের দখলে রেখে তা ইংল্যান্ডের শিল্পের জন্য যোগান দেওয়া, এ দেশের অত্যন্ত সীমাবদ্ধ পণ্যবাজার বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া, লগ্নী পুঁজির অনুপ্রবেশ, বাণিজ্যিক পুঁজির প্রাধান্য, শিল্পপুঁজির বিকাশকে করে তুলেছে ধীরগতি ও বিকৃত। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে সামন্ততন্ত্রের ক্ষয়ও হয়েছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। ১৭৯৩ সালে কর্ণওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে জমিদারদের হাতে জমি কেনাবেচার অধিকার অর্পণ করে জমিদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং এইভাবে তাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়াও করে ফেলে। ঔপনিবেশিক ভারতে অর্থনৈতিক বিকাশের এই ছকটি আমাদের চেনা এবং বহুচর্চিত। কিন্তু যে বিষয়টা কমিউনিস্ট বিপ্লবী মহলে বিশেষ আলোচিত হয় না তা হলো ধীর এবং বিকৃত পুঁজিবাদী বিকাশের সাধারণ কাঠামোর মধ্যেই ভারতে শিল্পপুঁজির স্থিরগতি ও আপেক্ষিকভাবে উন্নত এক বিকাশের ইতিহাস যা অন্যান্য কোনও পশ্চাত্পদ ঔপনিবেশিক দেশের পুঁজির বিকাশের সঙ্গে তুলনীয় নয়। কেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু আগে ১৯২৫ সালে এক বক্তৃতায় কমঃ স্ট্যালিন এই বিশেষত্বটির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন, আশ্চর্যজনকভাবে তা কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরে কোনও মনোযোগ দাবী করেনি। অথচ আজকের ভারতকে বুঝতে প্রাক-'৪৭ ভারতের এই বিশিষ্টতাকে হিসেবে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি বিষয়। (প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক এবং নির্ভরশীল দেশগুলির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচ্যের শ্রমজীবী মানুষের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য। রচনাবলী ৭ম খণ্ড) আজকের ভারতকে বস্তুনিষ্ঠভাবে বুঝতে চেষ্টা করার প্রারম্ভবিন্দু হিসেবে প্রায় এক শতাব্দী আগের স্ট্যালিনকৃত মূল্যায়নটির অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা প্রাসঙ্গিক অংশটি উদ্ধৃত করছি।

''আজকের সময়ের উপনিবেশ এবং নির্ভরশীল দেশগুলির নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আজ আর কোন একক এবং সাধারণ সূত্রবদ্ধ ঔপনিবেশিক প্রাচ্যের অস্তিত্ব নেই। আগে ঔপনিবেশিক প্রাচ্যকে দেখা হতো একটি সমসত্ত্ব বিশিষ্ট সমগ্র হিসেবে। আজ আর সেই ছবিটি বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আজ আমাদের সামনে রয়েছে ঔপনিবেশিক এবং নির্ভরশীল দেশের অন্ততপক্ষে তিনটি বর্গ। প্রথমতঃ মরক্কোর মত দেশগুলি,যেখানে সর্বহারার হয় কোন অস্তিত্ব নেই, বা থাকলেও খুব কমই আছে এবং যেগুলি শিল্পগতভাবে খুবই অবিকশিত। দ্বিতীয়ত চীন ও মিশরের মত দেশগুলি, যেগুলির শিল্পগতভাবে স্বল্পোন্নত এবং যেখানে আপেক্ষিকভাবে কম সংখ্যক সর্বহারার উপস্থিতি রয়েছে। তৃতীয়ত ভারতের মত দেশ যেগুলি পুঁজিবাদী রূপে কমবেশি উন্নত এবং যেখানে আছে কমবেশি প্রচুর সংখ্যক জাতীয় সর্বহারার উপস্থিতি।

স্পষ্টতই এই সকল দেশকে সম্ভবত একে অপরের সমতুল হিসেবে উপস্থিত করা যায় না।''

কমঃ স্ট্যালিনের এই বক্তব্য আজকের ভারতীয় অর্থনীতি তথা রাজনীতি বোঝার জন্যই শুধু নয়, আগেকার ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে পুঁজিবাদের বিকাশধারাকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত সেই বিচারেও অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। বিগত কয়েক দশক ধরে কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরে লালিত ও সম্পূর্ণ প্রশ্নহীনভাবে গৃহীত দুটি স্বতঃসিদ্ধকে এ বক্তব্য নতুনভাবে ভাবাকে উত্সাহিত করে। প্রথমতঃ প্রায় এক শতাব্দী আগেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যে থেকেও ভারতে পুঁজিবাদের এই আপেক্ষিক বিকাশ কীভাবে সম্ভব হলো এবং তারই গতিধারায় পরের প্রায় ১০০ বছরে পুঁজিবাদের ক্রমবিকাশ কোথায় গিয়ে পৌঁছুতে পারে! দ্বিতীয়তঃ সমস্ত পৃথিবীকে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক— এই দুই প্রশস্ত বর্গে ভাগ করে এর একেকটিকে সম্পূর্ণ সমসত্ত্ব ভাবার নিশ্চিন্ত ও সাদরে লালিত অভ্যাসটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই অতিসরলীকরণের ঝোঁক বিষময় পরিণতির জন্ম দিয়েছে। ঔপনিবেশিক দেশের বিপ্লবের সবচেয়ে সফল অভিজ্ঞতায় দেশটির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রমাণ করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা বিগত কয়েক দশকের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রেখেছে। অথচ কমরেড স্ট্যালিন গত শতাব্দীর প্রায় গোড়ার দিকেই ঔপনিবেশিক দেশগুলির সমসত্ত্বতার ধারণাকে নাকচ করে ভিন্নতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং তা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদের বিকাশের মাত্রার ভিন্নতাকেই মানদণ্ড করেছেন। তারও আগে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত ''সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর'' গ্রন্থে লেনিন পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের যুগে পৃথিবীকে উপনিবেশের মালিক দেশসমূহ আর তাদের উপনিবেশ, কেবলমাত্র এ দুভাগে ভাগ না করে নির্ভরশীল দেশগুলির বহুবিচিত্র রূপের কথা উল্লেখ করেন। ''ফিনান্স পুঁজি এবং তার বিদেশ নীতি… রাষ্ট্রীয় নির্ভরশীলতার (State dependence) অনেকগুলি উত্ক্রমণকালীন রূপের জন্ম দেয়। উপনিবেশের মালিক এবং উপনিবেশসমূহই কেবলমাত্র নয় নির্ভরশীল দেশগুলির, যারা রাজনৈতিকভাবে এবং আনুষ্ঠানিক অর্থে স্বাধীন,কিন্তু কার্যতঃ আর্থিক এবং কূটনৈতিক নির্ভরতার জালে জড়িয়ে রয়েছে, বহু বিচিত্র রূপ এই যুগের বৈশিষ্ট্য। আমরা ইতিমধ্যে নির্ভরতার একটি রূপ উল্লেখ করেছি — আধা-উপনিবেশ। আর একটির উদাহরণ হচ্ছে আর্জেন্টিনা। রাজনৈতিক স্বাধীনতা সহই আর্থিক ও কূটনৈতিক নির্ভরতার কিছুটা ভিন্নতর রূপের উদাহরণ হচ্ছে পর্তুগাল।'' লেনিন বা স্ট্যালিন কেউই দুটি বর্গের কঠোর, অপরিবর্তনযোগ্য বিভাজন হিসেবে পৃথিবীকে ভাগ করেন নি। সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক এ ধরনের মোটা দাগের বিভাজন মানলেও পুরো দৃশ্যপট জুড়ে অন্তর্বর্তীকালীন নানা রূপের অস্তিত্বের কথাও বলেছেন। এ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করতে হলো এই কারণেই যে আজকের ভারত যে মূলগতভাবে বিপ্লব-পূর্ববর্তী চীনেরই মতই তাকে যেনতেনভাবে প্রতিষ্ঠা করার যে 'মতান্ধ' মনোভাব বিগত সাড়ে চার দশক জুড়ে কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তার হাত থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। এ আচ্ছন্নতা না কাটলে তথ্য থেকে সত্যে পৌঁছনর প্রক্রিয়াতেই ঢোকা সম্ভব নয়।

প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতে পুঁজিবাদের আপেক্ষিক বিকাশ

১৯২৫ সালেই যে ঔপনিবেশিক দেশগুলির মধ্যে কমবেশি বিকশিত পুঁজিবাদের দেশ হিসেবে কেবল ভারতের নামই উল্লেখিত হলো তার কারণ বুঝতে গেলে বিংশ শতাব্দীর বহু আগে থেকেই এর উত্স সন্ধান করতে হবে। নিশ্চয়ই ভারতের অতীত ইতিহাসের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেইসব উপাদান যা অন্যান্য যে কোন উপনিবেশিক দেশের তুলনায় ভারতে পুঁজিবাদী উত্পাদনের উদ্ভব ও বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছিল। অসংখ্য স্ববিরোধী উপাদানের সংমিশ্রণ অত্যন্ত প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় ইতিহাসকে একই সঙ্গে করে তুলেছে জটিল ও বর্ণময়। ভারতের উত্পাদন শক্তির বিকাশের ইতিহাসও এই বৈশিষ্ট্যটি দ্বারা চিহ্নিত। অতীতকাল থেকেই জাতিভেদ প্রথা যেমন সামন্ততন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার এক বিশেষ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে উত্পাদনের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তেমনি এর বিপরীতে উন্নত সেচ ব্যবস্থা আবার ভারতীয় কৃষিপদ্ধতিকে বিকশিতও করেছিল। আর ফলে চালু হয়েছিল পণ্যোত্পাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে আমাদের দেশে কুটির শিল্পের সমৃদ্ধি আজ রূপকথার কাহিনীতে পরিণত হয়েছে। রেশম ও বস্ত্র শিল্প-জাত পণ্য রীতিমতো বিদেশে রপ্তানি হতো। সুরাট, আমেদাবাদ, ঢাকা, কাশিমবাজার ইত্যাদি শিল্প ও বাণিজ্যের বড় বড় কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। তীব্র জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব সত্ত্বেও সমাজে এক ধরনের গতিময়তাও বজায় ছিল। জাতিভেদ প্রথাকে কখনই একটি শিলীভূত বিমূর্ত ''বর্ণাশ্রম'' প্রথায় আটকে রাখা যায়নি। জন্মলাভ করেছিল অসংখ্য ছোট ছোট 'জাত', যার সদস্যরা অভিন্ন পেশা, ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়মকানুন, বিবাহ-ব্যবস্থা ও খাদ্যাভ্যাস দ্বারা একটি নির্দিষ্ট 'জাত' হিসেবে চিহ্নিত হতো। 'নিম্ন জাত'-এর মানুষদের মধ্যে লক্ষ্য করা যেতো 'উচ্চ জাত'-এর রীতিনীতি, আচার ব্যবহার আয়ত্ত করে সমাজে উপরে ওঠার এক চেষ্টা। রাজনৈতিক ব্যবস্থা সাধারণভাবে খুব সুদৃঢ় না থাকার কারণে এবং উদ্বৃত্ত জমির অভাব না থাকার জন্য বিভিন্ন জাতের মানুষদের দেশান্তর যাত্রাও (migration) বেশ প্রচলিত ছিল। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণ স্থবিরত্বের মধ্যে এগুলি এক ধরনের চলিষ্ণুতা সৃষ্টি করতো। সব চেয়ে বড় আলোড়ন তৈরি হতো যখন জাতিভেদ প্রথা সহ অন্যান্য সামাজিক অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষক ও হস্তশিল্পীরা বিদ্রোহে ফেটে পড়তেন। কৃষি-জমির অসাধারণ উর্বরতা, হস্ত ও কুটির শিল্পের অগ্রগতি, পণ্যসামগ্রীর অন্তর্দেশীয় ও বহির্বাণিজ্য— এ সবই সামন্ততন্ত্রের জড়ত্ব ভেঙে উন্মেষশীল পুঁজিবাদের লক্ষণাক্রান্ত ছিল। এরই প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতিতে প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগেই ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্ফুরণ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি দৃষ্টিগোচর হয়।

ভারতের পশ্চিম উপকূলে কয়েক শতাব্দী জুড়ে বহির্বাণিজ্যের বড়-বড় ঘাঁটি ছিল ইংরেজরা ভারতে আসার বহু আগে থেকেই। এ সব কেন্দ্রে ব্যবসা চালাত গুজরাতের জৈন ও হিন্দু বণিকেরা, বোহরা মুসলমান ও কোঙ্কণি সওদাগররা। বহির্বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র সুরাট থেকে মোগল সাম্রাজ্যের শাসনকেন্দ্র দিল্লী-আগ্রা পর্যন্ত বাণিজ্যপথ চলে গেছিল রাজস্থানের মধ্য দিয়ে। সেখানকার মারোয়াড় ও শেখাওয়তি অঞ্চলের বণিকেরা অন্তর্বাণিজ্য ও মহাজনি ব্যবসায়ে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিল এবং ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তরপ্রদেশ, বিহার, বাংলা, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত। মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্য বিস্তার করেছিল পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়। সাবেকী ও ঐতিহ্যশালী জাত ব্যবসায়ী ছিল বাংলার গন্ধবণিক ও সুবর্ণ বণিকরা, মাদ্রাজের চেট্টি সম্প্রদায়, আরও দক্ষিণে তামিল মুসলমান ব্যবসায়ীরা, কেরালায় মোপলা ও খ্রিস্টানরা, কোঙ্কণের ব্রাণেরা। এদের সকলেরই যুগ যুগ ধরে বহির্বাণিজ্যের অভিজ্ঞতা ছিল। এ সময়ে ব্যবসা ছিল অবাধ প্রতিযোগিতামূলক। ফলে সাধারণভাবে ছিল তেজি। আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ পরিস্থিতি বজায় ছিল। এ সময় থেকে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য শুরু হলো। দেশি ব্যবসায়ীবৃন্দ বড় রকম ধাক্কা খেলো। কিন্তু আমরা দেখবো নিজদেশের শক্ত মাটির উপর দাঁড়িয়ে ভারতীয় সওদাগরেরা দেশজুড়ে যে জাল বিস্তার করেছিল তাকে কখনই ইংরেজরা নিশ্চিহ্ন করতে পারে নি। যখন যেখানে সে সুযোগ পেয়েছিল সেখানেই সে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করে। পরবর্তীকালের ভারতীয় পুঁজির গতিপ্রকৃতি বুঝতে হলে সূচনাকালটি আমাদের খেয়ালে রাখতে হবে।

উপনিবেশিক ভারতে বিদেশি পুঁজি ও তার ফলাফল

ভারতে ইংরেজদের শোষণের একেবারে প্রথম পর্বটি ছিল বাণিজ্যিক শোষণের। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত ছিল এর আয়ুষ্কাল। এই পর্বটি পাকাপোক্তভাবে শুরু হওয়ার আগে ভারতের বাজারে বিদেশে রফতানির পণ্য ক্রয়ের জন্য ওলন্দাজ, ফরাসী ও ইংরেজদের মধ্যে ছিল প্রতিযোগিতা। দিশি বণিকরা হস্তশিল্পীদের দাদন দিত বলে অর্থনৈতিক জগতে তাদেরও একটি ভূমিকা ছিল। তাদের পুঁজির জোর এবং রাজনৈতিক প্রতিপত্তিও কম ছিল না। ইংরাজরা প্রথমে ওলন্দাজ ও ফরাসিদের কোণঠাসা করে। তারপর ধীরে ধীরে রপ্তানিযোগ্য পণ্য ক্রয়ের এক শক্তিশালী জাল বিস্তার করে। দিশি বণিকদের এর ফলে হয় অন্তর্বাণিজ্যেই আটকে থাকতে হয়। নয় তো ইংরাজ বণিকের অধীনস্থ হয়ে বহির্বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে হয়। ইংরেজদের বাণিজ্যিক শোষণের এই পর্বের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল প্রত্যক্ষ লুণ্ঠন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য, ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভারতীয় পুরো সারা (finished) উত্পাদন সামগ্রী অস্বাভাবিক কমদামে কিনে রপ্তানি। এই বাণিজ্য ইংরেজরা চালাত উদ্বৃত্ত রাজস্ব ''বিনিয়োগ'' করে। অনেকটা মাছের তেলে মাছ ভাজার মত। এইভাবেই শুরু হয়েছিল ভারত থেকে ''সম্পদ-নির্গমন।'' প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের আগে পর্যন্ত ভারতে রপ্তানির জন্য পণ্য ক্রয় করতে বিদেশি বণিকদের এ দেশে স্বর্ণ বুলিয়ন ঢালতে হতো। ১৭৫৭-র রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর একদিকে তাঁতিদের উপর ইংরেজ এজেন্সীগুলির অত্যাচার বাড়লো। অন্যদিকে কেবলমাত্র বিদেশিরা বা তাদের বশংবদ দেশি বেনেরাই কাপড় কেনার এজেন্সি পেল। মোট কথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হলো আর সাধারণভাবে দেশি বণিকদের ব্যবসা সংকুচিত হলো। ননের দেওয়ানি আর উচ্চ সুদে ইংরেজদের টাকা ধার দেওয়ার মধ্যে তাদের ব্যবসা আটকে গেলো।

১৮১৩ থেকে ইংরেজদের শোষণের ধরন পাল্টে গেল। এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে ইংল্যান্ডের শিল্প-বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি। এই সময় থেকে শুরু হলো তথাকথিত অবাধ-বাণিজ্যভিত্তিক (free trade) শিল্প-পুঁজির শোষণ। ভারত অতিদ্রুত পরিণত হলো ইংল্যান্ডের বস্ত্র শিল্পের বাজারে। এখানকার চিরাচরিত হস্ত শিল্পকে ধ্বংস করা হলো। আর শিল্পের জন্য কাঁচামালের উত্স হিসেবে এ দেশকে ব্যবহার করা শুরু হলো। এই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার শেষ হলো। নতুন ব্যবসায়ী হিসেবে উঠে এল কোম্পানির প্রাক্তন ও বর্তমান ইংরেজ চাকরেরা যারা পুঁজি সৃষ্টি করেছিল কোম্পানির লুঠ করা পয়সায়। এরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়াগিরি ধ্বংস করে কার্যত ইংরাজগোষ্ঠীরই একচেটিয়া ব্যবসা গড়ে তুললো আর তা করা হলো অবাধ বাণিজ্যের নাম করে। এদের হাতে সঞ্চিত অর্থই ভারতে বিদেশী পুঁজির প্রাথমিক উত্স। এই সময় থেকেই আবার ব্যাংক ব্যবসায়েও দিশি বণিকদের আধিপত্য কমতে থাকে। ফলে ভারতীয়রা ব্যাংক থেকে ঋণ পেত না। ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরের টাকার বাজারেও দিশি পুঁজি মার খেতে থাকে। টাকার বাজারে যখনই মন্দা দেখা দিত আর দিশি বণিকরা টাকা ধার দিয়ে উঁচু হারে সুদ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিত তখনই সরকার রাজস্ব থেকে ইংরেজ ব্যবসায়ীদের কম সুদে ধার দিয়ে এ দেশের মহাজনী ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ভারতে ইংরেজদের লগ্নী পুঁজির শোষণ শুরু হয়। ভারতে রপ্তানি হয় খানিক ব্রিটিশ পুঁজি আর তার সাথে এদেশে গড়ে ওঠে ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্ক, আমদানি রফতানির অফিস এবং ম্যানেজিং এজেন্সির এক সুবিস্তীর্ণ শৃঙ্খল। ভারতে বিনিয়োগকৃত ব্রিটিশ পুঁজির পরিমাণ মোটেই খুব বেশি ছিল না। পৃথিবীতে বিনিয়োজিত ইংরাজ পুঁজির মাত্র ১৪% এশিয়াতে এসেছিল। ভারতে নিশ্চয়ই শতাংশের হিসেবে আরো কমে যাবে। কিন্তু ভারতে ব্রিটিশের এই বিনিয়োগ তার পরিমাণের তুলনায় তাত্পর্যে ও গুরুত্বে অনেক বেশি ছিল। ১৮৫৪-১৮৭০ পর্বে ভারতে ১৫ কোটি পাউন্ড স্টারলিং বিনিয়োগ হয়, যার অর্ধেকই ছিল রেল কোম্পানিতে। ১৯০৯-১০ সালের একটি হিসেবে দেখা যায় ৩৯% পুঁজি ঢালা হয়েছে রেল কোম্পানিতে ৫০% সরকারি ও মিউনিসিপ্যাল ঋণ হিসেবে, আর সামান্য যেটা পড়ে থাকে তা বিনিয়োজিত হয়েছে চা, কফি, রাবার বাগিচায়, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোনে, খনিজ ও পেট্রলে আর সওদাগরি কোম্পানি ও ব্যাঙ্কে। বিনিয়োগের ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিকাশের বিশেষত: শিল্পের বিকাশের দিকে কোন লক্ষ্যই এ বিনিয়োগের ছিল না। বরং ধরনটি ছিল রপ্তানি ও বিদেশী চাহিদার মুখাপেক্ষী। কেন আরও বেশি বিদেশী পুঁজি ভারতে এল না, তার উত্তরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন বিষয়ের উপর জোর দেন। ভারতে আরও শিল্পবিকাশ তাদের নিজেদের দেশের শিল্পকে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে সেদিকে সরকারের একটা নজর তো ছিলই, তা ছাড়া একটা বড় কারণ ছিল অত্যন্ত গরীব দেশ ভারতে চাহিদার অভাব। পরিমাণ যতই কম হোক না কেন, বিদেশী পুঁজির আধিপত্য স্থাপন হয়েছিল উপনিবেশিক শাসন ও অর্থনীতির সামগ্রিক কাঠামোটির জোরে। এই কাঠামোটিই সর্বতোভাবে ইংরেজ ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েমে সাহায্য করেছিল— ইংরেজ বণিক সমিতিগুলি, ইংরেজ আমলাবাহিনী, ইংরেজ ম্যানেজিং এজেন্সী ও ব্যাংকের জোরে।

ঔপনিবেশিক আমলে দেশী পুঁজির অবস্থা

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশশক্তির উপস্থিতি যে বহু বিচিত্র উপায়ে দেশীয় পুঁজির বৃদ্ধি ও বিকাশকে রুদ্ধ করার জন্য তত্পর থাকবে তা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। এমন কি কার্ল মার্কস যে রেলপথকে ''ভারতীয় শিল্পের অগ্রদূত'' বলে বর্ণনা করেছিলেন দেখা গেল তাও ব্যবহার হলো শুধু বহির্বাণিজ্যের পক্ষে প্রয়োজনীয় বন্দরগুলির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য। আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও শিল্প বিকাশের দিকে কোন নজরই ছিল না। ভাড়ার বিন্যাসও এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে বন্দর-অভিমুখী কাঁচামালের আর বন্দর থেকে অন্তর্দেশ-অভিমুখী শিল্পদ্রব্যের ভাড়া অত্যন্ত কম থাকে, আর উল্টোদিকের ভাড়া অনেক বেশি থাকে। পরে অবশ্য মার্কসই বলেছিলেন ব্রিটিশ ভারতে রেলপথ স্থাপনা ভারতীয়দের কাছে অর্থহীন। বৈষম্যমূলক শুল্ক, অবাধ বাণিজ্যের (laissez faire) মুখোশের আড়ালে শুধু ইংরেজদের উদ্যোগগুলিকে সহায়তা দেওয়া, অর্থকরী ফসল চাষের জন্য কেবলমাত্র ইংরেজদেরই জমি দেওয়া, ভারতীয় অর্থনীতিকে শুধুমাত্র রপ্তানির প্রয়োজনের সঙ্গে জুড়ে রাখা, সর্বোপরি সমস্ত অর্থনীতিকেই সাধারণভাবে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার এক ক্রমান্বয় প্রচেষ্টা ভারতে ইংরেজ ঔপনিবেশিক পলিসির কয়েকটি মূল স্তম্ভ।

কিন্তু এতসব সত্ত্বেও এ সমগ্র পর্ব জুড়ে দেশি পুঁজি একেবারে লপ্ত হয়ে গিয়েছিল এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। অবশ্যই তার নিজস্ব একটা ধরন ছিল এবং অবশ্যই ছিল ইংরেজ আধিপত্যের অধীনস্থ। দেশী পুঁজি ছিল বেশ কিছু ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে, মহাজনী কারবারে, বিলিতি পণ্যের এ দেশে বিক্রেতা হিসেবে, এ দেশের রপ্তানিযোগ্য কাঁচামালের খুচরো বা পাইকারি কারবারী হিসেবে। আর আধিপত্যকারী ইংরেজ পুঁজি খাটতো জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে, ম্যানেজিং এজেন্সিতে, আমদানি-রপ্তানির বৈদেশিক বাণিজ্যে, ব্যাঙ্ক-বীমা-জাহাজ কোম্পানিতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই চিত্র কিন্তু কখনই স্থায়ী রূপ পায় নি। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে দিশি ব্যবসায়ীদের যে জোরের কথা আমরা বর্ণনা করেছি ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ পুঁজির পূর্ণ আধিপত্যের সময়ও কিন্তু তা নিঃশেষ হয়ে যায় নি। প্রথম থেকেই সে তার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে গেছে। এ লড়াই চালাতে চালাতে যখনই কোন অনুকূল পরিস্থিতি সে পেয়েছে তখনই চেষ্টা করেছে ইংরেজ পুঁজির সঙ্গে টক্কর দিতে। প্রথম ও দ্বিতীয় এই দুই বিশ্বযুদ্ধের পরে পরেই দেশি পুঁজি বিভিন্ন মাত্রায় তার শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত পূর্বে উল্লেখিত দেশি পুঁজির মূল ভূমিকা ছিল মহাজনি বা বাণিজ্যিক। পরবর্তীকালে এই পুঁজি কীভাবে ধীরে ধীরে উত্পাদনের জন্য বিনিয়োগ হতে শুরু করলো তা এক চিত্তাকর্ষক গবেষণার বিষয় হয়ে রয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে এই প্রক্রিয়াটির লীলাভূমি পূর্বভারত না হয়ে কেন পশ্চিম ভারত হলো সেটিও একটি মনোগ্রাহী আলোচনার বিষয়। দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে দু এক কথা এখনই বলে নেওয়া যায়। বাংলায় কেন দেশি পুঁজি শিল্পে যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োজিত হল না, তা নিয়ে প্রচুর পরস্পর বিরোধী তত্ত্ব আছে। বাঙালী ভদ্রবাবুদের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে যারা দায়ী করেন তারা ব্যাখ্যা করতে পারেন না কেন ব্রাহ্মসমাজভুক্ত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশিষ্ট বাঙালীরাও এ ব্যাপারে ব্যর্থ হলো। যাঁরা বলেন বাঙালী ধনীরা জমিদারি কিনতে বেশি প্রলুব্ধ হয়েছিল তাঁদের তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে অনেক ঐতিহাসিক দেখিয়েছেন আসলে শিল্প-উদ্যোগে ব্যর্থ হয়েই তারা জমিদারি কিনতে বাধ্য হয়েছিল। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা সম্ভবত এই যে পশ্চিম ভারতের তুলনায় এখানে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের নাগপাশ অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারতীয় পুঁজি দুভাবেই খাটতে শুরু করেছিল। একদিকে বিস্তারলাভ করেছিল মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে বাণিজ্যিক পুঁজি, যার পরিসর ছিল উত্তর, পূর্ব ও মধ্য ভারত এবং দক্ষিণভারতের চেট্টিয়ার ব্যবসায়ীরা যাদের বাণিজ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এই দুই গোষ্ঠীর ব্যবসায়ীরাই অন্ততঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ছিল সম্পূর্ণ ইংরেজ নির্ভর এবং ইংরেজদের বেনে হিসেবেই ছিল একমাত্র ভূমিকা। অন্যদিকে ঐ একই সময়ে পশ্চিম ভারতে, প্রথমে বোম্বাই ও কিছু পরে আমেদাবাদে দেশি পুঁজি শিল্প-উত্পাদনে নিয়োজিত হতে শুরু করলো। দুই জায়গাতেই এই শিল্প ছিল মূলতঃ বস্ত্র শিল্প।

বোম্বাই-এর বস্ত্র শিল্পের প্রাথমিক পুঁজি সৃষ্টি হয় রপ্তানি বাণিজ্য থেকে। মালওয়া অঞ্চলে প্রচুর আফিং উত্পাদন হতো যা সরাসরি চীনে রপ্তানি করা হতো। আর ছিল তুলা রপ্তানি। ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে সুতি কাপড়ই ছিল প্রধান উত্পাদন সামগ্রী। ফলে সেখানে তুলোর চাহিদা ছিল বিপুল। সেই চাহিদা মেটানোর উর্বর ক্ষেত্র ছিল দাক্ষিণাত্যের কৃষ্ণমৃত্তিকা। অন্যদিকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের কারণে সেখান থেকে তুলোর রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায় ঠিক এরকম একটি সময়েই। ফলে ম্যাঞ্চেস্টারে তুলোর বিপুল চাহিদা মেটাবার সুযোগ এল বোম্বাই-এর ব্যবসায়ীদের হাতে। ইতিমধ্যে রেললাইন স্থাপন হয়ে যাওয়ায় বোম্বাই বন্দরে মাল পরিবহনের সুযোগ এসে গেছে। সর্বোপরি ইংরেজ শাসনের বনিয়াদ পশ্চিমভারতে অতটা দৃঢ় না থাকায় পূর্ব ভারতে যেভাবে সম্পদ নির্গমন হয়েছে মহারাষ্ট্রে তেমন হয়নি। ফলে ব্যবসাবাণিজ্যের পরিকাঠামো অনেক ভাল ছিল। ব্যবসা ও শিল্পের পক্ষে বোম্বাইতে বিরাজমান এই সুযোগ সুবিধাগুলি ওখানকার সবচেয়ে উদ্যোগী জনগোষ্ঠী পার্সিরা আঁকড়ে ধরলো। পুরনো ধাঁচের ব্যবসায়ীদের মত নানা সামাজিক বাধানিষেধ তাদের ছিল না। সমাজে বিধর্মী বলে পরিচিত হবার ফলে নতুন যে কোন পথে যাত্রা করা তাদের পক্ষে সুবিধাজনক ছিল। ঊনবিংশ শতকের প্রথমভাগে তাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগের সাফল্য ও অভিজ্ঞতা নিয়েই তারা শিল্পের জগতে পা রাখলো। ১৮৫০-এর দশকে নতুন শিল্পের প্রতিষ্ঠা দিয়ে শুরু হয় তাদের উদ্যোগ।

পার্সি শিল্পোদ্যোগের বড় প্রতিভূ অবশ্যই টাটারা। তুলা রপ্তানির ব্যবসা যখন আমেরিকার গৃহযুদ্ধের অবসানে মন্দার ধাক্কা খেলো তখন তারা ইথিওপিয়ার যুদ্ধে কনট্র্যাক্টরি করে পুঁজি সঞ্চয় করে প্রথমে সুতি কারখানা (১৮৭০), পরে বস্ত্র কারখানা (১৮৭৭) স্থাপন করে। ব্রিটিশরা যেহেতু ম্যাঞ্চেস্টারের সঙ্গে ভারতের ভূমি থেকে প্রতিযোগিতা করবে না তাই বস্ত্র শিল্পে কোন বিদেশী বিনিয়োগ তারা করে নি। এর ফলে বোম্বাই-এর সুতো শিল্প ও বস্ত্র শিল্প দ্রুত বেড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমাদের গুরুতর মনোযোগ দাবী করে তা হলো বোম্বাই-এর এই শিল্পবিকাশ মোটেই ম্যাঞ্চেস্টারের সঙ্গে তথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে চরম সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে নি। ম্যানেজিং এজেন্সি ব্যবস্থা ছিল ব্যাঙ্ক, বাণিজ্য ও শিল্পের এক পরস্পরের সঙ্গে সংপৃক্ত ব্যবস্থা। তাই ব্রিটিশ প্রভাবিত এই ব্যবস্থায় থাকার অর্থই হলো ব্রিটিশ পুঁজির সঙ্গে অসংখ্য বন্ধনে জড়িয়ে থাকা। তা ছাড়া বড় কথা হলো কারিগরি ও যন্ত্রপাতির জন্য তো ইয়োরোপের উপর নির্ভর করতেই হতো। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে সাম্রাজ্যবাদী বন্ধন যতই থাক এই পুঁজির মালিকানা ভারতীয় এবং এই মালিকানার অন্তর্লীন প্রবণতা থাকবে সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকা যাতে ঐ বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসা যায়। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এসে ম্যাঞ্চেস্টারের সঙ্গে ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের মুখোমুখি প্রতিযোগিতা।

আমেদাবাদের বস্ত্র শিল্পের বিকাশ বোম্বাই-এর কিছু পরে ঘটে। বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে প্লেগের মহামারীতে বোম্বাই শহর ফাঁকা হতে শুরু করে। ঐ সময়ে চীনেও যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে প্রাচ্যে সুতো রপ্তানির ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর দরুন জোর পড়ে বস্ত্র শিল্পের উপর। এই সময়ই আমেদাবাদের বস্ত্র শিল্পের উত্থান। বোম্বাই-এ পার্সিদের শিল্পোদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে গুজরাতি বেনেরা প্রথমে সুতি কারখানা ও পরে বস্ত্র কারখানায় পুঁজি বিনিয়োগ করে। ভারতের বাজারে বস্ত্র সরবরাহের উপর এদের জোর ছিল এবং তুলনায় উচ্চমানের সুতো ব্যবহার করতো। এর দরুন ল্যাঙ্কাশায়ারের সঙ্গে তাকে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আমলে ব্রিটেনের নিজস্ব রণনীতিগত কারণে তার শিল্প সংক্রান্ত পলিসির কিছু গুরুতর পরিবর্তন হয়। ভারত সরকার তার নিজস্ব আর্থিক প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক বাড়ায়, কিন্তু বস্ত্র শিল্পের এক্সসাইজ অপরিবর্তিত রাখে। এর ফলে ল্যাঙ্কাশায়ার ভারতীয় উত্পাদনের কাছে মার খেতে শুরু করে। এই সময় বোম্বাই এবং আমেদাবাদের বস্ত্র শিল্পে এক বিশাল অগ্রগতির সূচনা হয়। ১৯১৩-১৪ সালে ব্রিটেন থেকে আমদানি করা সূতি বস্ত্র ছিল ৩১০৪ মিলিয়ন গজ, আর ভারতীয় মিলের উত্পাদন ছিল ১১৭১.১ মিলিয়ন গজ। সেখানে ১৯২২-২৩ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৪৫৩ মিলিয়ন গজ ও ১৭২০ মিলিয়ন গজ। অর্থাৎ ল্যাঙ্কাশায়ারের আমদানি থেকে ভারতীয় মিলের উত্পাদন নির্ধারকভাবে ছাপিয়ে গেল। পরবর্তীকালেও এ প্রবণতা অপরিবর্তিত থেকে গেল।

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে পূর্বভারতে শিল্পের বিকাশের অসুবিধার কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। বিড়লাদের হাত ধরেই এই পরিবর্তন সূচিত হয়। আগ্রা-দিল্লী-রাজস্থানের ব্যবসা যখন গুটিয়ে গেল তখন মারওয়াড়ি সম্প্রদায়ের বেনেরা দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে এরা রপ্তানি ব্যবসায়ের দেশীয় পাইকার হিসেবে প্রচুর পয়সা করে। এই গোষ্ঠীর মুখ্য প্রতিনিধি বিড়লা। ১৮৫৭ সালে বর্তমান বিড়লা গোষ্ঠীর আদি পুরুষ শিবনারায়ণ বিড়লা আমেদাবাদ থেকে বোম্বাই পৌঁছায়। আফিং ও তুলোর ব্যবসা করে যখন ফলে ফেঁপে উঠছিল তখনই বোম্বাই-এ প্লেগ শুরু হয় এবং প্লেগের ভয়ে কলকাতায় পালিয়ে এসে আফিং আর পাটের ব্যবসা শুরু করে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় পাটের চাহিদা তেজি হয়ে ওঠায় তার পত্র ও পৌত্র তাদের পুঁজি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে সমর্থ হয়। এই পৌত্রটির নাম জি ডি বিড়লা যে তার পয়সার জোরে ইংরেজ কোম্পানি থেকে একের পর এক শিল্প কারখানা কিনতে থাকে। কেশোরাম কটন, মর্টন চিনি কারখানা তার উদাহরণ। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিড়লা ব্রাদার্স লিমিটেড কোম্পানি। তারপর বিড়লা জট কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে। এইভাবে দালালি ও কাঁচামালের যোগানদার থেকে পাক্কা শিল্পপতি। এখানেই তারা থেমে থাকে নি। বিশ্বমন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলিতে তাদের শিল্প সাম্রাজ্য ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কাগজ কল ও বীমা কোম্পানি এই সময়ই তাদের ব্যবসায়ে সংযোজন। একই সময়ে জি ডি বিড়লার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারত চেম্বার অফ কমার্স এবং FICCI। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ইংরাজরাই প্রথম বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স প্রতিষ্ঠিত করেছিল নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ এগিয়ে নিয়ে যেতে। এরই বিপরীতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা গড়ে তোলে বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স (১৮৮৭)। পরপর তৈরি হলো বোম্বাইতে ইন্ডিয়ান মার্চেন্টস চেম্বার (১৯০৭), মাদ্রাজে সাদার্ন ইন্ডিয়া চেম্বার অফ কমার্স (১৯০৯)। এছাড়াও ছিল বিভিন্ন সম্প্রদায়ভিত্তিক (যেমন মাড়ওয়ারি, মুসলিম ইত্যাদি) অসংখ্য চেম্বার অফ কমার্স। নিজেদের গোষ্ঠীর ব্যবসা এগিয়ে নিতেই এর প্রবর্তন হয় যেমন বোম্বাইতে বাজারের চাইতে কম সুদে মাড়োয়ারিরা নিজেদের মধ্যে ঋণ দেওয়া নেওয়া করতো। ১৮৫৭ সাল থেকে শুরু হয়েছিল জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। ইংরাজরা এ ক্ষেত্রেও পথ প্রদর্শক হলেও পরে ভারতীয়রা বিপুল পরিমাণে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি সৃষ্টি করে। একটি হিসেব অনুসারে ১৯৩০ সালে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিগুলিতে ভারতীয় পুঁজি ৫৩ শতাংশের বেশি ছিল।

কিন্তু একই সাথে যেটা লক্ষণীয় বিষয় তা হলো ইংরেজদের সঙ্গে দরকষাকষির নানা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি ভারতীয় শিল্পপতিরা, বিশেষত তাদের মধ্যে যারা বড়, নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থেই আবার ইংরেজদের প্রতি অনুগতও ছিল। বড় পুঁজিপতিরা শ্রমিক অসন্তোষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকারি সহায়তা চাইতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বস্ত্র শিল্পের মালিকরা ও তুলার রপ্তানিকারকরা তুলার দাম কমাবার স্বার্থে সরকারের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ককে কাজে লাগাতে চাইত। ছোট বা মাঝারি শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আবার জাতীয় চেতনা অনেক বেশি ছিল। যেমন তুলোর যে ব্যাপারীরা কাঁচা তুলো বোম্বাই নিয়ে আসত তাদের মধ্যে ইংরেজ বিরোধিতা তীব্র ছিল। আবার ১৯২০-২১-এর উত্তাল অসহযোগ আন্দোলনের সময়েই তুলোর বৃহৎ রপ্তানিকারক পুরুষোত্তম দাস ঐ আন্দোলনের বিরোধিতা করার জন্য পাল্টা সংগঠন পর্যন্ত গড়ে ফেলেছিল। ভারতীয় উদ্যোগপতিদের মধ্যে টাটারা ছিল বিশেষভাবে ইংরেজ অনুগত, কারণ ইস্পাতের মত শিল্পের বাজার ভীষণভাবে নির্ভর করে সরকারি আনুকূল্যের উপর। ইংরাজ আনুগত্য যে মাত্রারই থাকুক না কেন, মোট কথা হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব ও পশ্চিম উভয় ভারতেই বৃহৎ দেশি পুঁজিপতিদের শিল্প খুব বড় মাত্রায় সম্প্রসারিত করে। এর যে নানা কারণ ছিল তার মধ্যে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যুদ্ধের কারণে চাহিদা বৃদ্ধি, বিদেশী পুঁজির সঙ্গে প্রতিযোগিতা হ্রাস, কাঁচা পণ্যের মূল্য হ্রাস এবং প্রকৃত মজুরির হ্রাস। ঐতিহাসিকরা এই সময়টিকেই ভারতীয় পুঁজিপতিদের প্রথম বিশাল অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই তাই একদিকে ভারতীয় পুঁজিপতিদের বিকাশ, বৃদ্ধি ও সঙ্ঘবদ্ধতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে অন্যদিকে পায়ের নিচে খানিক মাটির সন্ধান পেয়ে তারা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে দর কষাকষি শুরু করে। একই সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে ইংরেজ পুঁজির শক্তিক্ষয় তাদের অবস্থানকে আরও সুবিধাজনক করে তোলে। ১৯২৭ সালের লিবারাল ইনকয়্যারি কমিশনের রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে ইংরেজ পুঁজির বিনিয়োগের হার কমে যাচ্ছিল এবং পুঁজি রপ্তানির ক্ষমতাও যথেষ্ট হ্রাস পেয়ে গেছিল। ১৯৩০-এর দশক জুড়ে ইংরেজ পুঁজির এই অধোগমন অব্যাহত ছিল, কারণ এই দশকেই এশিয়ার বাজারে জাপান, বলকান ও স্ক্যান্ডেনিভিয়ার বাজারে জার্মান এবং ল্যাটিন আমেরিকার বাজারে মার্কিন পুঁজিপতিরা তাদের আধিপত্য কায়েম করে। এর অর্থ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই ব্রিটেন বিশ্ববাজারে তার প্রাধান্য হারিয়ে ফেলে। এ রকম একটি সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে, ১৯১৮ সালে ভারতীয় শিল্প কমিশনের রিপোর্টে যখন ভারতে বিপুল শিল্প সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে, তখনই কমিশনের সদস্য ভারতীয় পুঁজিপতিরা শুল্ক ও বৈদেশিক বিনিময়ের উপর নিয়ন্ত্রণের দাবি তোলে। ১৯১৯-২১ এর জাতীয়তাবাদী লড়াই-এ ভারতীয় পুঁজিপতিদের একাংশের অংশগ্রহণের লক্ষ্য ছিল এই দাবী আদায়ের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২২-এর ফিস্কাল কমিটির রিপোর্টে দেশীয় উত্পাদনকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে কিছুটা সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯২৪-এ শুল্ক বোর্ড গঠন, তারও পরে টাকার সঙ্গে পাউন্ডের বিনিময় হার পরিবর্তন ইত্যাদি সূচনা করে যে ইংরেজরা দেশি পুঁজিপতিদের শক্তিকে কিছুটা মান্যতা দিতে বাধ্য হয়েছিল।

১৯৩০-এর দশক থেকেই ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিরা ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য সরকারের তরফে ''পরিকল্পিত বিকাশ''-এর পন্থা গ্রহণের জন্য আবেদন করেছিল। ১৯৩৪-এ ''ফিকি''র এক সাধারণ সভায় জি ডি বিড়লা এই দৃষ্টিভঙ্গীই প্রতিফলিত করে। ১৯৩৮ সালে ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি 'ভারতের জাতীয় কংগ্রেস' পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে চেয়ারম্যান করে 'জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি' গড়ে তোলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতের 'স্বাধীনতা'

১৯২৯-এর বিশ্বব্যাপী মন্দা ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ভারতের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ সব পরিবর্তন সূচনা করলো যা ভারতীয় পুঁজিপতিদের অবস্থানকে আরও খানিকটা সংহত করার সুযোগ এনে দিল। ভারত-ব্রিটেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভীষণভাবে পরিবর্তিত হলো। ১৯৪৪-৪৫-এর মধ্যেই ব্রিটেনকে সরিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতে বৃহত্তম আমদানিকারক হয়ে উঠলো। যুদ্ধের প্রয়োজনে ইংল্যান্ডকে ভারত থেকে এত বেশি যুদ্ধ সামগ্রী কিনতে হয়েছিল যে ভারতের স্টারলিং ঋণ শুধু শোধ হয়ে গেল না, ১৯৪৫ এর মধ্যে ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের স্টারলিং ব্যালান্স ভারতের ঘরে জমা হলো। এই বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার স্বাধীনতার পরও ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যে দারুণ সহায়ক হয়েছিল। যে বৈদেশিক ঋণ শোধ চিরাচরিতভাবেই ভারত থেকে ধন নির্গমনের এক প্রধান উত্স ছিল, তাও বন্ধ হলো। দ্বিতীয়তঃ যুদ্ধের চাহিদা মেটাতে গিয়ে বস্ত্র, লোহা ও ইস্পাত, সিমেন্ট, কাগজ এবং কিছুটা পরিমাণে ইঞ্জিনিয়ারিং ও রাসায়নিক শিল্পের বৃদ্ধি ঘটলো। যুদ্ধের বাজারে উত্পাদনের পরিমাণের তুলনায় লাভের পরিমাণ বেড়ে গেল বহুগুণ। এর উত্স ছিল ফাটকা কারবারের লাভ, শেয়ার বাজার, খাদ্যদ্রব্য এবং কালো বাজার। হাতে প্রচুর অর্থ অথচ কারিগরি দক্ষতার ভয়ানক অভাব এদেরকে বৈদেশিক সহযোগিতা-ভিত্তিক পুঁজি-বিনিয়োগের দিকে ঠেলে দিল। কিন্তু সামগ্রিক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আনুকূল্যে বিদেশি পুঁজির সঙ্গে লেনদেন এখন আর মারাত্মক অসম শর্তে নয়। ইতিমধ্যে ভারতে একটি ডলার তহবিল তৈরি হয়ে গেছে। ভারতীয় পুঁজিপতিদের সঙ্গে মার্কিন পুঁজিপতিদের নতুন বন্ধনও তৈরি হয়ে গেছে। এয়ারক্রাফট ও অটোমোবাইল পার্টস উত্পাদনে মার্কিন পুঁজিপতিরা ভারতে কারখানা স্থাপন করে। ভারতে নতুন শিল্পস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিনারিও পুরনো প্রযুক্তিতে গড়া ব্রিটিশ পণ্যের স্থানে মার্কিন পণ্য দিয়ে প্রতিস্থাপিত হলো।

১৯৪৪ সাল নাগাদই ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিরা তাদের সুসংহত ও নিজস্ব উদ্যোগ প্রকাশ করে। তাদের বোঝাপড়ায় এটা ঐ সময়ই স্পষ্ট হয় যে ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পশ্চাদপসরণ আসন্ন হয়ে উঠছে এবং তারাই হয়ে উঠবে ভারতীয় সমাজে নেতৃত্বদায়ী শ্রেণী। নেতৃত্বের সেই ভূমিকা পালনের জন্য তারা আগাম ''অর্থনৈতিক বিকাশের একটি পরিকল্পনা'' প্রকাশ করে। এটিই ''বম্বে প্ল্যান'' হিসেবে পরিচিত হয়। ভারতের ৭ জন প্রধান পুঁজিপতি জে আর ডি টাটা, জি ডি বিড়লা, এ দালাল, শ্রীরাম কস্তুরভাই লালভাই, এ ডি শ্রফ এবং জন মাথাই ছিল এ দলিলের রচয়িতা। এই দলিলে ভারতের ভাবী শাসকশ্রেণীর মূল প্রতিভূ পুঁজিপতি শ্রেণী তার আগামী দিনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রকাশ করে। তাতে একদিকে যেমন ছিল সামাজিক সুরক্ষা ও জন সাধারণের জীবন যাপনের মানোন্নয়ন করা, অন্যদিকে শিল্পে দ্রুত অগ্রগতির পাশাপাশি কৃষিতে এক ধীরগতি বিকাশের পরিকল্পনা। মাথাপিছু আয় ১৫ বছরে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য ধার্য করা হয়। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি থেকে আধুনিক ও উন্নত যন্ত্রপাতি এবং পুঁজি যোগানের কথা বলা হয়। জাতীয় সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে অস্পষ্টতা থাকলেও, তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় মৌলিক শিল্প গড়ার কথা বলা হয়, বিশেষত যে ক্ষেত্রগুলিতে বিকাশের ঐ পর্যায়ে বেসরকারি পুঁজির যোগান সম্ভব নয়। আশ্চর্যজনকভাবে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রসঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার উদাহরণ এসেছে এবং তা এসেছে সপ্রসংশভাবে। উল্লেখ্য যে ১৯৪৭ পরবর্তী পর্যায়ে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী সরকারিভাবে এই পরিকল্পনা গ্রহণ না করলেও ১৯৫০-এর ১ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল বম্বে প্ল্যানের ছাঁচে তৈরি।

১৫ বছরের জন্য প্রস্তাবিত এই পরিকল্পনার মোট ৭৫০০ মিলিয়ন পাউন্ড সরকারি বিনিয়োগের কথা বলা হয়। তার মধ্যে শিল্পে ৩৩৬০, কৃষিতে ৯৩০, কমিউনিকেশনে ৭০৫, শিক্ষায় ৩৩৭.৫, স্বাস্থ্যে ৩৩৭.৫, বাসস্থান নির্মাণে ১৬৫০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করার কথা বলা হয়। এই বিনিয়োগের উৎসগুলির মধ্যে ছিল আভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ৩০০০ এবং সৃষ্টি করা অর্থ ২৫০০ মিলিয়ন পাউন্ড। যুদ্ধোত্তর পর্বের দামের ভিত্তিতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫০০০ মিলিয়ন পাউন্ড। ১৫ বছরের জন্য করা এই পরিকল্পনায় কৃষিতে ১৩৫ শতাংশ এবং শিল্পে ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল। প্রায় একই সময়ে, অর্থাৎ ১৯৪৫ সালে ভারত সরকারের যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন কমিটি তার দ্বিতীয় রিপোর্ট পেশ করে এবং সেখানেও ১৫ বছরেরই এক পরিকল্পনা হাজির করা হয়। ''বম্বে পরিকল্পনা''র সঙ্গে তার বিস্ময়কর মিল লক্ষ্য করা যায়। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি নতুন ও জরুরী বৃহদায়তন শিল্পে বিনিয়োগ ছিল এই শিল্পনীতির মূল কথা। ঐ একই বছরে ভারত সরকারের পরিকল্পনা ও বিকাশ বিভাগ শিল্পনীতি বিষয়ক রিপোর্টে ২০টি শিল্পকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার কথা বলে। এমনকি এগুলিকে জাতীয়করণ করার কথাও বলা হয়। এই শিল্পগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল রেল, লৌহ ও ইস্পাত, বিমান, বস্ত্র নির্মাণ, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি প্রভৃতি। বম্বে পরিকল্পনার সাথে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারত সরকারের পরিকল্পনার সাদৃশ্য দুই বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর সম্মিলিত উদ্যোগ এবং ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়ার আন্তর্জাতিক পুঁজির উপর নির্ভরতাকেই তুলে ধরে।

এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে ভারতীয় পুঁজিপতিদের এই আত্মবিশ্বাস এবং তার উপর দাঁড়িয়ে এই আত্মঘোষণার পশ্চাত্পটে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের বিপুল ক্ষতি এবং পুঁজিবাদী শক্তিগুলির ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস। যুদ্ধের বিপুল খরচ বহন করতে গিয়ে একদিকে সে ভারতের কাছে ঋণী হলো। অন্যদিকে যুদ্ধ চালানো থেকে শুরু করে নিজের দেশের পুনর্গঠনের জন্য তাকে হাত পাততে হলো মার্কিনীদের কাছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে কায়েম হলো ডলারের আধিপত্য। আবার মার্কিনীদের স্টারলিং-এর সঙ্গে একটা সমঝোতা করেও চলতে হলো, কারণ ইতিমধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে তার শুরু হয়েছে ঠাণ্ডা লড়াই। ঠিক এরকম একটা অবস্থায় ভারতের শিল্প প্রসার এবং এর সিংহভাগই হলো দেশি পুঁজির হাত ধরে। ব্রিটিশ-নির্ভরতার পাশাপাশি মার্কিন নির্ভরতা এবং তার পাশাপাশি নিজের শক্তিবৃদ্ধি সম্পর্কে সচেতনতা। ব্রিটিশরাও বুঝতে শুরু করলো এমন একটি শক্তি ভারতের বুকে সৃষ্টি হয়েছে যারা ব্রিটিশের অর্থনৈতিক স্বার্থকে বড় ধরনের আঘাত না দিয়ে ব্রিটিশের রাজদণ্ড হাতে নেবার যোগ্যতা অর্জন করেছে। ব্রিটিশদের প্রতি বরাবর অনুগত অপর শ্রেণীটি অর্থাৎ সামন্ত জমিদার শ্রেণীও ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের নির্ভরযোগ্য সহযোগী হিসেবে থেকে গিয়েছে। ইতিমধ্যে তারাও প্রস্তুত হয়ে গেছে বৃহৎ পুঁজিপতিদের নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে আগামী ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হতে। ভারতে পুঁজিবাদের বিকাশ বুঝতে গেলে ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতি এবং সেখানকার শ্রেণী বিন্যাস নিয়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা প্রয়োজন।

ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের কৃষি-অর্থনীতি

১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলার রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব পায়। তখন থেকে ইজারাদার আর রেভেন্যু সুপারভাইজারের অত্যাচারে চাষীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অনাবৃষ্টি আর বছর বছর মন্বন্তর যার মধ্যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সকলেরই জানা। ঐ বছরও রাজস্ব ঠিক ঠিক জমা পড়েছিল। এর পর রাজস্ব আদায়ের নানা পদ্ধতি পেরিয়ে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের তত্ত্বাবধানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন জমিদারদের দিয়ে রাজস্ব আদায়ের নিশ্চয়তা খুঁজে পেল। রাজস্বর পরিমাণ অপরিবর্তনীয় বলে ''চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত'' নাম হলো। এই ব্যবস্থায় জমি জমিদারদের ব্যক্তিগত মালিকানায় চলে এলো। ফলে ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে জমিদারদের সম্পর্ক গাঢ় হলো। কিন্তু কয়েক বছর পরই এই ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা শাসকদের নজরে এল। সরকারের লাভ বাড়ছে না, যেহেতু রাজস্ব একই থাকছে, কিন্তু চাষীর কাছ থেকে নিংড়ে নিতে শুরু করলো জমিদার ও তার নীচের অসংখ্য দালাল। কোম্পানি তাই রাজস্ব আদায়ের অন্য ব্যবস্থার কথা ভাবতে লাগলো। সরাসরি রায়তের সঙ্গে রাজস্ব-আদায়ের চুক্তি করলে মধ্যবর্তী শ্রেণী আর রাজস্বের অংশ শোষণ করতে পারবে না। আর চুক্তি চিরস্থায়ী না করে ২০ বা ৩০ বছর ব্যবধানে বাড়াতে পারলে কৃষির বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাজস্বও বাড়ানো যাবে। এই ভাবনা থেকে রায়তওয়ারি ব্যবস্থার প্রচলন মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে। কিন্তু এই অবস্থায় ''গ্রাম ব্যবস্থার'' কোন গুরুত্ব থাকলো না। ফলে রায়ত আর সরকারের মধ্যে ঢুকে পড়লো সরকারের এজেন্ট হিসেবে লোভী ও বিবেকহীন কর্মচারীরা। গ্রাম-ব্যবস্থা যে সব জায়গায় বিদ্যমান ছিল যেমন পাঞ্জাব, অযোধ্যা, গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী এলাকা সেখানে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা হিসেবে ''মহালওয়ারি'' চালু হলো। রাজস্ব প্রশাসনের কাজগুলি ''মহাল'' বা গ্রামই করতো, আর যেখানে কোনও ভূস্বামী মহালের অধিকর্তা সেখানে তার সঙ্গেই চুক্তি হতো। রায়তওয়ারির মতই রাজস্ব নির্ধারণের বন্দোবস্ত অস্থায়ী ছিল। মোট চাষযোগ্য জমির ১৯ শতাংশ ছিল জমিদারি বন্দোবস্ত, ২৯ শতাংশ মহালওয়ারি বন্দোবস্ত আর ৫২ শতাংশ ছিল রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত।

ঊনবিংশ শতক থেকে রাজস্ব দেবার জন্য কৃষকের উপর যে লন চলতো তার সঙ্গে যুক্ত হলো কৃষি-পণ্যের বাজারের লন। ভারতবর্ষে এ বাজারের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। মধ্যযুগ থেকে চলমান কৃষিপণ্যের এ বাজার কোম্পানির আমলে কুটির শিল্পজাত সামগ্রী এবং নীল ইত্যাদি কৃষিপণ্যের বিদেশে রপ্তানি শুরু হবার দরুন অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষিপণ্যের বাজারে এক উল্লম্ফন ঘটলো ইংল্যান্ডের শিল্পের জন্য কাঁচামালের চাহিদা বাড়ায় এবং দেশের অভ্যন্তরে রেল সহ পরিবহনের উন্নতির ফলে। ১৮৬৯-এ সুয়েজ খাল খোলার পর রপ্তানি অনেক বেড়ে গেল। অনেক নতুন কৃষি পণ্য এমন কি চাল ও গমের রপ্তানিও বেড়ে গেল। চাল ছাড়া অন্যান্য দ্রব্য রপ্তানি হতো বিনা শুল্কে। এর ফলেও কৃষিপণ্যের বহির্বাণিজ্য বেগবান হলো। এইভাবে ভারতের কৃষিপণ্য বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে ভালভাবে জড়িয়ে পড়লো। অর্থকরী ফসলের (cash crop) উত্পাদন বৃদ্ধি আবার দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যশস্যের বাজারকেও সম্প্রসারিত করলো। কারণ যেখানে যে ফসল ভাল হয় সেখানে সেই ফসলেরই চাষ হতো। সেখানকার কৃষকদের খাদ্যশস্য বাজার থেকেই কিনতে হতো। বিংশ শতকের গোড়ায় এই প্রবণতা আরও বেড়ে গিয়েছিল। একটি সরকারি হিসেবে দেখা যায় ১৯০১ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে যেখানে খাদ্যশস্যের চাষের এলাকা বেড়েছে ১৬ শতাংশ সেখানে আখচাষের ৬৯, তুলো চাষের ৫৯, তৈলবীজের ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। কৃষি-পণ্যের উত্পাদন ও বাজার বাড়ার সাথে সাথে কৃষকের দুর্দশা হু হু করে বাড়তে শুরু করলো। কারণ এই ধরনের চাষে বিনিয়োগ অনেক বাড়াতে হতো যা কৃষককে ধার করতে হতো মহাজনের কাছ থেকে। পণ্য বাজারজাত করতেও নির্ভর করতে হত মধ্যবর্তী একাধিক মহাজন বা ব্যবসায়ীর কাছে। প্রতি পদক্ষেপে তারা চাষিকে ঠকাতো। আর একটি বড় সমস্যা হলো অর্থকরী পণ্যের চাষের এলাকায় চাষীদের খাদ্যের জন্য মহাজনের কাছে ঋণ নিতেই হতো, আর ফসল মার খেলে সে ঋণ শোধ করাও সম্ভব হতো না। এই ধরনের ঋণে সুদের হার ছিল শতকরা ২০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত। তা ছাড়া চাষীরা যে হেতু বাজারে দামের ওঠা-পড়ার খুবর গ্রামে বসে পেত না, ফলে গ্রামের বেনে বা আড়তদারেরা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে খুব কম দামে কৃষিপণ্য কিনে অনেক বেশি দামে বেচতে পারতো। এই রকম একটা অর্থনীতিতে কৃষকদের মধ্যে বৈষম্যও ভয়ানক বাড়তে শুরু করলো। সম্পন্ন চাষীদের মহাজনের উপর নির্ভর করতে হতো না বলে আগে উল্লেখিত শোষণের শিকার তাদের হতে হতো না। ফলে তাদের হাতে প্রচুর পয়সা আসতে শুরু করলো এবং এদের একটা বড় অংশই মহাজনী কারবার নিজেরাই শুরু করে দিল। কৃষিপণ্যের বাজার পড়ার সাথে সাথে গ্রামের বেনে আর মহাজনরা, যাদের মধ্যে অনেকেই আবার ধনী কৃষক, বাজারের উপর তথা গ্রামীণ অর্থনীতির উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এলো। গ্রামের বর্ধিষ্ণু কৃষক-মধ্যবর্তী ব্যবসাদার (ফড়ে, দালাল, বেনে) –মহাজন, এরাই হয়ে দাঁড়ালো ঔপনিবেশিক গ্রামীণ অর্থনীতির মূল স্তম্ভ এবং কৃষক- সম্প্রদায়ের মূল শোষক। মোট কথা এই যে কৃষকদের উপর যুগ যুগান্ত ধরে যে সামন্ত শোষণ চলে আসছিল ঔপনিবেশিক অর্থনীতি তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এই অর্থনীতি কৃষকদের মধ্যে বিভাজন বাড়িয়ে দেয় এবং সর্বোপরি কৃষকদের একটা বড় অংশকে ভূমি থেকে উত্খাত করে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত করে।

দেখা যায় উনিশ শতক থেকেই ভারতীয় কৃষিতে অনেকগুলি পুঁজিবাদী উপাদান সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি-উত্পন্নের বাজারজাত হবার প্রবণতা ক্রমেই বেড়েছে। বাজার-নির্ভর চাষ ক্রমেই বেড়েছে, বিপরীত পক্ষে বাজার-দরের ওঠা-নামা কৃষি-উত্পাদনকে ক্রমেই বেশি বেশি করে প্রভাবিত করেছে, অর্থনীতিতে টাকার লেনদেন ক্রমেই বেড়েছে, মহাজনী ব্যবস্থার চাপে অসংখ্য কৃষক জমি হারিয়ে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়েছে। এতগুলি পুঁজিবাদী বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও কিন্তু ভারতীয় কৃষিতে পুঁজির বিকাশ সীমিতই থেকে গেল। এর একেবারে প্রত্যক্ষ কারণ কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ে নি। কৃষিপণ্য বেচে কৃষক যা পেয়েছে তার সিংহভাগ চলে গেছে সরকারের ঘরে জমিদারের কাছে আর মহাজনের পকেটে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য ছিল উপনিবেশের সস্তার কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজের দেশের শিল্পকে পুষ্ট করা আর নিজের দেশের তৈরি শিল্পদ্রব্য উপনিবেশে বিক্রি করে মুনাফা লুঠ করা। ভারতে পুঁজির অবাধ বিকাশ হলে এই দুটি লক্ষ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতের বুকে পুঁজির বিকাশ সীমায়িত রাখা ছিল তার সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে অস্তিত্বের পূর্বশর্ত। তাই ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষি ও শিল্পের অনগ্রসরতা ঔপনিবেশিক কাঠামোয় পারস্পরিকভাবে বিজড়িত। ভারতের কৃষিতে পুঁজিবাদী বিকাশ আরও কেন হল না তা মূলত বুঝতে হবে সাম্রাজ্যবাদের এই ক্রিয়াপদ্ধতির সাহায্যে।

ভারতের শাসক শ্রেণীর কাছে ইংরেজদের ক্ষমতা হস্তান্তর

আমরা আগেই দেখেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পর্বে ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতি শ্রেণী একটা মাত্রায় নিজেদের সংঘবদ্ধ করে ফেলেছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ইংরেজ পুঁজি যত মার খাচ্ছে ততই সে ভারতের বুকে ইংরেজদের পশ্চাদপসরণ অনুভব করছে। কিন্তু ভারতের মতো বিশাল দেশে বিশেষতঃ এর সুবিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে যারা ক্ষমতার স্তম্ভ সেই গ্রামীণ সামন্ত-জমিদার শ্রেণীর সঙ্গে একটি সুষ্ঠু সমন্বয় ছাড়া যে এখানে শাসন চালানো যাবে না তা এই পুঁজিপতি শ্রেণী ভালভাবেই জানতো। এই কাজটি গান্ধীজির কৌশলী নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভালভাবেই করে ফেলেছিল। গ্রামাঞ্চলে শ্রেণী বৈষম্য ক্রমবর্ধমান থাকলেও জাতীয়তাবাদী শ্লোগানের আড়ালে গান্ধীজি একই সঙ্গে ইংরেজবিরোধী লড়াই-এর নামে শোষিত কৃষকদের সমাবেশিত করতে পেরেছিলেন আবার তাদের শোষক সামন্ত-জমিদার শ্রেণীকেও জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে রাখতে পেরেছিলেন। ফলে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে শাসক শ্রেণীগুলির যে সমন্বয় প্রয়োজন ছিল তা অনেক আগেই ঘটে গিয়েছিল। উপনিবেশগুলিতে সামন্তবাদকে টিকিয়ে রাখা এবং দেশীয় পুঁজিবাদকে সীমায়িত রাখা যেহেতু সাম্রাজ্যবাদেরও কর্মসূচী তাই এই দুটি শ্রেণীর বোঝাপড়ার বৈষয়িক ভিত্তি সাম্রাজ্যবাদই রচনা করে দেয়।

১৯৪০-এর দশকের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে একের পর এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে থাকে। সেগুলি একদিকে যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভীতসন্ত্রস্ত করে দেয়, অন্যদিকে ভারতের শাসকশ্রেণী ও তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকেও বিপন্ন করে তোলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিশ্ব জনগণের হাতে ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয় এবং চীন বিপ্লবের দুর্বার অগ্রগতি পৃথিবীর শক্তি বিন্যাসে নতুন মোড় ঘোরালো। সাম্রাজ্যবাদ সাময়িকভাবে হলেও দুর্বল হলো জনগণের শক্তি দেশে দেশে বৃদ্ধি পেল। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠলো। আর একই সঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরেও এক অভূতপূর্ব সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনজোয়ার সমগ্র দেশকে প্লাবিত করলো। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন ১৯২০-র দশক থেকেই ভারতে এক সংগঠিত রূপ নিয়েছিল। পরবর্তী দু'দশকে তার প্রভাব আরও বিস্তৃত হয় এবং ৪০-এর দশকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ব্যাপক শ্রমিক আন্দোলন এবং তেভাগা-তেলেঙ্গানার কৃষক আন্দোলন সারা দেশের শ্রমিক কৃষক আন্দোলনকে দেশব্যাপী বৈপ্লবিক জোয়ার সৃষ্টির দিকে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করলো। এতে ভারতের শাসকশ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ শক্তিগুলি আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে ভারতে প্রত্যক্ষ শাসন চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়লো। আবার ভারতের শাসক শ্রেণীরাও দেশের জনগণের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভকে প্রশমিত করার জন্য স্বাধীনতার ঘোষণাকে প্রয়োজনীয় মনে করলো। তা ছাড়া দেশের শাসকে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন তাদের ছিলই! এইভাবেই এল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট।

স্বাধীন ভারতে নতুন শাসকদের 'উন্নয়নপরিকল্পনা

স্বাধীনতার ঠিক পর পরই নতুনভাবে দেশ গড়ার জন্য ভারত সরকার যে 'উন্নয়ন' পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা মোটেই ব্রিটিশ তত্ত্বাবধানে নয়। তা ঘটলো মার্কিন প্রত্যক্ষ আর্থিক ও কারিগরি পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণে। ১৯৪৮ সালে গৃহীত এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়— সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পতিত জমি পুনরুদ্ধার, ফসল সংরক্ষণ ও সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি ইত্যাদি। স্পষ্টতই দেশের সংখ্যাগুরু অংশ কৃষক সমাজের ধূমায়িত ক্ষোভ-বিক্ষোভকে প্রশমিত করার আকাঙ্ক্ষা এতে প্রতিফলিত। আমেরিকার ফোর্ড ফাউন্ডেশন, রকফেলার ফাউন্ডেশন এবং MIT বিশ্ববিদ্যালয় এই উন্নয়ন প্রকল্প রচনা করে। একই সময় শাসকদল কংগ্রেস মৌলিক ভূমি সংস্কারের কথা ঘোষণা করে। তদনুসারে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বেশিরভাগ রাজ্য ভূমি সংস্কার আইন পাশ করে। এই আইনের ভিত্তি তৈরি হয় ১৯৪৮ সালের ''কংগ্রেসের কৃষি সংস্কার কমিটি''র রিপোর্ট অনুসারে। লক্ষ্য হিসেবে রাখা হয় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের জমি সমবায়ীকরণ এবং সমবায় প্রথায় গ্রাম পরিচালন। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং গ্রাম পঞ্চায়েত ও গ্রাম সমবায়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাব ভূমি মালিকদের কাছে এই সংকেত পাঠায় যে তাদের বাড়তি জমি নিয়ে নেওয়া হবে। কংগ্রেসের ভেতরে ও বাইরে যে শক্তিগুলি ভূমি সংস্কারের বিরোধী তারা সংঘবদ্ধ হতে থাকে এবং ভূমি সংস্কারের সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়া হয়। জমির উর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত আইন অবশ্য ১৯৬০-এর দশকে এবং ১৯৭৫-এর জরুরী অবস্থার সময় নতুন করে সংশোধন করা হয়।

ভূমি সংস্কার আইনের প্রথম ধাপ ছিল মধ্যস্বত্বভোগী অর্থাৎ জমিদার, জায়গীর, ইনাম ইত্যাদিদের উত্খাত করা। ১৯৫০-এর দশকে ভারতের প্রায় অর্ধেক এলাকায় চাষীরা এদেরই খাজনা দিত। এই আইন চালু করার ফলে ২ কোটি কৃষক সরাসরি সরকারকে খাজনা দিতে পারলো। মধ্যস্বত্বভোগীদের অবশ্য ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। বিহার, উড়িষ্যা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও জমিদাররা তাদের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে জমিদারি টিকিয়ে রেখেছিল। একমাত্র কৃষক আন্দোলনের শক্তিতেই জমিদারি প্রথা বিলোপের সাফল্য নির্ভর করেছে। ভূমি সংস্কারের দ্বিতীয় ধাপ ছিল প্রজাস্বত্ব অধিকার সংস্কার। এর দুটি লক্ষ্য ছিল। প্রজাস্বত্বের মেয়াদ সুরক্ষিত করা এবং খাজনা হিসেবে দেয় ফসলের ভাগের ক্ষেত্রে কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষিত করা। এ ক্ষেত্রেও দেখা যায় আইন যতই কঠোর হোক দরিদ্র কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ বা দখলি স্বত্ব যাতে কায়েম না হতে পারে তার জন্য বিভিন্ন জমিদারদের জমিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষ করানোর প্রথা থেকেই গেল। কার্যত এই আইন পাশ হবার পর কৃষক উচ্ছেদ বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের অপারেশন বর্গা তুলনায় বেশি সাফল্য লাভ করেছিল। খাজনার ব্যাপারে মোট উত্পাদনের এক চতুর্থাংশ থেকে এক ষষ্ঠাংশ সরকারি হিসাবে স্থিরীকৃত ছিল, কিন্তু কার্যত বহুক্ষেত্রেই সাবেকী হিসেবে অর্ধেক অংশ জমির মালিক চাষীর কাছ থেকে খাজনা আদায় করে নিতো। ভূমি সংস্কারের তৃতীয় স্তম্ভ জমির উর্ধ্বসীমা নির্ণয় করার লক্ষ্য ছিল উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া। এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সরকারি ব্যর্থতা লক্ষণীয়। আইনের ফাঁকফোকর. উদ্বৃত্ত জমি মালিকদের সঙ্গে রাজস্ব-আধিকারিকদের গোপন বোঝাপড়া এবং সরকারের সদিচ্ছার অভাব— এগুলিই এই ব্যর্থতার কারণ। এ ক্ষেত্রেও যেটুকু সাফল্য পাওয়া গেছে তা কৃষক আন্দোলনের জোরের উপরই নির্ভর করেছে। চতুর্থ বিষয় ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জমির সংহতিকরণ। ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত ভারতের কৃষি জমির প্রায় একতৃতীয়াংশ এই সংহতিকরণের আওতায় এসেছে— যার প্রায় সবটাই পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশে। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যেসব স্থানে মহালওয়ারি ব্যবস্থা চালু ছিল, সেসব জায়গাতেই এই প্রক্রিয়া বেশি সফল হয়েছে।

ভূমি সংস্কারের এই সীমাবদ্ধতার কারণে ভারতের গ্রামাঞ্চলে থেকে গেছে বিপুল বৈষম্য। ছোট ও প্রান্তিক চাষীর সংখ্যাও বিগত দশকগুলিতে ভীষণ বেড়েছে। স্বাধীনতার পর সরকারের আধাখ্যাঁচড়া ভূমি সংস্কার ভয়াবহ গ্রামীণ দারিদ্র্য কিছুমাত্র কমাতে পারে নি। এর পরিণতিতে ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবী কৃষক আন্দোলন ফেটে পড়ে। এ আন্দোলন বহু জায়গায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি এরকম পরিস্থিতিতে আবার নতুন করে কৃষি ও ভূমি সংস্কার নিয়ে পরিকল্পনা করতে বাধ্য হয়। ৬০-এর দশকের শেষ থেকে সমগ্র ৭০ দশক ধরে সরকারি উদ্যোগে প্রকৃত কৃষককে জমির ও ফসলের অধিকার দান করার ক্ষেত্রে সক্রিয়তা এবং ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪৩-এর বম্বে পরিকল্পনায় যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব মৃদুভাবে হলেও লক্ষ্য করা যায়, তেমনি ১৯৫০ দশকের ভূমিসংস্কার পরিকল্পনায় সদ্য সমাপ্ত চীন বিপ্লবের প্রভাব এবং ১৯৭০-এর দশকে কৃষক সমস্যা নিয়ে সরকারের তত্পরতায় ঐ সময় চলমান দুর্বার কৃষক আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ার ছাপ স্পষ্ট।

ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলি ভারত সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৫০-এর মার্চে পরিকল্পনা কমিশন গড়ে তোলা হয় এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯৫১-৫৬ সময় পর্বের জন্য। স্বাধীনতার পরে পরেই ১৯৪৯ সালে ভারতে ভয়াবহ খাদ্য-সঙ্কট উপস্থিত হয় এবং খাদ্যের অভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। আশু সমাধান হিসেবে ভারতের সদ্যগঠিত নতুন সরকার মার্কিন সরকারের কাছে ২০ লক্ষ টন খাদ্য ঋণ হিসেবে চায়। আমেরিকা অনেক বেশি দামে এই খাদ্যশস্য ভারতকে দেয়। ১৯৫৬ সালে দীর্ঘকালীন প্রকল্প হিসেবে ভারত আমেরিকা থেকে খাদ্য আমদানির চুক্তি করে যা পি এল ৪৮০ নামে কুখ্যাত হয়ে রয়েছে। ভারত সরকার নতুন রাষ্ট্রের দায়িত্ব পাবার পরই খাদ্য উত্পাদনের ক্ষেত্রে যে সঙ্কটের মুখে পড়ে তাতে স্বাভাবিকভাবেই ১৯৫১-৫৬ সালের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষক ও কৃষি সমস্যা নিয়ে সরকারের উদ্বেগ ও মনোযোগ স্পষ্ট দেখা যায়। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল জলসেচ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন, ভূমিসংস্কার ও বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলার উপর। সংগৃহীত সম্পদের ৪৫ শতাংশ কৃষিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল কৃষি-ক্ষেত্রের বিকাশই পারবে খাদ্য সঙ্কট সমাধান করতে এবং জনসাধারণের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে। তা ছাড়া সদ্য-ক্ষমতায় আসীন বৃহৎ পুঁজির নেতৃত্বের কাছে শিল্পের বিকাশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি রণনীতিগত দৃষ্টিভঙ্গীতেও কৃষির বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারত সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপরেখায় বলা হয়েছিল, ''কৃষিক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বর্ধিত নিয়োগকে ধরে রাখার জন্য তাকে কাজে লাগানো হচ্ছে মৌলিক উন্নয়ন— যা বিশ এবং তিরিশের দশকের সোভিয়েত অভিজ্ঞতা আমাদের শিক্ষা দেয়।'' প্রথম পরিকল্পনায় জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৮ শতাংশ, মাথা পিছু আয় ২১ শতাংশ এবং মাথা পিছু ভোগ ১১ শতাংশ।

১৯৫৬-৬১-র দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকার শিল্পের উপর প্রধান গুরুত্ব আরোপ করলো। শিল্পের জন্য কাঁচা মাল সরবরাহের বিষয়টি এবার কৃষি-পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। জাতীয় আয়ের ২৫% বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হলো। ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিশ্রেণীর শিল্প-বিকাশের উপর পক্ষপাত দ্বিতীয় পরিকল্পনায় পরিষ্কার ধরা পড়লো। অবশ্য তার ভ্রূণ নিহিত ছিল ১৯৪৮ সালের ''ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি রেজোলিউশনেই''।

এই রেজোলিউশনে ভারত সরকার একদিকে যেমন বিদেশী পুঁজিকে আমন্ত্রণ জানায়, আবার ভারতীয় শিল্পের বিকাশ সম্পর্কেও তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। এই প্রস্তাবে শিল্পসংস্থাগুলিকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। (১) পুরোপুরি সরকারি মালিকানাধীন, যেমন অস্ত্রনির্মাণ, আণবিক বিদ্যুৎ, রেল ইত্যাদি। (২) সরকার আগামী ১০ বছরের জন্য নানা সুবিধা দেবে এমন শিল্প, যথা কয়লা, লৌহ-ইস্পাত, এয়ারক্রাফট নির্মাণ, খনিজ তেল, জাহাজ নির্মাণ, টেলিকম, টেলিগ্রাফ ইত্যাদি। এগুলিকে পরিস্থিতি বুঝে সরকার অধিগ্রহণ করবে। (৩) রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে পরামর্শক্রমে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে এমন ১৮টি শিল্প। (৪) অন্যান্য সকল ক্ষেত্র যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন শিল্প গড়ে উঠবে। খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে শিল্পক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগ করা বৃহৎ পুঁজিপতিদের পক্ষে সম্ভব ছিল না এবং যেসব ক্ষেত্র লাভজনক ছিল না, অথচ দেশের সামগ্রিক শিল্পবিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, সেইসব শিল্পকে রাখা হলো সরকারি মালিকানায়। অর্থাৎ পরিকল্পনা এমনভাবেই করা হলো যাতে বৃহৎ পুঁজিপতি শ্রেণী দ্রুত মুনাফা অর্জন করতে পারে এবং দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চাহিদা বা সমাজের সাধারণ মঙ্গলের দিকে দৃষ্টি দেয়া হয় নি। কৃষি-নির্ভর একটি দেশে কীভাবে শিল্প গড়ে তুললে ব্যাপক মানুষের চাকুরি, খাদ্য, বস্ত্রের সংস্থান হবে সেদিকে নজর দেওয়া হলো না। আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ ও পরামর্শ অস্থায়ী যে এ দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিরা তাদের বিকাশের রূপরেখা তৈরি করেছিল, পরিকল্পনায় তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ছিল। আবার লক্ষণীয় যে একই সঙ্গে তা দেশীয় বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করতেও তত্পর ছিল ও তারজন্য নানা বিধিনিষেধ জারি করেছিল। এই শেষোক্ত বিষয়টি আমাদের ভারতীয় পুঁজি সংক্রান্ত তাত্ত্বিক-চর্চায় খুবই অবহেলিত। অথচ ভারতে দেশি পুঁজির বিকাশ বুঝতে এবং কংগ্রেস-নেতৃত্বের এ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে তা খুবই সহায়ক।

১৯৫১ সালে ভারত সরকার জারি করে ''শিল্প বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৫১''। অর্থাৎ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় থেকেই ভারত সরকার শিল্পোদ্যোগের লাইসেন্স, ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদি নিজের হাতে রাখলো। উত্পাদিত পণ্যের গুণমান, দাম, শিল্পোদ্যোগের আয়তন বৃদ্ধির মত বিষয়গুলি সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখলো। এইভাবে সরকারের মাধ্যমে প্রভাবশালী বৃহৎ শিল্পপতি গোষ্ঠীগুলি শিল্প বিকাশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখলো। ১৯৫৬-তে গ্রহণ করা হয় ''শিল্পনীতি সংক্রান্ত প্রস্তাব।'' বম্বে প্ল্যানের ছাপ এখানে সুস্পষ্ট। শিল্পগুলিকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। (১) বুনিয়াদী ও স্ট্র্যাটেজিক শিল্প— যেগুলি গড়ে উঠবে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র হিসেবে। (২) এমন সব শিল্প যেখানে সরকারি ও বেসরকারি দু ধরনেরই বিনিয়োগ হবে। (৩) শুধুমাত্র বেসরকারি বিনিয়োগের শিল্প। এ ধরনের বিভাজনের পিছনে ভারতের বৃহৎ পুঁজির কী স্বার্থ তা আমরা আগেই দেখেছি। এই প্রস্তাবে ক্ষুদ্র শিল্পের উপরও জোর দেওয়া হলো। ঘোষণায় বলা হলো ''জাতীয় অর্থনীতি'' বিকাশের উদ্দেশ্যেই এই জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল এর পিছনেও মূল স্বার্থ বৃহৎ শিল্পের সুবিধা। বৃহৎ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ নির্মাণ, শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের যোগান এবং অনেক সস্তায় শ্রমিক নিয়োগ— এই তিন ধরনের সুবিধাই তারা পেতে লাগলো। বলা হয়েছিল ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ দেশের জ্বলন্ত বেকার সমস্যার সমাধানে কাজে লাগবে। কিন্তু আসলে এ উদ্যোগ কখনই সেই স্তরে নিয়ে যাওয়া হয় নি যেখানে ''জাতীয় অর্থনীতি''র প্রকৃত বিকাশ ঘটিয়ে বেকার সমস্যার কার্যকরী সমাধান করবে। ১৯৬৪-তে গড়ে তোলা হলো ''মনোপলি এনকয়্যারি কমিশন''— যার লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা হলো যে এই কমিশন অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে বেসরকারি মালিকানার কেন্দ্রীভবনের উপর নজরদারি করবে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল এই বড় বড় ঘোষণার আড়ালে বৃহৎ পুঁজি বেড়েই চলেছে, দেশের দারিদ্র্য ও বেকারিত্বও বেড়ে চলেছে। দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার ও প্রতারণা করার শিল্পটি ভারতের শাসক শ্রেণী প্রথম থেকেই ভালভাবে আয়ত্ত করে ফেলেছিল।

ভারতের বৃহৎ পুঁজিকে সুরক্ষা দেবার জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ভারত সরকার বিদেশী পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক জারি করে। তার ফলে বিদেশ থেকে পণ্যের আমদানি যথেষ্ট কমে গিয়েছিল। আবার যেহেতু দেশি শিল্পের পক্ষে প্রয়োজনীয় ছিল বিদেশের প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের আমদানি, তাই বিদেশি পুঁজির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মারফৎ দেশি শিল্পপতিরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে পণ্য উত্পাদন করতে থাকলো। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিকল্পনায় শিল্পের উপর জোর দেওয়ার জন্যই শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি উত্পাদনের উপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হলো। এই উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের আমদানিকে উদার করা হলো। বিপরীত পক্ষে বহু বিদেশি পণ্যের আমদানির উপর এবং এ দেশে বিদেশি পণ্যের উত্পাদনের উপর বিধিনিষেধের পাশাপাশি বহু ক্ষেত্রে আমদানি পণ্যের উপর ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত কাস্টমস ডিউটি চালু করা হলো। সরকারের এই মনোভাব তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল যখন ১৯৬০-এর দশকে গাড়ি তৈরির বিদেশি কোম্পানি সহ অনেক বিদেশি কোম্পানিকে ভারতে উত্পাদনের ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেওয়া হলো এমনভাবেই যে বিদেশি পণ্যের তুলনায় ঐ একই পণ্যের দেশি ব্র্যান্ডগুলি অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। বেসরকারি দেশি বিনিয়োগকে উত্সাহিত করার জন্য ১৯৫২ সালের আগেকার ট্যারিফ বোর্ডকে প্রতিস্থাপিত করা হয় নব-গঠিত ট্যারিফ কমিশন দিয়ে। এই সংস্থার কাজই হলো বহিঃশুল্ক, দাম, ভর্তুকি, অতিপ্রয়োজনীয় কাঁচা মালের অন্তঃশুল্কের হ্রাস, সরকারের তরফে বড় পরিমাণ কাঁচা মাল ক্রয়, আমদানির পরিমাণের উপর বাধানিষেধ জারি ইত্যাদি বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া। ট্যারিফ বোর্ডের সুপারিশে অন্তত ৫০ টা শিল্প উপকৃত হয়েছিল যার মধ্যে ছিল ভোগ্যপণ্য উত্পাদনকারী শিল্প থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, আধ-সারা দ্রব্য (Semi-finished) (বিশেষ ধরনের ইস্পাত, নন-ফেরাস ধাতু, রাসায়নিক ও ঔষধ, বস্ত্রশিল্পের যন্ত্রপাতি) প্রভৃতি। এই মর্মে সরকার বাজেটেও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিল, যেমন নতুন শিল্পোদ্যোগে কর ছাড়, এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানিতে লভ্যাংশ চালান করার সুবিধা ইত্যাদি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কিছু আর্থিক সংস্থার গঠন যার উদ্দেশ্য ছিল শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিকে বেশি পরিমাণে অর্থ যোগান দেওয়া। ১৯৪৮-এ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিনান্স কর্পোরেশন (IFCI) ১৯৫৪ তে ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (NIDC) ১৯৫৫ তে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (ICICI) ১৯৬৪ সালে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (IDBI) ১৯৭১-এ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিকনস্ট্র্যাকশন কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া ইত্যাদি ব্যাঙ্কগুলি ভারতীয় উদ্যোগে গঠিত শিল্পকে পুঁজি সরবরাহ করার জন্যই তৈরি করা হয়। ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট (FERA) চালু করা হয় যাতে এ দেশের কোম্পানিতে সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ ৪০ শতাংশের বেশি না হতে পারে।

সরকারের আনুকূল্যে এইভাবে দেশীয় পুঁজিপতি শ্রেণী বিপুল মুনাফা অর্জন করতে থাকে। এর ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি আমাদের দেশের বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর অনেকগুলিই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। দেশের বুনিয়াদী শিল্পগুলিতে তারা পুঁজি বিনিয়োগের জন্য সক্ষম হয়ে ওঠে। দেশের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও শ্রমসম্পদকে ব্যবহার করে, দেশের কোটি কোটি জনসাধারণকে চরমতম দারিদ্র্যে রেখে কয়েকটি একচেটিয়া পুঁজিপতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার পরবর্তী ৬৫ বছরে অপরিমেয় সম্পদের মালিক হয়েছে। এদেরই মুনাফা ও শিল্পবৃদ্ধিকে দেশের জি ডি পি-বৃদ্ধি হিসাবে দেখানো হয়। প্রতিটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ধাপে ধাপে এই জি ডি পি-র শতকরা বৃদ্ধির হার লক্ষণীয়। চতুর্থ পরিকল্পনায় (১৯৬৭-১৯৭৪) ৩.৯ শতাংশ, পঞ্চম পরিকল্পনায় (১৯৭৪-৭৯) ৫.৫ শতাংশ, ষষ্ঠ পরিকল্পনায় (১৯৮০-৮৫) ৬ শতাংশ, এবং তার পরবর্তী পর্বে ৭ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত হারে তা বেড়েছে। ১৯৫৭ সালে ভারতের ২২টি একচেটিয়া গোষ্ঠীর সম্পদ ছিল ৩১২ কোটি টাকা, ১৯৯৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৫৮,০০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৪০ বছরে সম্পদ বৃদ্ধি ৫০০ গুণ! এই সম্পদ বৃদ্ধিকে অক্ষত রাখার জন্য সরকার বছরে বছরে করব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে।

অবশ্য আমাদের একবারের জন্যও ভুলে যাওয়া চলবে না যে ভারতের বৃহৎ শিল্পপতিরা যদিও নিজেদের বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য দক্ষতার সঙ্গে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সাজিয়েছিল তব সমগ্র পর্ব জুড়ে আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির পরামর্শ, সহযোগিতা এবং হস্তক্ষেপ কমবেশি পরিমাণে সর্বক্ষণই জারি ছিল।

ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক বিকাশে একেবারে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আমল থেকেই বৈদেশিক আর্থিক সহায়তার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই সহায়তার দুটি দিক ছিল। একদিকে এই সহায়তাকেই বৈদেশিক শক্তিগুলি ব্যবহার করত তাদের উপর আমাদের দেশকে নির্ভরশীল করে রাখতে; আবার এই সহায়তাদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শক্তিগুলির টানাপোড়েন একটি আপেক্ষিক স্বাধীনতার পরিসর তৈরি করতে সাহায্যকারী ভূমিকা পালন করতো। প্রথম পরিকল্পনার সময়ে অবশ্য এই সাহায্যের পরিমাণ খুবই কম ছিল। এর একটি কারণ হলো এই পরিকল্পনায় কোন বড় মাপের উন্নয়ন প্রকল্প ছিল না, অন্য কারণটি হলো এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রভাবাধীন আর্থিক সংস্থা ছাড়া আর কেউ সাহায্য করার মত অবস্থায় ছিল না, বা তার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারে নি। প্রথম পরিকল্পনায় উন্নয়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৯.৬ হাজার মিলিয়ন টাকা, আর বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল ১.৮৮ হাজার মিলিয়ন টাকা। এই সাহায্যের ৭১ শতাংশই এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় থেকে পরিস্থিতি বদলে গেল। এই পরিকল্পনায় শিল্প ও পরিবহনের খাতে বড় আকারে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বৈদেশিক সাহায্য মারফতই এর জন্য অর্থ জোগান দেওয়া সম্ভব ছিল। তাই পরিকল্পনায় বরাদ্দ ৪৮ হাজার মিলিয়ন টাকার মধ্যে ৮ হাজার মিলিয়ন টাকাই বৈদেশিক সাহায্য বাবদ ধার্য করা হয়। তৃতীয় পরিকল্পনার শেষে সমগ্র বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৮.৭ হাজার মিলিয়ন টাকা। কিন্তু এই দ্বিতীয় পরিকল্পনার সময় থেকে এক নতুন ঘটনা ঘটতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বেশ ভাল পরিমাণে সাহায্য ভারতকে দিতে শুরু করে। তৃতীয় পরিকল্পনার শেষে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণদানকারী দেশ হিসেবে উঠে আসে। পরিমাণের দিক থেকে এই সহায়তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম (১২.৮ হাজার মিলিয়ন এবং ৪.৮ হাজার মিলিয়ন টাকা); কিন্তু দুটি কারণে এর গুণগত মূল্য ছিল অপরিসীম। প্রথমত রাজনৈতিক বিচারে বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত একটি দেশের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক এবং কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কাছে মোটেই ভাল ঠেকেনি। অথচ লক্ষণীয় বিষয় এই প্রবণতা পরের দশকগুলিতেও সম্প্রসারিত হয় এবং ক্রমবর্ধমান থাকে। দ্বিতীয়ত সোভিয়েত সাহায্যের ধরনটিও ছিল একটু আলাদা, যা চালিত হতো প্রধানত পাবলিক সেক্টরে মৌলিক শিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে। ভারতে শিল্পের ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভরতা বৃদ্ধির জন্য সোভিয়েত ঋণ কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল। সোভিয়েত ঋণের সুদের হারও ছিল পশ্চিমী দেশগুলির তুলনায় কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের শর্ত ছিল অত্যন্ত কড়া: এক্সিস ব্যাঙ্ক-এর সুদের হার ছিল ৫.৭৫% সেখানে সোভিয়েতের সুদের হার ছিল ২.৫%। তাছাড়া মার্কিন ঋণ শোধ করতে হতো ডলারে, যেখানে সোভিয়েত ও তার ব্লকের অন্যান্য রাষ্ট্রের ঋণ 'রুপি'-তে পরিশোধযোগ্য ছিল। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মার্কিন যন্ত্রপাতি কিনতে অনেক বেশি চড়া দাম দিতে হতো। পাঁচের দশক থেকেই ভারত-সোভিয়েত সম্পর্ক অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। গোড়ায় যে মনোভাব নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সাহায্য করতে আরম্ভ করে, সেই মনোভাব বদলাতে শুরু করে যত বেশি ক্রুশ্চভ সংশোধনবাদীরা তাদের ক্ষমতা সংহত করতে থাকে। যে পরিমাণে সোভিয়েত রাষ্ট্র পুঁজিবাদ অভিমুখে এগোতে থাকে সে পরিমাণেই সে একটি আধিপত্যবাদী শক্তিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। ব্রেজনেভ আমলে ভারতীয় শাসক শ্রেণীর সঙ্গে সোভিয়েত শাসকদের বোঝাপড়া গুণগতভাবে বদলে যায় এবং সোভিয়েতের অর্থনৈতিক সহযোগিতা স্পষ্টতই জনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬৫ সালে বিশেষতঃ তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মস্কো সফরের পর সোভিয়েত ৬ হাজার মিলিয়ন টাকার একটি অতিরিক্ত ঋণ ভারতকে দেয় যার খানিকটা পুরনো প্রকল্পগুলিতে (ভিলাই, বোকারো) কাজে লাগাবার জন্য, বাকিটা সোভিয়েত থেকেই কাঁচা মাল যন্ত্রাংশ এবং বিমান নির্মাণ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ক্রয় করার জন্য। ১৯৬৫-তেই কলকাতার সোভিয়েত দূতাবাসের প্রতিনিধি বলেন যে তাদের দেশ বেসরকারি ক্ষেত্রেও বুনিয়াদী শিল্পে বিনিয়োগ করার জন্য প্রস্তুত। এ সবই ভারতে সোভিয়েত সাহায্যের এক নতুন বাঁকের সূচনা। ১৯৭০-এর দশকে ভারতের বুকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব এমন প্রবল হয়ে ওঠে যে তখনকার মতো মার্কিন প্রভাব ক্ষুণ্ণ হয়। সোভিয়েতের চরিত্রে যে পরিবর্তনই আসক না কেন দু অবস্থাতেই রুশ-মার্কিন টানাপোড়েন থেকে ভারতীয় পুঁজিপতিরা তাদের নিজস্ব শক্তিবৃদ্ধিতে সুবিধা পেয়েছে। দুটি বড় শক্তির এই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়ারা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, রাজনৈতিক ভাবেও সময় ও সুযোগ মত একটি আপেক্ষিক স্বাধীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে শুরু করে। ১৯৫০-এর দশকে ''পঞ্চশীল নীতি''র অন্যতম প্রবক্তা হওয়া থেকে শুরু করে ৭০-এর দশকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা তারই উদাহরণ।

এটা যে ভারতীয় বৃহৎ বুর্জোয়াদের পক্ষে সম্ভব হলো তার মূল নিহিত রয়েছে ভারতীয় পুঁজির বিকাশের মধ্যে— যা অন্যান্য পিছিয়ে পড়া দেশগুলির তুলনায় অনেক বেশি উন্নত ছিল এবং যার যাত্রা শুরু হয়েছিল গত শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই।

সবুজ বিপ্লবভারতের কৃষিতে পুঁজিবাদী উত্পাদন পদ্ধতির বিস্তার

ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের নেতৃত্বে গঠিত ভারত সরকার ১৯৪৭-এর পর থেকেই দেশে শিল্প-বিস্তারের উপর তাদের প্রধান ঝোঁক দেখিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলিতে বিশেষতঃ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় সরকার সচেতনভাবেই কৃষির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিল। প্রথম পরিকল্পনায় ভারত সরকার সমগ্র ব্যয়বরাদ্দের ৩৭ শতাংশ কৃষির ক্ষেত্রে নিয়োজিত করেছিল যা শতকরার হিসাবে আজও পর্যন্ত সর্বাধিক। এছাড়া আংশিক ভূমিসংস্কার ও ১৯৫০-৬৭ পর্যন্ত কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামও কৃষির উত্পাদনশীলতা বাড়াতে ব্যর্থ হয়। কৃষির উত্পাদনশীলতা বাড়াবার সরকারি প্রচেষ্টা ১৯৬৬-৬৭ সাল থেকেই এক চমকপ্রদ সাফল্য আনতে শুরু করে। এই সাফল্যের পিছনে যে সরকারি কর্মসূচিটি ক্রিয়াশীল ছিল তার নাম 'সবুজ বিপ্লব'। 'সবুজ বিপ্লব'কে এক সার্বিক প্রকল্প হিসেবে ভারত সরকার গ্রহণ করেছিল, যার মুখ্য বিষয়গুলি ছিল উচ্চফলনশীল (HYV) বীজের প্রয়োগ, ভূমির উপরের ও নীচের জল ব্যবহার করে উন্নত জলসেচ ব্যবস্থা, কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার, জমির সংহতিকরণ, সরকারি উদ্যোগে ভূমিসংস্কার, কৃষি-ঋণ-সরবরাহের জন্য সরকারি উদ্যোগ, গ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণ, গ্রামীণ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষিপণ্য বিক্রয়ের যথাযথ ব্যবস্থা, কৃষি খামারের যান্ত্রিকীকরণ ইত্যাদি। ''সবুজ বিপ্লব'' পরবর্তীকালে এই কর্মসূচী ভারতের কৃষিকে শুধু নয়, ভারতের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ও ভারতের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। যেহেতু উচ্চফলনশীল বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষিযন্ত্রপাতি ইত্যাদির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এই তথাকথিত বিপ্লবের অপরিহার্য অঙ্গ, তাই এর ফলে বিশাল পরিমাণে সাম্রাজ্যবাদী বিনিয়োগের পথ সুগম হয়, দেশের অভ্যন্তরে কৃষি উপকরণের বিরাট ব্যবসা কিছু সম্পন্ন লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। বড় মাত্রায় পুঁজির বিনিয়োগ, বাজারের সম্প্রসারণ, উদ্বৃত্তের পুনর্বিনিয়োগের ধরন সূচনা করে যে কৃষিতে সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন সম্পর্ক ভাঙছে, পুঁজিবাদী সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ''সবুজ বিপ্লব'' ভারতের কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষককে সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে এনে ফেলেছে এবং এর ফলাফল এমন সুদূরপ্রসারী হয়েছে যে এ বিষয়টি আরও একটু বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।

''সবুজ বিপ্লব''-এর কর্মসূচী রূপায়ণের জন্য সরকার ভারতের কয়েকটি বিশেষ অঞ্চল বেছে নিয়েছিল। প্রধানত এগুলি হলো পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশ। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এসব স্থানে জলসেচ ব্যবস্থা সহ সাধারণভাবে কৃষিব্যবস্থাই বহু আগে থেকে উন্নত ছিল। উৎপাদনশীলতাও ছিল অবশিষ্ট ভারত থেকে বেশি। ১৯৬৫ সালে ''সবুজ বিপ্লব'' শুরুর আগে যেখানে ভারতের উত্পাদনশীলতা ছিল হেক্টর প্রতি ৭৫৬ কেজি, সেখানে পাঞ্জাবের ছিল হেক্টর প্রতি ১২৩১ কেজি। ১৯৬০-র দশকের আগে থেকেই পাঞ্জাবের কৃষি উত্পাদন সম্পর্কে সামন্ততান্ত্রিক উপাদান ভারতের অন্য যে কোন অংশের তুলনায় কম ছিল। তাই পাঞ্জাবই ছিল 'সবুজ বিপ্লব' কর্মসূচী রূপায়ণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত রাজ্য। ''সবুজ বিপ্লব''-এর নির্ধারক উপাদান ছিল উচ্চ ফলনশীল বীজ। এই বীজ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হয় অনেক বেশি পরিমাণে সার, কীটনাশক, জল ও খামারের যন্ত্রপাতি। এর সব কটির ব্যবহার সাম্রাজ্যবাদী বিনিয়োগ ও ব্যবসাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভারত সরকার ১৯৬৬-৭১ চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিদেশ থেকে ঐ সকল সামগ্রী আমদানি করতে ২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছিল। লক্ষণীয় এই অর্থের পরিমাণ তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কৃষিতে মোট বরাদ্দের ৩ গুণ। আমেরিকার ফোর্ড ও রকফেলার ফাউন্ডেশন-এর তত্ত্বাবধানেই ভারতের বুকে চালু হয়েছিল উচ্চফলনশীল বীজ (HYV)। স্পষ্টতই সাম্রাজ্যবাদ এই বীজের ব্যবহার চালু করেছিল যাতে ভারতে তারা বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করতে পারে।

''সবুজ বিপ্লব'' তথা উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার এমনই একটি পদ্ধতি যেটি কৃষিতে বিনিয়োগের মাত্রা উত্তরোত্তর বাড়াতেই থাকে। কারণ এই বীজগুলির সাহায্যে যে চাষ হয় তাতে কীট-বীজাণুর আক্রমণ অনেক বেশি হয়। শুধু তাই না, এই আক্রমণ স্বাভাবিক খাদ্য শৃঙ্খলের নিয়মে অন্য খাদকের আক্রমণ দ্বারা প্রতিহত হয় না। তার জন্য দরকার পড়ে একটি সুনির্দিষ্ট ধরনের কীটনাশক। আবার কিছুদিন পরে ঐ নির্দিষ্ট বীজাণু যখন পুরনো কীটনাশককে সহ্য করে ফেলে, তখন আবার চাই আরও উন্নত কীটনাশক। রাসায়নিক সারের ব্যবহারও একই রকম দুষ্টচক্রের শিকার। মাটির উর্বরাশক্তি কেবলই কমতে থাকে। আর প্রয়োজন হয় আরও উন্নতমানের এবং আরও বেশি পরিমাণে রাসায়নিক সারের ব্যবহার। এই প্রক্রিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী ও ভারতীয় বৃহৎ পুঁজির ব্যবসা একদিকে ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল, অন্যদিকে ধ্বংস করে দিতে লাগল আমাদের দেশের হাজার হাজার প্রজাতির ধান, গম ও সবজির উচ্চফলনশীল বীজ যা আমাদের দেশের মাটি ও ভৌগোলিক পরিবেশের পক্ষে উপযোগী। এতে ভারতীয় কৃষির চিরস্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেল এবং এখনও এই ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। শুধু তাই নয়, এই পদ্ধতির প্রবর্তন স্থায়ীভাবে মাটির স্বাভাবিক উর্বরাশক্তি নষ্ট করলো, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করলো, মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করলো, এমনকি মত্স্যচাষেরও ক্ষতি করলো। এ কথা সত্য যে ''সবুজ বিপ্লব'' চালু হবার পর প্রথম দু'দশক কৃষির উত্পাদনশীলতা বেড়েছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে তা সৃষ্টি করে গেল ভবিষ্যতে ভারতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির ব্যবসার জন্য এক সুদূরপ্রসারী বন্দোবস্ত। ''সবুজ বিপ্লব''-এর এলাকাগুলিতে বিশেষত পাঞ্জাবে বিপুল পরিমাণে পুঁজির বিনিয়োগ কৃষিব্যবস্থায় পুঁজিবাদী রূপান্তরের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে উপস্থিত হয়। জমির কেন্দ্রীভবন, গরীব ও ক্ষুদ্র কৃষকের জমি হারানো, উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি, কৃষি-মজুরের আনুপাতিক সংখ্যা বৃদ্ধি— সমস্ত বিচারেই ''সবুজ বিপ্লব''-এর ফলে কৃষি ব্যবস্থার পুঁজিবাদী বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে ভারতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির তত্ত্বাবধানে ''সবুজ বিপ্লব''-এর এক নতুন পর্বের সূচনা হয়। আমরা পরে দেখবো এই সময়ে নতুন উদ্যমে বহুজাতিকদের তত্ত্বাবধানে পুঁজিবাদী বিনিয়োগ শুরু হয়— যা কৃষিতে পুঁজিবাদী রূপান্তর আরও বাড়িয়ে দেয়।

বিশ্বায়নের পর্বে ভারতের অর্থনৈতিক ''বিকাশ''

গত শতাব্দীর ৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারত দেশের অর্থনীতিতে উদারনীতির সূত্রপাত ঘটায়। এই নীতি ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের গ্রহণ করা কোন স্বাধীন নীতি নয়। ঐ সময় আন্তর্জাতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদ যে গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে প্রবেশ করেছিল তা থেকে উদ্ধার পাবার জন্য উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর বাইরে বিশেষতঃ উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারে বাধাহীনভাবে অনুপ্রবেশ জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছিল। এই প্রয়োজন মেটানোর জন্যই পুঁজির বাজারের 'বিশ্বায়ন'-কে একটি নতুন অর্থব্যবস্থা হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলা হয়। আমাদের দেশের শাসকশ্রেণী ধাপে ধাপে এই অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হবার জন্য তাদের অর্থনৈতিক নীতিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাবার জন্য এগোতে থাকে। ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালেই দু দফায় লাইসেন্সিং প্রথা শিথিল করা হলো। এর ফল হলো দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিরা অনেক স্বাধীনভাবে ভারতের বাজারে বিনিয়োগ করতে, শিল্পস্থাপন করতে ও ব্যবসা করতে পারবে। ১৯৯০ সালের ৩১ মে উদারীকরণ নীতিতে আর এক ধাপ এগিয়ে স্থায়ী সম্পদে ২.৪ কোটি টাকা বিনিয়োগকৃত এবং নতুন গড়ে ওঠা সকল শিল্পের জন্য লাইসেন্স প্রথা তুলে দেওয়া হলো, যে কোন শিল্পে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদন করে দেওয়া হলো আঞ্চলিক বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হলো, ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য সিলিং তুলে দেওয়া হলো। ১৯৯১-এর জুলাইতে ভারত সরকার 'নয়া অর্থনৈতিক নীতি' ঘোষণা করে। এর ফলে ভারতের বাজার আক্ষরিক অর্থেই আন্তর্জাতিক পুঁজির কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। একই সঙ্গে ভারতের বৃহৎ পুঁজিও এই নীতির ফলে প্রভূত লাভবান হলো। দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিদের একটি অংশ পুঁজির পরিমাণের বিচারে আগেই একটা উচ্চস্তরে পৌঁছে গিয়েছিল। ''নয়া অর্থনৈতিক নীতি'' ছোট ও মাঝারি শিল্পের যে সুরক্ষাগুলি ছিল তা তুলে দেওয়ার ফলে তাদের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়। বিদেশী প্রযুক্তি ও পুঁজির সাথে মৈত্রী করে শুধু দেশের বাজারে যে একচ্ছত্র আধিপত্য করতে থাকে তাই নয়, বিদেশের বাজারেও তারা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে এবং সাফল্য লাভ করে। ১৯৯৪ সালে ভারত সরকার 'গ্যাট' চুক্তিতে স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়াকে চরম পরিণতি দেয়।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলিকে এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ফেলে দেবার ফলে তাদের মধ্যে অসংখ্য শিল্প ও কারখানা রুগ্ন হয়ে পড়লো বা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। এমনকি বৃহৎ পুঁজিপতিদেরও বহু শিল্প ও কারখানা রুগ্ন বা বন্ধ হয়ে পড়লো। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার পরিচালিত বহু কারখানা প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে বন্ধ হয়ে গেল। বিগত ২০ বছরে সারা দেশে কয়েক লক্ষ কারখানা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজি কৃষির মত লাভজনক ক্ষেত্র ছাড়াও টেলিকম, বীমা, বিদ্যুৎ, লৌহ ও ইস্পাত, অটোমোবাইল, ওষুধ ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রেই হাত বাড়িয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ নীতিগতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ব্যাঙ্ক ও বীমা, বিমানবন্দর ও বিমান চলাচল, রেল, খনি, এমনকি অস্ত্র নির্মাণেও বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া কোথাও দ্রুত, কোথাও ধীরগতিতে চালু করা হয়েছে। দীর্ঘদিন লোকসানে চলা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকে বন্ধ করে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করা তো হয়েছেই এমনকি লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকেও বেসরকারিকরণের দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। একই সঙ্গে আমাদের এই চিত্তাকর্ষক ঘটনাটিরও স্বীকৃতি দিতে হবে যে গত পাঁচ দশক ধরে চলতে থাকা এই রাষ্ট্রীয় পুঁজির শক্তি ভারতীয় রাজনীতি-অর্থনীতিতে এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে য়ে বেসরকারিকরণের এই সুতীক্ষ্ণ আওয়াজের সময়ও তা কিন্তু বেড়েই চলেছে। ১৯৯৭-৯৮-তে যেখানে দেশে ২৩৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ছিল ২০০৬-০৭-এ তা বেড়ে হয়েছে ২৪৭টি। ঐ একই কালপর্বে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত মোট পুঁজির পরিমাণ ২৪৯৮৫৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬ৃ৬৫ৃ১২৪ কোটি টাকা; অর্থাৎ ঐ ৯ বছরে ভারতের আমলাতান্ত্রিক পুঁজি ২৬৬ শতাংশ বেড়েছে। VSNL, IPCL, মারুতি উদ্যোগ লিমিটেড CMCL-এর মত সংস্থা বেসরকারিকরণ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভারতের আমলাতান্ত্রিক পুঁজি এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী।

উদারনীতির সকল কার্যক্রমই সূচিত করে যে তার একমাত্র লক্ষ্য সাম্রাজ্যবাদী ও বৃহৎ পুঁজিকে আশু সঙ্কটের হাত থেকে রক্ষা করা। তার ঘোষিত নীতি হলো সাম্রাজ্যবাদী ও বৃহত্পুঁজির বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য কোনও বাধাই আর বরদাস্ত করা হবে না। তার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সরকারি বিধিনিষেধ থেকে তাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা। উদারনীতির সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো— শিল্প বা ব্যবসা চালানো সরকারের কাজ নয়, তাই সরকারকে এই সব কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। ভারতের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সরকারি বিধিনিষেধ থেকে বৃহৎ পুঁজিকে রক্ষা করতে চালু করা হলো ''বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন, ২০০৫।'' দেশের প্রচলিত শ্রম-আইনের নানা বিধিনিষেধের বেড়ি যাতে বল্গাহীন শোষণের ক্ষেত্রে বাধা না হয়ে উঠতে পারে তার জন্যই এই আইন। এই আইনের পিছনে রয়েছে নানা ছলচাতুরি। যেমন সেজ-অঞ্চলে কেবল রপ্তানিকেন্দ্রিক শিল্প-উত্পাদন হবে বলা হলেও বিনোদন, আবাসন তৈরি ইত্যদিকেও নানা অছিলায় এর আওতাভুক্ত করা হয়েছে। একইভাবে অসংখ্য পণ্য যা আগে শহর এবং গ্রামীণ কুটির শিল্পে উত্পাদন হতো, বৃহৎ পুঁজি সেখানে অনুপ্রবেশ করে সেগুলিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নিজের তাগত বাড়িয়েছে। খুচরো বিপণনেও দেশি-বিদেশি বৃহৎ কোম্পানিগুলিকে ঢুকে পড়ার সুযোগ করে দিয়ে অসংখ্য ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের তাদের উপার্জন ক্ষেত্র থেকে ছিটকে দেওয়া হয়েছে। এক কথায় এই নীতির ফলে দেশি-বিদেশি বড় পুঁজির কাছে দেশের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, উত্পাদন ক্ষেত্র ও লাভজনক ব্যবসা তুলে দেওয়া হয়েছে। ভারতে একচেটিয়া পুঁজির (বিশেষতঃ বিদেশি একচেটিয়া পুঁজি) বৃদ্ধির সামনে দুটি বড় বাধা ছিল কৃষিতে আধা-সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কের উপস্থিতি এবং শিল্প-বাণিজ্যের বহু ক্ষেত্রে ছোট পুঁজির চলাচল ও সুযোগ। উদারীকরণের নীতির ফলে তার অনেকটাই অপসারিত হলো। ফলে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ ও বৃদ্ধি হয়ে উঠলো অভূতপূর্ব। মোট পুঁজির পরিমাণ ও পুঁজির বিকাশের গতির দিক থেকে আমাদের দেশ অনেক পুঁজিবাদী দেশের সাথে তুলনীয় হয়ে উঠেছে, অনেক পণ্যের উত্পাদনে অন্যান্য উন্নত পুঁজিবাদী দেশকে ছাড়িয়ে গেছে, কৃষি-শিল্প-পরিষেবা— সকল ক্ষেত্রেই উত্পাদন পদ্ধতি ও প্রযুক্তি মূলতঃ পুঁজির নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। ২০১০-এ আমাদের দেশ মোটর সাইকেল উত্পাদনে পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর প্যাসেঞ্জার কার ও মানববাহী গাড়ি উত্পাদনের পৃথিবীতে অষ্টম স্থান অধিকার করেছে। ভারতে শিল্প বিকাশের হার গত শতাব্দীর ৭০-৮০-র দশক থেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলির বিকাশের হারের সাথে তুলনীয় তো বটেই, কখনও কখনও আদর্শ স্থানীয়।

ভারতীয় পুঁজির এই ধরনের বিকাশের বিকৃতির দিকটিতেও আমাদের গভীর মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে। না হলে মূল্যায়ন পূর্ণাঙ্গ হবে না। ভারতীয় পুঁজির এই বিকাশের প্রকৃতি কোন সনাতনী পুঁজিবাদী ধরনের নয়। এটি হচ্ছে দেশের সমাজ ও অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রয়োজনের বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া পুঁজির উপর নির্ভরশীল একটি বিশেষ প্রকৃতির, এক কথায় যাকে বলা যায় বিকৃত পুঁজিবাদী বিকাশ। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পর্যায়ে এই পুঁজির জন্ম ও বিকাশ হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ পুঁজির হাত ধরে। তার পরবর্তী পর্বে ১৯৯০ পর্যন্ত তা নির্ভরশীল থেকেছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির প্রযুক্তির উপর। বিশ্বায়নের পর্বে, অর্থাৎ ১৯৯১-এর পর থেকে এই পুঁজি আন্তর্জাতিক পুঁজির সাথে প্রতিযোগিতা ও মৈত্রীর মাধ্যমে তার বিকাশ ঘটিয়েছে এবং তার নিজস্ব প্রয়োজন ও সমস্যাকে মোকাবিলা করছে আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে সংপৃক্ত হয়েই। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে বুর্জোয়া বিপ্লবের কালে বা মৌলিক বুর্জোয়া সংস্কারের সময়ে নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তন ঘটে এবং সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ থেকে যাওয়া সত্ত্বেও সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিকাঠামোয় বুর্জোয়া ধরনের রূপান্তর সাধিত হয়। যে কোন ধরনের পুঁজিবাদেই কিছু না কিছু বিকৃতি থাকেই। বাজার তৈরির জন্য সে সমাজে 'ভোগবাদ' ছড়িয়ে দেয়, সমাজের প্রয়োজনে নয়, তার নিজস্ব মুনাফার তাড়নায় চালিত হয়ে সে ঠিক করে কোন পণ্যের উত্পাদনে বিনিয়োগ করবে। একটি সুস্থ, সুন্দর ও সর্বাঙ্গীন সামাজিক বিকাশের দিকে তার নজর দেবার অবকাশ নেই, প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার দিকেও তার কোন মনোযোগ নেই। এই ধরনের বিকৃতি পুঁজির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এগুলি সহই দেশটির নিজস্ব প্রয়োজন, বৈশিষ্ট্য ও বিকাশের স্তর অনুযায়ী সে দেশ তার পুঁজিবাদী বিকাশের নিজস্ব যাত্রাপথ করে নেয়। ভারতীয় পুঁজির বিকাশের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী উত্পাদন ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত এই বিকৃতি ছাড়াও অন্য একটি বিকৃতিও যুক্ত হয়েছে। এখানে পুঁজি মৌলিকভাবে বৈদেশিক পুঁজি ও প্রযুক্তির দ্বারা প্রভাবিত ও তার উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে তা ভারতীয় সমাজ অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য দ্বারা যত না প্রভাবিত হয়েছে, তার তুলনায় বেশি প্রভাবিত হয়েছে বৈদেশিক প্রযুক্তির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও তার প্রয়োজন ও পরিকল্পনা দ্বারা। এ থেকে দুটি ফলই পাওয়া গেছে। কোন কোন পর্বে তা এদেশের পুঁজিবাদী বিকাশের বেগ বাড়িয়েছে, উল্টোদিকে অর্থনীতির পুঁজিবাদী বিকাশের স্বাভাবিক চাহিদা ও চরিত্র অনুযায়ী রূপ পেতে তা বাধারও সৃষ্টি করেছে। এর ফলে নানা ধরনের পশ্চাত্পদতা ভারতের সমাজ-অর্থনীতির উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। ফলে অদ্ভুত এক দ্বৈত প্রকৃতি ভারতীয় অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। একবিংশ শতাব্দীর ভারত তাই সারা বিশ্বের সামনে ''উন্নয়ন'' ও পশ্চাত্পদতার যুগপৎ বিস্ময়!

বিশ্বায়নের পর্বে ভারতীয় কৃষি

গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে ভারতের কৃষিব্যবস্থা এক গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। 'সবুজ বিপ্লব'-এর এলাকাগুলিতে উত্পাদনের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়ে আসে। কৃষির বিকাশের হার ২ শতাংশের নীচে নেমে আসে। সমগ্র দেশে খাদ্য সঙ্কট বাড়তে থাকে। এমনই এক খারাপ পরিস্থিতিতে ১৯৯৪ সালে ভারত সরকার 'গ্যাট' চুক্তিতে সই করে। এই চুক্তির অন্তর্গত হবার অর্থ দাঁড়াল দেশের কৃষিব্যবস্থা তথা গোটা অর্থনীতি দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির দখলে চলে গেল।

এই চুক্তির ফলে ভারতের কৃষিতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির নিয়ন্ত্রিত বীজ, কীটনাশক ও সারের অনুপ্রবেশ এক সামগ্রিক চেহারা নিল। HYV বীজ কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী ও বৃহৎ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার চাষীর পক্ষে বাধ্যতামূলক করে তুলেছিল তা আমরা আগে দেখেছি। এবার নতুন সংযোজন হলো ''টার্মিনেটর বীজ' যা একবারই মাত্র ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ কৃষক চাষ করে ফলাবে বন্ধ্যা বীজ যা থেকে পরের বার আর ফসল উত্পাদন করা যাবে না। এর ফলে কৃষকের উত্পাদন খরচ বিপুল পরিমাণে বেড়ে যেতে লাগলো, আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ফলে ফেঁপে উঠতে লাগলো। বহুজাতিক সংস্থাগুলি যাতে তাদের ব্যবসার পক্ষে অনুকূল এইসব নানান জাতের বীজের আইনসিদ্ধ ব্যবসা ভারতের বুকে ফাঁদতে পারে তার জন্য ২০০৪ সালে ভারত সরকার সংসদে নিয়ে এল ''সীড বিল ২০০৪''।

এইভাবে গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক থেকে এক ''নতুন সবুজ বিপ্লব''-এর সূচনা করা হলো যার মূল বৈশিষ্ট্য হলো রসায়নাগারে জিন প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত ''জি এম বীজ''-এর ব্যবহার সারা দেশ জুড়ে ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে দেওয়া। তাতে সারা দেশব্যাপী বীজের আনুষঙ্গিক সার, কীটনাশক, সেচের জল, ট্র্যাক্টর-পাম্পসেট ইত্যাদির ব্যবহার ছড়িয়ে পড়বে এবং সাম্রাজ্যবাদ-বৃহত্পুঁজির বাজার হু হু করে বেড়ে উঠবে। লক্ষণীয় যে এই ''নতুন সবুজ বিপ্লব'' পুরনো সবুজ বিপ্লবের মতো নির্দিষ্ট এলাকা বেছে সংহত করা হয় নি। দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির হিসাবে ''যথাযথ'' ভাবে ''নতুন সবুজ বিপ্লব''-এর এলাকা সৃষ্টি করতে যে অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে বা তার জন্য কৃষি ব্যবস্থায় যে আমূল সংস্কার সাধন করতে হবে তার থেকে অনেক সহজে পণ্যের বাজার বাড়িয়ে নেওয়া যায় যদি অপরিকল্পিত ও বিক্ষিপ্তভাবে গোটা দেশ জুড়ে সার, বীজ, কীটনাশক, ট্র্যাক্টর আর পাম্পসেটের ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়া যায়। বিগত দু দশক ধরে এই প্রক্রিয়াই চলছে। এসময় থেকেই ভারতের কৃষি-ক্ষেত্রে উত্পাদিকা শক্তির একটি ধারাবাহিক বিকাশ ঘটছে এবং কৃষিতে পুঁজির ভূমিকাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

একেবারে সাম্প্রতিকতম তথ্য না পাওয়া গেলেও বিগত কয়েকটি দশকের যেটুকু হিসাব পাওয়া যায় তাতে কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগের ধারাবাহিক বৃদ্ধি স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে এই প্রবণতা আজও বিদ্যমান। ২০০৪ সাল পর্যন্ত হিসাবে দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে যত ট্র্যাক্টর আছে তাতে ট্র্যাক্টর পিছু জমির পরিমাণ ১১৯ হেক্টর, যা কিনা একটি ট্র্যাক্টর দিয়ে ১ মাসে চাষ করে ফেলা যায়। ১৯৯৯-২০০০ সাল থেকে ২০০৩-২০০৪ সালে ভারতে ট্র্যাক্টর বিক্রি হয়েছে ১১,৮৮,৭৩৫টি। ঐ একই সময়ে পর্বে পাওয়ার টিলার বিক্রি হয়েছে ৭৫,৫৬৬টি। ১৯৮২-৮৩ তে যেখানে কৃষিতে বিদ্যুতশক্তির ব্যবহার হয়েছিল ১৭৪১৭ মিলিয়ন কিলো ওয়াট ঘন্টা, সেখানে ১৯৯৮-৯৯তে হয়েছিল ৯৭,১৭৫ ঘন্টা, ২০০১-২০০২-এ তা একটু কমে হয়েছিল ৮১,৬৭৩ ঘন্টা যা দেশে মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রায় ৩০ শতাংশ। নাইট্রোজেন-ফসফেট-পটাশিয়াম সারের ব্যবহারে বৃদ্ধির মাত্রা আরও চমকপ্রদ। ১৯৫১-৫২ তে ৬৫ হাজার টন, ১৯৮২-৮৩ তে ৬,৩৮৮.৩ হাজার টন এবং ২০০২-০৩-এ ১৬,০৯৪ হাজার টন। অর্থাৎ ১৯৫১-৫২-র তুলনায় ২০০২-০৩-এ বৃদ্ধির পরিমাণ ২৪৫.৬ গুণ। কীটনাশক বিষের ব্যবহার ১৯৬০ সালে ছিল ২০০০ টন, যেটা ১৯৯৩-৯৪ তে হয়েছে ৯০,০০০ টন। HYV বীজ ব্যবহার হয় এমন জমির পরিমাণ ১৯৯৩-৯৪ সালে ধানের ক্ষেত্রে ছিল ৭০% এবং গমের ক্ষেত্রে ১৯৯২-৯৩ তেই ছিল ৯০.৮%। ১৯৫০-৫১ সালে মোট কর্ষিত জমি ছিল ১১৮.৭৫ মিলিয়ন হেক্টর, যার মধ্যে সেচ-সেবিত জমি ছিল ২২.৫৬ মিলিয়ন হেক্টর, আর ২০০০-২০০১ সালে মোট কর্ষিত ১৪১.১০ মিলিয়ন হেক্টর জমির মধ্যে ৭৫.১৪ মিলিয়ন হেক্টর জমি ছিল সেচ-সেবিত। এ প্রসঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের বৃদ্ধির পরিমাণটিও উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৯৭-৯৮-তে এই ঋণের (সমবায় ব্যাঙ্ক, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ও বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক সম্মিলিতভাবে) পরিমাণ ছিল ৩১,৯৫৬ কোটি টাকা যা ২০০৩-২০০৪-এ বেড়ে হয়েছে ৮০,০০০ কোটি টাকা।

কৃষিতে পুঁজির বিনিয়োগের বৃদ্ধির সাথে সাথে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন গ্রামীণ জীবনে বেড়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর ঋণগ্রস্ততা। ২০০৩-এর সংগৃহীত তথ্য থেকে দেখা যায় ঐ সময়ে ভারতে গ্রামীণ পরিবারের সংখ্যা ছিল ১৪.৭৯ কোটি, তার মধ্যে ৮.৯৪ কোটি (৬০.৪%) পরিবারই ছিল কৃষির সঙ্গে যুক্ত। এই ৮.৯৪ কোটি পরিবারের মধ্যে ৪.৩৪ কোটি (৪৮.৬%) পরিবারই ছিল ঋণগ্রস্ত। এক হেক্টর বা তার কম জমির মালিকের পরিবারের সংখ্যা ছিল মোট জমির মালিক পরিবারের ৬৬ শতাংশ। এদের মধ্যে ৪৫ শতাংশই ঋণগ্রস্ত। এই ভয়ংকর ঋণগ্রস্ততা সাবেকী মহাজনী ঋণের থেকে একেবারেই আলাদা। কৃষিক্ষেত্রে বিশ্বায়িত পুঁজির দাপটে এই ঋণ কৃষককে নিঃস্বে পরিণত করেছে। এই ঋণ মূলত নেওয়া হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির কাছ থেকে বীজ-সার-কীটনাশক কিনতে। তাই পরিবার পিছু ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও কেরলে। উল্লেখযোগ্য এই পর্বে ব্যক্তিগত সুদখোরদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ প্রভূত পরিমাণে কমেছে। ২০০৩-এর হিসাব অনুযায়ী মোট ঋণের মাত্র ২৬ শতাংশ সুদখোরদের কাছ থেকে নেওয়া। গত ২০ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ঋণগ্রস্ত কৃষক পরিবারগুলির শতাংশের হিসেবে প্রথম কয়েকটি রাজ্য হলো— অন্ধ্রপ্রদেশ ৮২%, তামিলনাড়ু ৭৪.৫%, পাঞ্জাব ৬৫.৪%, কেরালা ৬৪.৪%, কর্ণাটক ৬১.৬%, মহারাষ্ট্র ৫৪.৮%। এছাড়া ৫০% – ৫৩% ঋণগ্রস্ত পরিবার পাওয়া যায় হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে। ঋণগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যার বিচারে অনেক পিছনে রয়েছে বিহার (৩৩%), ওড়িশা (৪৭.৮%), ঝাড়খণ্ড (২০.৯%), ও ছত্তিসগড় (৪০.২%)।

সাম্রাজ্যবাদ-বৃহত্পুঁজি নিয়ন্ত্রিত নতুন কৃষি প্রকরণের সঙ্গে এই ঋণগ্রস্ততা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এই ঋণের ফাঁদ সবুজ বিপ্লব এলাকার কিছু কিছু সম্পন্ন কৃষক থেকে শুরু করে মাঝারি ও ছোট জোতের মালিক মধ্য ও ক্ষুদ্র কৃষককেও বিপন্ন করে তুলেছে। ব্যাপকভাবে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ কৃষিপণ্যের বাণিজ্যে উদারীকরণের জন্য কৃষিপণ্যের বিক্রয়মূল্যর উপর গুরুতর আঘাত নেমেছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা উচ্চভর্তুকিপ্রাপ্ত কৃষিপণ্যে বাজার ছেয়ে যাচ্ছে। কৃষিপণ্যের আমদানি শুল্কর উপর থেকে ''পরিমাণগত বাধা'' তুলে নেবার ফলে কৃষিজাত পণ্যের আমদানি হু হু করে বাড়ছে এবং আচমকাই কৃষিপণ্যের দাম পড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া কৃষি বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয়ে রোগ পোকার সর্বনাশা আক্রমণে, কখনও খারাপ বীজের কারণে, কখনও পর্যাপ্ত জলের অভাবে কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। ফলে চাষের জন্য নেওয়া ঋণ শোধ করতে না পেরে হাজারে হাজারে কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। যারা বেঁচে থাকছে তারা আবার নতুন ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র জোতের কৃষকদের উপর ঋণের বোঝা আরও মর্মান্তিক। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই খারাপ থাকে যে তাদের ক্ষুদ্র জোতে অনেক বেশি ফলন করতে না পারলে তাদের অস্তিত্বই সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। তাই তারা চেষ্টা করে অনেক বেশি পরিমাণে বাহ্যিক উপকরণ এবং নিজেদের শ্রম ও মনোযোগ ব্যবহার করে নিবিড় চাষের সাহায্যে উত্পাদন বাড়িয়ে নিতে। ক্ষুদ্র জোতে যে তুলনামূলকভাবে বেশি উত্পাদনশীলতা লক্ষ্য করা যায় এটিই তার কারণ। কিন্তু যেহেতু ক্ষুদ্র চাষী প্রয়োজনীয় পুঁজি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংগ্রহ করতে পারে না তাই তাকে ধারে সার-বীজ-কীটনাশক ইত্যাদি কিনতে হয়। ট্র্যাক্টর-পাম্প ইত্যাদিও ধারে ব্যবহার করতে হয়। উত্পন্ন ফসল বিক্রি করে তাকে ধার শোধ করতে হয়। উপকরণ কেনার সময় তাকে বেশি দামে কিনতে হয় (ধারে কেনে বলে), আবার ফসল ওঠার পরে পরেই যখন দাম কম থাকে তখন বিক্রি করতে হয়। ক্ষুদ্র কৃষক প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ তুলনায় কম পায় বলে ব্যবসায়ীর কাছে ধার রাখতে বেশি বাধ্য হয়। এতে একদিকে যেমন বৃহৎ পুঁজির পক্ষে যাবতীয় কৃষি-উপকরণের বাজার নিশ্চিত হয়, অন্য দিকে তার স্থানীয় দালাল কৃষি উপকরণের ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিক লাভের উপরেও কিছু বাড়তি উদ্বৃত্ত লাভ করে। খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে উত্পাদনের জন্য যারা ধারে উপকরণ দেয় তারা প্রাক-পুঁজিবাদী মহাজন নয়। ''সবুজ বিপ্লব'', পুঁজিনিবিড় চাষ, কৃষি-বাস্তুতন্ত্রে বিপর্যয়— ইত্যাদি হচ্ছে এদের ব্যবসার জন্ম ও বিকাশের পিছনে ক্রিয়াশীল কারণ। এরা ঋণী কৃষককে আবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে কম মজুরিতে কাজ করিয়ে নেয় এমন ঘটনাও প্রায় চোখে পড়ে না। তাই এই ঋণদাতারা কোন অর্থেই সাবেকী মহাজন নয়। বরং এদের বলা যায় সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সাম্রাজ্যবাদী ও বৃহৎ পুঁজির স্থানীয় এজেন্ট। সেই জন্য এই ঋণগ্রস্ততাকে সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন সম্পর্কের নজির হিসেবে দেখার কোন উপায় নেই।

কৃষির এই সঙ্কট জোতের বিন্যাসেও গুরুতর সব পরিবর্তন আনে। কৃষিতে ''সবুজ বিপ্লব'' যা পরবর্তীকালে ৯০-এর দশকের ''নতুন সবুজ বিপ্লব'', কৃষিব্যবস্থার সার্বিক সংস্কার বা উন্নয়নের কোনো ধরনের পরিকল্পনাই গ্রহণ করলো না। 'সবুজ বিপ্লব' প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগের সম্ভাবনা খারিজ করে ভারত সরকার গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে এসে নির্বিচারে সারা দেশ জুড়ে বহুজাতিকদের পণ্য বীজ-সার-কীটনাশক প্রয়োগ করার পলিসি গ্রহণ করে। ফলে বাছাই করা কয়েকটি ক্ষেত্রে 'চুক্তি চাষ' ইত্যাদির মাধ্যমে লাভজনক ফসলের বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে সার্বিক অর্থে কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগের প্রবণতা নাকচ হয়ে যায়। তার বদলে লাভজনক বিনিয়োগ শুরু হলো কৃষি উপকরণের বাণিজ্যে। এতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির শিল্প পুঁজি ও বাণিজ্যিক পুঁজির মুনাফা নিশ্চিত থেকেছে। আর কৃষি উত্পাদনের সমস্ত ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা, বিপর্যয় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মূলতঃ প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের উপর, কিছুটা মাঝারি-কৃষকদের উপর। জমির খণ্ডীভবনই প্রধানতঃ ভারতীয় কৃষিজোতের মূল বৈশিষ্ট্য। এই খণ্ডীভবনের চরিত্রটি অনুধাবন করা ভারতীয় কৃষির পর্যালোচনায় সবিশেষ গুরুত্ব সহকারে উপস্থিত হয়েছে। আগের আলোচনায় আমরা দেখেছি প্রান্তিক-ক্ষুদ্র-মাঝারি জোতের কৃষকরা যে সঙ্কট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে চাষ করে তাতে যতই পুঁজি তারা কৃষিতে বিনিয়োগ করুক না কেন তারা উদ্বৃত্ত অর্জন করতে পারে না। ফলে জমির পুঁজিবাদী কেন্দ্রীভবন এখানে অনুপস্থিত। আবার বিপরীত পক্ষে এই খণ্ডীভবন সামন্ততান্ত্রিক জমিদারতন্ত্রের বিলোপেরও সূচনা করে। এটা স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় ২০০২-০৩ সালে বৃহৎ জমির মালিকদের (সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী উভয়ে মিলিতভাবে) দখলে আছে মোট জমির মাত্র ১৩.১ শতাংশ। ১৯৫৩-৫৪ সালে প্রান্তিক চাষির সংখ্যা ছিল মোট চাষির ৩৮ শতাংশ। ২০০২-০৩-এ এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশ। ১৯৫৩-৫৪ সালে প্রান্তিক ও ছোটচাষির মোট জমির মধ্যে মালিকানা ছিল ১৬.৩ শতাংশ। ২০০২-০৩ সালে এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩.৫ শতাংশ। ভারতের ২৭টি রাজ্যের মধ্যে ১২টিতে প্রান্তিক ও ছোট চাষির জমির পরিমাণ মোট জমির ৯০ শতাংশ। ১৭টি রাজ্যে তারা ৫০ শতাংশ জমির মালিক। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এটা স্পষ্টই বলা যায় যে এই বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মধ্য কৃষকদের সামনে মূল শোষক হিসেবে হাজির হয়েছে সার-বীজ-কীটনাশক সহ কৃষিপ্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণকারী ও মালিক দেশি-বিদেশি বহুজাতিক গোষ্ঠীগুলি। এর সঙ্গে সহযোগী শক্তি হিসেবে রয়েছে আঞ্চলিক ব্যবসাদার, ঋণদাতা বিভিন্ন সংস্থা, এই নতুন কৃষিনীতির সমর্থক ও মদতদাতা বড় জমির মালিক, আঞ্চলিক পুঁজিপতি শ্রেণী ইত্যাদি। এই বিশেষ পরিস্থিতিটি সৃষ্টি হয়েছে গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক থেকে, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন যখন ভারতের কৃষি-ব্যবস্থাকে প্রধানত তার নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছে, ভূমি সংস্কারের প্রশ্নটি যখন ভারতীয় কৃষির সামনে তার কেন্দ্রীয় সমস্যা নয়, যখন সামন্ততান্ত্রিক শোষণ নানাভাবে টিকে থাকলেও তা সহযোগী দ্বন্দ্ব হিসেবে কৃষকের সঙ্গে নানা ধরনের সংঘাত তৈরি করেছে। এই সময় থেকেই আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদীদের উপর নির্ভরশীল ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণীর সাথে কৃষি মজুর, প্রান্তিক ও ছোট চাষির দ্বন্দ্ব মূল সমস্যা হিসাবে ভারতের কৃষিব্যবস্থায় উপস্থিত হয়েছে। মধ্য কৃষকের সঙ্গেও ঐ শক্তিজোটের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, যদিও তা অন্যদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের মত অত তীব্র নয়।

জোতের মাত্রা ও পরিমাণের উপর এই দ্বন্দ্বের মাত্রা অনেকটা নির্ভর করছে। অর্জুন সেনগুপ্তর রিপোর্ট অনুসারে ২০০৩ সালের কৃষির অবস্থা থেকে দেখা যায় ০.০১ হেক্টরের কম জমির মালিক থেকে শুরু করে ২ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিকদের মাসিক আয় থেকে মাসিক ব্যয় অনেক বেশি। ২ হেক্টর থেকে ৪ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিকদের মাসিক আয় থেকে মাসিক ব্যয় সামান্য বেশি, ৪ থেকে ১০ হেক্টর এবং তার থেকে বেশি জমির মালিকরা কৃষি থেকে সঞ্চয় করতে পারে। এই হিসাব থেকে পরিষ্কার হচ্ছে যে ২ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিকেরা তীব্র সঙ্কটের শিকার। ৪ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিকেরা ক্রমশই সঙ্কটের মুখোমুখি হচ্ছে এবং বর্তমানের বিপজ্জনক কৃষি-প্রযুক্তি তাদের অস্তিত্বকে দ্রুত বিপন্ন করে তুলছে। তাই কৃষকদের এই সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বর্তমান কৃষি-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সামিল হতে পারে। আবার ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে 'সবুজ বিপ্লব'-এর অঞ্চলগুলিতে উত্পাদনশীলতা ও মোট উত্পাদনের পরিমাণ কার্যত স্থগিত হয়ে গেছে। ২০০৪ সালে পাঞ্জাবে মোট ফলন এবং কৃষির উত্পাদনশীলতা দুই-ই ২০০১, ২০০২, ২০০৩ সালের থেকে কমে গিয়েছিল। এখানকার সঙ্কটের চেহারা অন্যান্য কৃষি-অঞ্চল থেকে ভিন্ন। এখানে প্রান্তিক ও ছোট চাষির সংখ্যা ভীষণভাবে কমে গেছে। ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি এবং ধনী চাষিরা প্রধানতঃ বৃহৎ একচেটিয়া বহুজাতিক গোষ্ঠীগুলির পুঁজি ও প্রযুক্তির আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে। এখানে কৃষি মজুরদের প্রলেতারিয়েত চরিত্র অনেক স্পষ্ট।

ভারতে আমূল ভূমি সংস্কার কখনই হয় নি। তাই দেশি বিদেশি বৃহৎ পুঁজি ভারতের কৃষি-ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রধান নিয়ন্তাশক্তি হলেও সামন্ততন্ত্র গ্রামীণ ভারতে, বিশেষত পশ্চাদপদ এলাকাগুলিতে নানাভাবে টিকে রয়েছে। এই অঞ্চলগুলিতে কৃষি অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হিসেবে এখনও দেখা যায় বাঁধা মজুর, সুদখোর মহাজন, উত্পাদিত কৃষি-পণ্যের আঞ্চলিক ভোগ, উদ্বৃত্ত বা মুনাফা উত্পাদনে বা ব্যবসায়ে পুনর্বিনিয়োগ না হওয়া। এই ধরনের অঞ্চলগুলিতে সামন্ততন্ত্রের অচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে জাতপাত ব্যবস্থাও অর্থনৈতিক ভিত্তির অঙ্গ হিসেবে টিকে আছে। আজকের ভারতে বেশিরভাগ জায়গাতেই জাতপাতের প্রভাব উপরিকাঠামোর উপাদান হিসেবে রয়ে গেছে। সে সব জায়গায় সামাজিক স্তরে শোষণ-জুলুম নিপীড়িত জাতের লোকেদের উপর সমানে চলছে। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যটিকে অর্থনীতিতে জাত-ব্যবস্থার সূচক হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। অনেক জায়গায় আবার সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী উপাদান একই সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। যেমন কৃষি উত্পাদন ব্যবস্থার পুঁজিবাদী বাজার ও পুঁজিবাদী উত্পাদন পদ্ধতির সঙ্গে বহু সামন্ততান্ত্রিক রীতি পদ্ধতিও যুক্ত হয়ে থাকে। তবে কোন একটি অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থার মূল চরিত্র নির্ধারণ করতে গেলে শ্রমশক্তি ক্রয়-বিক্রয়ের চরিত্র, কৃষিপণ্য ও উত্পাদনের উপকরণের ক্রয় বিক্রয় ও ব্যবহারের চরিত্র এবং কৃষির উদ্বৃত্তের ব্যবহার এবং তার সাথে পুঁজিবাদী বাজারের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়গুলি বিবেচনা করতে হয়। এই প্রসঙ্গে যেটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হলো কৃষি ক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত যদি কৃষিতে পুনর্বিনিয়োগ না হয়ে অন্য কোন ব্যবসায়ে বা শিল্পে বিনিয়োগ হয়, তবে তাকেও পুঁজিবাদী উত্পাদনের সূচক হিসেবে দেখতে হবে। বর্তমান ভারতের কৃষি-ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিশেষ মনোযোগী দাবী করে। কারণ এই বৈশিষ্ট্যটি ভারতের বৃহৎ জোতের মালিকদের ক্ষেত্রে খুব বেশি পরিমাণে দেখা যায়। কৃষিতে বিনিয়োগ যথেষ্ট লাভজনক না হওয়ায় এদের মধ্যে কৃষির উপকরণের ব্যবসা, কোল্ড স্টোর, রাইস মিল বা কৃষির সঙ্গে যুক্ত নয় এমন নানা ধরনের ব্যবসায়ে বা শিল্পে বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে। এদের মধ্যে অনেকেই পুরনো আমলের জোতদারদের বংশধর, কৃষকদের শোষণ করা টাকা এখন ব্যবসায়ে ঢালছে। বর্তমানে পুঁজিবাদী ব্যবসায়ই এদের আয়ের প্রধান উত্স বলে এখন আর এদের সামন্ততান্ত্রিক জোতদার বলা যাবে না।

২০০৪-০৫ সালের NSSO-র ৬১তম রাউন্ডের এবং ঐ একই সময়ে সরকার দ্বারা নিযুক্ত অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশনের রিপোর্টের নির্যাস উপস্থাপিত করে আজকের ভারতের মেহনতি মানুষের (শ্রমিক ও কৃষক) কর্মে নিযুক্তির একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবো। অত্যন্ত নির্মোহভাবে এ চিত্র বিচার করেই কেবল ভারতের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে একটি বস্তুনিষ্ঠ সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব।

২০০৪-০৫ সালে, ভারতের জনসংখ্যা ছিল ১১১ কোটি। এর মধ্যে কাজে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা (সমস্ত ধরনের কাজ) ছিল ৪৫.৫৭ কোটি। তার মধ্যে শিল্প ও পরিষেবায় নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা ১৯ কোটি। এর মধ্যে পুঁজিপতিদের সেবায় নিযুক্ত ম্যানেজমেন্টের লোক যদি সর্বাধিক ১ কোটিও ধরা হয়, তবুও দেখা যাচ্ছে এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রটিতে ১৮ কোটি মানুষ সর্বহারা-আধা সর্বহারা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাবে NSSO-র দেওয়া। পাঠকদের বিচারের জন্য আমরা ওই একই সময়ে অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশনের দেওয়া তথ্যও জুড়ে দিচ্ছি: কাজে সক্ষম এমন মানুষের সংখ্যা ৪২.৯৮ কোটি। কাজে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা ৪০.১২ কোটি। বেকার ২.৮৭ কোটি। শিল্পে নিযুক্ত ৭.৮ কোটি, তার মধ্যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত (formal) শ্রমিকের সংখ্যা ২.৩২ কোটি, অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিকের সংখ্যা (informal) ৫.৪৮ কোটি। পরিষেবায় মোট নিযুক্তি ১১ কোটি, তার মধ্যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৩.০৪ কোটি। অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৭.৯৬ কোটি। কমিশনের ব্যাখ্যায় উপরোক্ত হিসাবে অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত ও অসংগঠিত (unorganised) একসঙ্গে ধরা হয়েছে।

NSSO এর পর ২০০৪-০৫ সালে ভারতে কর্মে নিযুক্তির আর একটু বিস্তারিত হিসেব দিচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে ৪৫.৫৭ কোটি কর্মে নিযুক্ত মানুষের মধ্যে অসংগঠিত /অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রের মোট নিযুক্তি ৩৯.৩২ কোটি। তার মধ্যে কৃষিতে নিযুক্ত ২৫.১৭ কোটি এবং অকৃষি ক্ষেত্রে নিযুক্তি ১৪.১৫ কোটি। সমগ্র অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রের মধ্যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কর্মী হলেন মাত্র ১৪ লাখ (শতকরা ০৪ জন) যারা নিয়মিত বেতন এবং পি এফ ইত্যাদি সামাজিক সুরক্ষা পান। আর অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রের অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত কর্মী হলেন ৩৯ কোটি ১৮ লক্ষ যা হচ্ছে শতকরা ৯৯.৬ জন। এই বিশাল অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রের মধ্যে ধরা আছে ৮.৭ কোটি কৃষি-মজুর সহ মেহনতি কৃষক জনতার সমগ্র অংশ। NSSO-র দেওয়া তথ্য অনুসারে আনুষ্ঠানিক/সংগঠিত ক্ষেত্রের মোট নিযুক্তি ৬.২৬ কোটি। এর মধ্যে অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত কর্মী হলেন (যেমন বড় কারখানার ঠিকা শ্রমিক) ২.৮৯ কোটি (৪৬.২%) এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিক হচ্ছেন ৩.৩৭ কোটি (৫৩.৮%)।

NSSO এবং অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশনের রিপোর্টে কৃষিতে নিয়োগের পরিস্থিতি কী তা একবার দেখা যাক। জমির মাপ অনুসারে কৃষকদের পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়। ১ হেক্টর পর্যন্ত জমি আছে এমন কৃষকদের প্রান্তিক চাষি (marginal) বলা হয়। ১.১ হেক্টর থেকে ২ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিককে বলা হয় ছোট চাষি। ২.১ থেকে ৪ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিকরা হলো আধা-মাঝারি চাষি (semi-medium)। ৪.১ থেকে ১০ হেক্টর জমির মালিক মাঝারি চাষি (medium) আর ১০ হেক্টরের উপরে যাদের জমি আছে তাদের বলা হয় বড় (large) চাষী। NSSO-র হিসাব মত কর্মে নিযুক্ত মোট মানুষের মধ্যে ৫৬.৫৬% নিযুক্ত রয়েছে কৃষিতে। কৃষিতে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা স্থির গতিতে কমছে কয়েক দশক ধরে। ১৯৭২-৭৩-এ ছিল ৭৩.৯%, ১৯৯৩-৯৪ তে ছিল ৬৩.৯%, ২০০৪-০৫ হয়েছে ৫৬.৫%। লক্ষণীয় ১৯৭৩-৭৪ তে ছিল ৬৩.৯%, ২০০৪-০৫ হয়েছে ৫৬.৫%। লক্ষণীয় ১৯৭৩-৭৪-এ জি ডি পি-র ৪৪.১% ছিল কৃষি-জাত উত্পাদন যা ২০০৪-০৫-এ কমে হয়েছে ২০.৫%। নারীদের ক্ষেত্রে ১৯৭৭-৭৮-এ প্রতি ১০০০ গ্রামীণ নারীর মধ্যে কৃষিতে যুক্ত ছিল ৮৬৮ জন, ১৯৯৩-৯৪ তে ৮৪৭ জন, ২০০৪-০৫-এ ৮১৪ জন। শহরের নারীদের ক্ষেত্রে সংখ্যার এই হ্রাস আরও তীব্র: ১৯৭৭-৭৮-এ ২৫১ জন, ১৯৯৩-৯৪-এ ১৯৩ জন এবং ২০০৪-০৫-এ ১৪৭ জন। গ্রামীণ পুরুষদের কৃষিতে নিযুক্তি ছিল ১৯৭৭-৭৮-এ ৮০৪ জন, ১৯৯৩-৯৪ তে ৭৩৭ জন ও ২০০৪-০৫-এ ছিল ৬৬২ জন। শহুরে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হ্রাস প্রাপ্তি নিম্নরূপ। ১৯৭৭-৭৮-এ ১০২ জন, ১৯৯৩-৯৪ তে ৮৭ জন, ২০০৪-০৫-এ ৬০ জন। ১৯৯৩-৯৪ থেকে ২০০৪-০৫-এর সময় পর্বে গ্রামীণ পুরুষের কৃষিতে অংশগ্রহণ ৭৩.৭% থেকে ৬৬.২% এ নেমে এসেছে। অর্থাৎ বছরে গড়ে .৬৮% কমেছে। শহরে এই হ্রাস ২.৪৫%। নারীদের ক্ষেত্রে এই হ্রাস তুলনায় কম হলেও সব ক্ষেত্রেই ১৯৭৭-৭৮ থেকে ২০০৪-০৫-এর পর্বে কৃষি কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাবার গতি অনেক বেশি। NSSO-এর আর একটি হিসাবে দেখাচ্ছে অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিকদের মোট সংখ্যার মধ্যে অকৃষি-ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংখ্যা ১৯৯৯-২০০০-এ ছিল ৩২%, যা ২০০৪-০৫-এ বেড়ে হয়েছে ৩৬%, অর্থাৎ ৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিকদের মধ্যে কৃষিতে নিযুক্তি ঐ ৪%-ই কমেছে। দেখা যাচ্ছে কয়েক দশক ধরেই কৃষি ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার নিযুক্তিই স্থির গতিতে কমেছে। তার অর্থ এই নয় যে কৃষিক্ষেত্রে কাজ হারানো মানুষেরা শহরের সংগঠিত ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিল্পক্ষেত্রে কাজ পেয়ে যাচ্ছে। এই মানুষেরা শহর ও গ্রামের এক বিপুল অসংগঠিত ও অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রে যোগদান করছে যারা সৃষ্টি করছে সর্বহারা ও আধা-সর্বহারাদের বিশাল এক বাহিনী। এদের মধ্যে আছে ভ্যান রিক্সা বা অটো চালক, চায়ের দোকান, রেস্টুরেন্টের কর্মচারী, হকার, বাড়ির পরিচারক পরিচারিকা, ছোট ছোট ম্যানফ্যাকচারিং ইউনিটের শ্রমিক। ভারতের শ্রমিকশ্রেণীকে তার সংখ্যা ও শক্তির বিচারে ঠিক মতো বুঝতে এই বিশেষ ক্ষেত্রটি আমাদের মনোযোগ দাবি করে।

এবার আলাদা করে শুধু কৃষকদের হিসাবে আসা যাক। বৃহৎ চাষিদের (১০ হেক্টর-এর বেশি) সংখ্যা মোট চাষীদের ০.৯%। এরা মোট কৃষি জমির ১৩.১% জমিতে চাষ পরিচালনা করে। মাঝারি চাষিরা (৪.১ থেকে ১০ হেক্টর) মোট চাষিদের ৬%। এই দুটি অংশ মিলিতভাবে মোট জমির ১/৩ অংশ চাষ করে। লক্ষণীয় বৃহৎ চাষিরা তো বটেই এমনকি বৃহৎ ও মাঝারি চাষি মিলিত হয়েও মোট কৃষিযোগ্য জমির মধ্যে খুব অল্প জমিতেই ভৌমিক অধিকার ভোগ করছে। কিন্তু এই দুটি গোষ্ঠীই কৃষি থেকে সঞ্চয় করে। ২ থেকে ৪ হেক্টর জমির মালিক মধ্যমাঝারি কৃষকেরা সরকারি তথ্য অনুযায়ী কৃষি থেকে পাওয়া উপার্জন থেকে কিছুই সঞ্চয় করতে পারে না। বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায় এরাও গভীর সঙ্কটে জড়িয়ে পড়ছে, এর নীচে যে বিপুল সংখ্যক ছোট ও প্রান্তিক চাষিরা রয়েছে তাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আধা মাঝারি কৃষকের সংখ্যা ২.৩০ কোটি এবং তারা মোট কৃষকদের ১৩ শতাংশ। এর পরে আছে ১ থেকে ২ হেক্টর জমির মালিক ছোট কৃষক যাদের সংখ্যা ১.৬৫ কোটি এবং মোট কৃষকদের মধ্যে ১০ শতাংশ। প্রান্তিক কৃষককূল, যাদের জমির পরিমাণ ১ হেক্টরের কম, তারা মোট কৃষকের ৭০ শতাংশ। প্রান্তিক ও ছোট চাষীরা মিলিতভাবে মোট চাষীর ৮০ শতাংশ এবং এরা মোট চাষ হওয়া জোতের সংখ্যার ৮০ শতাংশ চাষ করে। লক্ষণীয় ১৯৬০-৬১ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৬১%। দেশে গ্রামীণ কর্মনিযুক্তির যে সামগ্রিক চিত্রটি পাওয়া যাচ্ছে তাতে খেয়াল করার মতো বিষয় হচ্ছে মোট কৃষকের মধ্যে প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা অত্যধিক গতিতে বেড়ে চলেছে। প্রান্তিক চাষির মধ্যে ক্ষেতমজুরদেরও ধরা আছে। সরকারি নথিতে প্রান্তিক চাষি, ছোট চাষি এবং ক্ষেতমজুরদের মিলিয়ে কৃষি-কর্মী (agricultural worker) বলে একটি বর্গ করা হয়েছে। ২০০১ এর জনগণনায় ১৯৭১ থেকে ২০০১ এর মধ্যে কৃষি কর্মীদের মধ্যে ক্ষেতমজুরদের অংশ ৩৭.৮% থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৫.৬%। ঐ পর্যায়ে (১৯৭১-২০০১) ক্ষেতমজুরদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৭৫ লক্ষ থেকে ১০ কোটি ৬৮ লক্ষ, বৃদ্ধির হার বছরে ২.৭৪%। একই সময়ে কৃষিকর্মীর বৃদ্ধির হার বছরে ২.০৭%। জনগণনা অনুযায়ী ২০০১-এই যদি ক্ষেতমজুরের সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি হয়ে থাকে তবে পরবর্তী দশ বছরে অর্থাৎ আজকের দিনে তার সংখ্যা কী ভীষণ বেড়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। (২০০৪-০৫-এর NSSO-র হিসাবে ক্ষেত মজুরের সংখ্যা ছিল ৮.৭ কোটি)। সরকারি হিসেবেই বলা হচ্ছে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে কৃষককে অন্তত ৪.০১ হেক্টর জমির মালিক হতে হবে। NSSO-র হিসাব মতো এই মাঝারি (৫.১%) ও বৃহৎ (০.৯) মিলিতভাবে মোট চাষীদের ৬%। এর অর্থ ৯৪% কৃষক বিভিন্ন মাত্রার প্রবল দারিদ্র্যে বাস করছে এবং দুবেলা পেট ভরে খেতে পাচ্ছে না। ২ থেকে ৪ হেক্টর জমির মালিক মধ্য মাঝারি কৃষকদের অংশটুকু বাদ দিয়ে যে অংশটি থাকে তার মধ্যে ভূমিহীন ক্ষেতমজুর যদি গ্রামীণ সর্বহারা হয় তবে কৃষকদের বাকী অংশটি অর্থাৎ ১ হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিক প্রান্তিক চাষি ও ১ থেকে ২ হেক্টর জমির মালিক ছোট চাষিরা আধা-সর্বহারা বলে বিবেচিত হবে। এরা মোট কৃষক-কূলের ৮০ শতাংশ। শিল্প-পরিষেবায় নিযুক্ত ১৮ কোটি মানুষকে ধরে কর্মে নিযুক্ত মানুষের মধ্যে অ-কৃষি সর্বহারা, আধা সর্বহারা ও কৃষি সর্বহারা এবং আধা সর্বহারা অবস্থানে পড়ে থাকা মানুষের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৩৮ কোটির কাছাকাছি। এর সঙ্গে যদি আমরা সর্বহারার দৃঢ় মিত্র ছোট কৃষকের সংখ্যা ১.৬৫ কোটি ও দোদুল্যমান মিত্র আধা-মাঝারি কৃষকের সংখ্যা ২.৩০ কোটি যোগ করি তবে দেখা যাবে কর্মে নিযুক্ত ৪৫.৫৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৪১.৯৫ কোটি মানুষ বর্তমান সমাজব্যবস্থা দ্বারা শোষিত ও নির্যাতিত। এ প্রসঙ্গে আমাদের আর একবার খেয়াল করতে হবে যে পূর্বে উল্লেখিত পরিসংখ্যানগুলি ইতিমধ্যেই বেশ পুরনো হয়ে গেছে— ২০০৪-০৫ অথবা ২০০১ সালের। বিগত বছরগুলিতে পরিস্থিতি আরও সঙ্গিন হয়েছে, কারণ বিগত দশকগুলির পরিসংখ্যান দেখিয়েছে ভূমিহীন কৃষক প্রান্তিক ও ছোট কৃষক এবং অ-স্বীকৃতি প্রাপ্ত ক্ষেত্রের এক বিপুল সংখ্যক অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

 

ভারতীয় কৃষি-ব্যবস্থার বর্তমান চরিত্র

আমরা এই প্রবন্ধের শুরুতেই দেখাতে চেষ্টা করেছি ভারতে পুঁজির বিকাশ একেবারে উপনিবেশিক আমল থেকেই অন্যান্য উপনিবেশগুলির সাধারণ ছকের থেকে কিছুটা ভিন্ন ধারায় ঘটতে শুরু করেছিল। যার বহিঃপ্রকাশ ছিল অন্যান্য উপনিবেশগুলি থেকে এখানে পুঁজি বিকাশের মাত্রার আধিক্য। আমরা এটা দেখেছি যে এই আপেক্ষিক বিকাশ সমগ্র ব্রিটিশ শাসনের যুগে বেড়েই চলেছে যা দুটি সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের কালে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে এবং তার সুযোগ নিয়ে এই বৃদ্ধিতে উল্লম্ফন ঘটিয়েছে। ভারতীয় পুঁজির এই বাড়বাড়ন্ত গোটা ইংরাজ রাজত্বের কাল জুড়ে তার রাজনৈতিক ইতিহাসেও নানা তাত্পর্য নিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। এমন অনেক পর্যায় এসেছে যখন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ঠিক যে মাত্রায় ভারতীয় পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা তাদের ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব কায়েম রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল তা পারে নি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা কারণে পরিস্থিতি অনেক সময়ই তাদের হাতের বাইরে চলে গেছে। তাদের পক্ষে এরকমই একটি কঠিন সময়ে ইংরাজ শাসকেরা বাধ্য হয়েছিল বৃহৎ পুঁজিপতিদের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করতে। ১৯৪৭-এর পরেও ভারতীয় পুঁজির এই বিকাশের প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। একেবারে প্রথম বছরগুলিতে উদীয়মান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মার্কিনীদের সঙ্গে ক্ষয়িষ্ণু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব এবং তার ঠিক পরের বছরগুলিতে মার্কিনীদের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরিস্থিতি ভারতের বৃহৎ পুঁজিকে একটা আপেক্ষিক স্বাধীনতা ভোগ করার বাস্তব অবস্থা তৈরি করে দিয়েছিল। গত শতাব্দীর ৮০-র দশক থেকে শুরু হয় নতুন কাহিনী। ভারতের শাসক শ্রেণী দেশের অর্থনীতিতে উদারীকরণ নীতির সূত্রপাত ঘটায়। পরিকল্পনাটি মার্কিন পরিচালিত আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের। ঐ সময়কালে আন্তর্জাতিকভাবেই পুঁজিবাদ এক গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত হয়েছিল। ফলে নতুন বাজার দখল করার তাড়নায় উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বাজার খোঁজার ও নতুন নতুন ক্ষেত্রে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠলো। এই দেশগুলিতে বাধাহীন অনুপ্রবেশের জন্যই তৈরী হলো ''বিশ্বায়ন'' যাকে গোটা বিশ্বে জনপ্রিয় করায় ''বিশ্বায়নের'' পক্ষে এক উন্মাদনা সৃষ্টি করা হলো। ১৯৯১-এ ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বায়নের অংশীদার হয়ে ঘোষণা করলো 'নয়া আর্থিক নীতি'। এতে শুধু সাম্রাজ্যবাদই লাভবান হলো না। আমাদের দেশের বৃহৎ পুঁজি যা ইতিমধ্যেই মোটামুটি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল তারা বিদেশী পুঁজির সঙ্গে মৈত্রী করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বেড়ে উঠতে লাগল। দেশের ছোট-মাঝারি পুঁজিকে গিলে ফেলে একদিকে তারা দেশের বাজারে আধিপত্য করতে থাকলো, অন্যদিকে বিশ্বের বাজারেও তারা সক্ষম ও সম্ভাবনাময় প্রতিযোগী হিসেবে সফলভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করলো। তাদের বিকাশ ও বৃদ্ধির জোরেই ভারতে বৃদ্ধির হার অনেক সময় প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী দেশগুলির সঙ্গে তুলনীয়। এগুলি তথ্য, তাই এ সত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতেই হবে।

এ যদি সত্যের একটি দিক হয়, তবে অন্য দিকটিতেও আমাদের হিসাবে রাখতে হবে। তা আমরা রেখেছি এবং দেখিয়েছি কীভাবে একে ''বিকৃত পুঁজিবাদ'' হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। আমরা বলেছি ভারতীয় পুঁজির এই বিকাশ কোন সনাতনী ধরনের নয়। এ বিকাশ ভারতীয় সমাজের ও অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রয়োজন অনুসারে ঘটেনি, ঘটেছে সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া পুঁজির হাত ধরে। ভারতীয় বৃহৎ পুঁজির ইতিহাসটাই এই রকম। স্বাধীনতার আগে সে বেড়ে উঠেছে ব্রিটিশ পুঁজির ছায়ায়, পরবর্তী সময়ে সে বেড়ে উঠেছে বিদেশী পুঁজির হাত ধরে। বিশ্বায়ন পর্বে এ মৈত্রীবন্ধন আরও বেড়েছে। তাই এই বিকৃতি। কিন্তু এখানে যে প্রশ্নটির জবাব আমাদের দিতে হবে তা হলো ''বিকৃত পুঁজিবাদ'' কী মূলগতভাবে পুঁজিবাদ? যদি পুঁজিবাদ না হয় তবে কী? যদি এর মৌলিক চরিত্র পুঁজিবাদী হয় তবে অবশ্যই এর যাত্রা পথে অর্থনীতির সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি ক্ষয় পেতে থাকবে এবং অর্থনৈতিক ভিত্তিতে তা এমন দুর্বল হয়ে পড়বে যে রাষ্ট্রক্ষমতায় তার কোন প্রতিনিধি থাকবে না। সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি কি আমাদের দেশে মূলতঃ ক্ষয় পেয়েছে? আমাদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় কি সামন্ততন্ত্রের প্রতিনিধি নেই? যদি না থাকে তবে কি বৃহৎ পুঁজিপতিরা এককভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন? তবে কি ভারতকে একটি পুঁজিবাদী দেশই বলতে হবে? একটি আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশ কি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া পুঁজিবাদী দেশে পরিণত হতে পারে? যদি কেউ বলেন হয়, তবে কি তিনি আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশ সম্বন্ধে মাও সে তুঙের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করছেন না?

আমরা NSSO ৬১ রাউন্ড (২০০৪-০৫), অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশনের রিপোর্ট (২০০৪-০৫) এবং ২০০১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট থেকে ঐ সময় আমাদের দেশে শ্রমিক-কৃষকের কর্মনিযুক্তির পরিমাণগত ও গুণগত একটি সামগ্রিক চিত্র এবং তার সঙ্গে গ্রামীণ কৃষিজোতের বিন্যাস এবং তার সঙ্গে কৃষকদের সম্পর্কের একটি হিসাব পাই। আমাদের প্রশ্নগুলির অনেকটা উত্তরই সেখান থেকে পাওয়া যাবে। কিছু আবার নতুন করে আলোচনাও করতে হবে। ভারতের কৃষিতে পুঁজিবাদ বা সামন্ততন্ত্র কোনটি প্রাধান্যকারী অবস্থায় রয়েছে তার একটি বিচার দিয়ে আমরা প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করবো। প্রথমেই উত্পাদন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা যাক, কারণ অনেকেরই মতে একটি সমাজ ধনতান্ত্রিক না সামন্ততান্ত্রিক তার নির্ধারক মানদণ্ড হচ্ছে উত্পাদন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত শ্রম মূলতঃ অবাধ না সবাধ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমও যেহেতু পণ্য হয়ে ওঠে তাই অন্যান্য পণ্যের মতোই শ্রমও একটি পণ্য হিসাবে নির্দিষ্ট মূল্যে শ্রমের বাজারে ক্রয়-বিক্রয় হয়। সেখানে েক্রতা বিক্রেতাদের মধ্যে অবাধে শ্রম কেনাবেচা হয়। উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করার জন্য অর্থনীতি বহির্ভূত ক্ষমতা প্রয়োগের কোন অবকাশ থাকে না। বিপরীত পক্ষে সামন্ততান্ত্রিক সম্পত্তির মালিকেরা তাদের সামাজিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ব্যবহার করে, অর্থাৎ অর্থনীতি বহির্ভূত বলপ্রয়োগ করে উদ্বৃত্ত আহরণ করে। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশে বর্তমানে কোন ব্যবস্থাটি প্রাধান্যকারী অবস্থায় আছে? প্রথম কথা হলো শ্রম সবাধ না অবাধ-এ প্রশ্নটি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ওঠেই না কারণ শ্রমিক মানেই সে প্রধানতঃ পুঁজিবাদী উত্পাদন সম্পর্কের সাথে যুক্ত। তাই কোন একটি সমাজে কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা যত কমবে তত সেখানে অবাধ শ্রমের প্রচলন বাড়বে। আমরা ২০০৪-০৫ সালের পরিসংখ্যানেই দেখেছি কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা ৫৬.৫৬%। তার মধ্যে ক্ষেত মজুর অর্থাৎ গ্রামীণ সর্বহারার সংখ্যা ৮.৭ কোটি। প্রান্তিক ও ছোট চাষি যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্যের জমিতে মজুরি খাটতে বাধ্য হয় তারা সংখ্যার দিক থেকে সারা দেশের মোট চাষির ৮০%। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই বিপুল সংখ্যক সর্বহারা-আধা-সর্বহারার উপস্থিতি সবাধ শ্রমের বৈষয়িক ভিত্তিটিকে বহুলাংশে নষ্ট করে দেয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ক্ষেত মজুর বা প্রান্তিক চাষি হলেই তার দেওয়া শ্রম অবাধ হবে। তারা যদি কোনও জমির সঙ্গে বা নির্দিষ্ট কোন মালিকের সঙ্গে বাধা পড়ে থাকে তবে তার শ্রম নিশ্চয়ই অবাধ হবে না। তা হতে গেলে তাকে মচলেখাবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু আমরা সকলেই জানি আজকের ভারতে এই প্রথা একেবারেই বিরলদৃষ্ট। কৃষি-কাজ-ছেড়ে অন্য কাজে যাওয়ার ইচ্ছা বা উপায় না থাকাটা নিশ্চয় সবাধ শ্রমের লক্ষণ নয়, কারণ শ্রমিক বা চাকরীজীবীদের ক্ষেত্রেও এই অভিজ্ঞতা দেখা যায়। মাহিন্দার হিসেবে বাত্সরিক চুক্তি বা পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বিশেষ কাজের জন্য বাইরে যাওয়াটাও স্রেফ চুক্তিবদ্ধতার কারণে সবাধ শ্রমের সূচক নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও বিশেষত আজকের এই বিশ্বায়ন পর্বে শ্রমিকদের চুক্তিতে কাজ ভীষণরকম বেড়ে গেছে। চুক্তিতে কাজের ক্ষেত্রে শ্রম কতটা সবাধ বা অবাধ তা মালিকের সঙ্গে সম্পর্কের অন্য কিছু বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত হতে পারে। কিন্তু চুক্তিবদ্ধতা বা চুক্তির মেয়াদের উপর নির্ভর করে না। আমরা পরিসংখ্যানে দেখিয়েছি গ্রামের নিয়োগ স্থিরগতিতে কমেই চলেছে এবং যে বেকার বাহিনীর উদ্ভব হচ্ছে তারা গ্রামের বাইরে বিশেষত বড় বা ছোট শহরে অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রের অস্বীকৃতিপ্রাপ্ত শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। এই সর্বহারাকরণই এখনকার প্রধান প্রবণতা, সাথে সাথে অবাধ শ্রমেরও তাই।

পুঁজিবাদী উত্পাদন ব্যবস্থার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ উত্পাদিত পণ্য বাজারে যায় কিনা, বাজারে বিনিময়ের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত হাসিল হয় কিনা এবং এই প্রক্রিয়ায় উত্পাদনকারী মুনাফা অর্জন করে কিনা। উল্টো দিকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাজারের প্রচলন অত্যন্ত সীমিত থাকে, ভূসম্পত্তির মালিকেরা বাজারের মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করে, কৃষকেরা বাজারের বাইরে তাদের উত্পাদিত সামগ্রীর একটা অংশ বিনিময় করে তাদের সাংসারিক প্রয়োজন মেটায়, আর একটা অংশ, বিশেষত খাদ্যশস্য নিজেরাই ভোগ করে। আবার উত্পাদিত শস্যের একটা বড় অংশ তাকে রাখতে হয় পরের বছরে চাষের জন্য বীজ হিসেবে, ক্ষেত মজুরদের মজুরি হিসেবে, মালিককে দেয় ভাগ হিসেবে (payment in kind)। এক কথায় বাজারের প্রচলন এতই কম থাকে যে বাজারে বিনিময়ের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত হাসিলের ঘটনা সমাজে গৌণ স্থানে থাকে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট দেশে একটি নির্দিষ্টকালে বাজারের ভূমিকা কতটা তা নিয়ে বহুলাংশে নির্ণয় করা যায় সমাজবিকাশের স্তর।

আজকের সময়ে ভারতে বাজারের ভূমিকা কতটা তা একবার বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে বাজারে পাঠানোর মত উদ্বৃত্ত (marketed surplus) আজও তুলনামূলকভাবে বেশ কম। ২০০৪ সালে ভারত সরকারের একটি বাজারের জন্য উদ্বৃত্তের অনুপাত নির্ণয়ের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে দেখা যাচ্ছে ২০০২-০৩ সালে ধান ৪৩%, গম ৫১.৫%, ডাল ৭২.৪%, তৈলবীজ ৭৯.৬% উদ্বৃত্ত হিসেবে বাজার-জাত হয়েছিল। বাণিজ্যিক ফসলের ক্ষেত্রে এ অনুপাত অত্যন্ত বেশি, যেমন আখ এবং তুলার ক্ষেত্রে ৯৩%। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে HYV বীজ-কেন্দ্রিক যে নতুন কারিগরি ভারতের কৃষিতে আমদানি করা হলো তারপর থেকে কৃষিপণ্যের বাজার-জাত হবার প্রবণতা হঠাৎ করেই বাড়তে শুরু করেছিল, যার একটা উল্লম্ফন ঘটলো ''বিশ্বায়ন'' পরবর্তী ভারতীয় কৃষিব্যবস্থায়। বিশ্বায়িত পুঁজির মুনাফার এক মৃগয়া-ক্ষেত্র হিসেবে যে পরিমাণে ভারতীয় কৃষিকে নিশানা করা হলো, সে পরিমাণেই ভারতীয় কৃষির বাজার সম্প্রসারিত হলো হু হু করে। বীজ-সার-কীটনাশক-পাম্পসেট-ট্র্যাক্টর ইত্যাদি পুঁজিবাদী বিনিয়োগের বাজার উদ্দাম গতিতে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্পাদিত কৃষি-সামগ্রী বিক্রির বাজারও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে। বিশ্বায়নের ফলে যে পরিমাণে খাদ্যশস্যর উত্পাদন হ্রাস করে বাণিজ্যিক পণ্যের চাষ বেড়েছে, রপ্তানি যোগ্য কৃষিপণ্যের চাষ বেড়েছে, চুক্তি চাষ ও আগাম বাণিজ্যের প্রচলন বেড়েছে, সেই পরিমাণে কৃষিপণ্য বাজারে চলে যাচ্ছে। বড় জোতে নতুন কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের দরুন যে পরিমাণে উত্পাদন বাড়ছে সে পরিমাণে বর্ধিত উদ্বৃত্ত বাজারে চলে যাচ্ছে। ছোট জোতের চাষীরা নতুন পদ্ধতিতে চাষ করতে গিয়ে য়ে পরিমাণে ঋণগ্রস্ত হচ্ছে সে পরিমাণে তাদের অভাবী বিক্রি (distress sale) বাড়াতে হচ্ছে, যাতে সে নিজের ব্যবহারের জন্য খাদ্যশস্যও বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে, আবার পরবর্তীকালে ঐ খাদ্য শস্যই তাকে অনেক বেশি চড়া দামে কিনে খেতে হচ্ছে। সব দিক মেলালে এটা বুঝতে খুব অসুবিধা হবার কথা নয় যে ১৯৯০-৯১-এর পরের ভারতে কৃষিপণ্যের বাজারে চলে যাওয়াটা প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। ভারত সরকারও এই পর্যায়ে কৃষিপণ্য বাজারজাত করার জন্যে নানা উদ্যোগ দেখিয়েছে। মূলত বাজারের জন্য (marketing) তৈরি করা ''অ-ঋণ সমবায় সমিতির সংখ্যা ১৯৯৯ সালেই হয়েছিল ৩ লক্ষ ৬১ হাজার, তার সদস্য সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৬০ লক্ষ, সেখানে নিয়োজিত ছিল ৬ লক্ষ ১৬ হাজার কর্মচারী। বাজারের উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ''কৃষি প্রক্রিয়াকরণ সমবায় সমিতি।'' যার সংখ্যা ১৯৬২-৬৩ তে ছিল ৩২৬টি, আজ তা হয়েছে ২৫০০০টি। সরকারের এই বিপুল উদ্যোগ ভারতের কৃষিপণ্যের বাজার যে অবিশ্বাস্য গতিতে বিকাশমান তাই সূচিত করছে। আবার একই সঙ্গে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে যেহেতু ভারতের পুঁজির বিকাশ ''বিকৃত'' ভাবে ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে তাই তার ছাপ অবশ্যই এখানকার বাজার-ব্যবস্থার মধ্যেও থাকবে। দু একটা উদাহরণ দিলে ভারতের বাজারের পশ্চাত্পদতা বোঝা যাবে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে কৃষকরা তাদের উত্পাদিত পুরো ফসলটাই বাজারে বিক্রি করে। আমাদের এখানে কৃষকেরা এখনও তাদের নিজেদের খোরাকিসহ আরও কিছু কাজের জন্য ফসলের একটা অংশ বিক্রি করে না। তাছাড়া পারিবারিক প্রয়োজনে নিজেই উত্পাদন করাটা তাদের এমন অন্ধ অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় যে তারা কখনই হিসাব করে দেখে না খাদ্য শস্যের বদলে অন্য কিছু চাষ করলে লাভ বেশি কিনা। ভারতীয় কৃষকের এ অভ্যাস এখনও রয়ে গেছে এবং এটা স্পষ্টতই পুঁজিবাদী বাজার-ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অবাধ শ্রম যে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করে তা বাজারে গিয়ে মুনাফা অর্জন করে এবং সেই মুনাফা আবার উত্পাদনের কাজে নিয়োজিত হয়ে পুঁজিপতিদের পুঁজির অবিরাম বৃদ্ধি ঘটায়। পুঁজিবাদী উত্পাদন ব্যবস্থার এই প্রকরণ অনিবার্যভাবে দুটি ফলাফল সৃষ্টি করে। (১) উদ্বৃত্ত পুঁজি পুনরায় উত্পাদনে নিয়োজিত হওয়া। (২) উদ্বৃত্তের পরিমাণকে তীব্রভাবে বাড়িয়ে তোলার তাগিদে উত্পাদন ব্যবস্থার মানকে, অর্থাৎ উত্পাদন শক্তিকে ক্রমান্বয় উন্নত করে যাওয়া। সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন ব্যবস্থায় এ দুটি বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত থাকে। সামন্ততান্ত্রিক সম্পত্তির মালিক উদ্বৃত্ত উত্পাদনে নিয়োজিত করে না। সে উদ্বৃত্ত ব্যয় করে ভোগের জন্য বা কখনও যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য, বা বড় জোর জনহিতকর বা ধর্মীয় কোন কাজের জন্য। ফলে উত্পাদিকা শক্তি উন্নত হয় অত্যন্ত ধীর গতিতে। যেমন সামন্তবাদী কৃষি উত্পাদন ব্যবস্থায় যুগ যুগ ধরে শুধু লাঙ্গল বলদের ব্যবহার। আমরা একটু আগেই আলোচনা করেছি ভারতে ১৯৬০-এর দশকের ''সবুজ বিপ্লব''-এর সময় থেকে এবং বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকের ''বিশ্বায়ন''-এর কালপর্বে পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার প্রসার ঘটেছে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে। এর অর্থ ব্যাপক হারে পুঁজিবাদী মুনাফার সৃষ্টি। দ্রুত জায়মান এই পুঁজিবাদী মুনাফা যে পুঁজির স্বাভাবিক নিয়মেই উত্পাদিকা শক্তির উন্নতির জন্য পুনর্বিনিয়োগ হয়েছে তা আমরা আমাদের দেশের কৃষিতে বিগত চার দশকে, বিশেষতঃ গত দু দশকে ক্রমবর্ধমান পুঁজি বিনিয়োগের যে পরিসংখ্যান দিয়েছি তাতেই স্বতঃপ্রমাণিত। ভারতের কৃষিতে পুঁজিবাদী উত্পাদন ব্যবস্থা বিকশিত হয় নি এ কথা যারা অত্যন্ত জোরের সাথে বলেন তারা কয়েকটি কারণ উপস্থাপিত করেন যেগুলি অবশ্যই আমাদের বিচার করে দেখা উচিত। তাঁরা এগুলির মধ্যে সব বেশি জোর দেন এখনো আমাদের কৃষিতে বেশ ভাল পরিমাণে ভাগচাষ প্রথা টিকে রয়েছে এ তথ্যটির উপর। কিন্তু ভাগচাষ মানেই তা সামন্ততান্ত্রিক ভূমিবাজনার জনক তা তত্ত্ব ও তথ্য কোনটির দ্বারাই প্রমাণিত হয় না। ভাগচাষ প্রথা সামন্ততান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী যে কোন ব্যবস্থারই অঙ্গ হতে পারে। তার মধ্যে কোনটি হবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে একটি নির্দিষ্ট দেশে একটি নির্দিষ্ট সময়ে তার চরিত্রের উপর। এ কথা ঠিক যে ঐতিহাসিকভাবে আমাদের দেশে যে ধরনের ভাগচাষ প্রথা বিদ্যমান ছিল তা সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন ব্যবস্থারই সূচক ছিল। এখানে জমির মালিকেরা উত্পাদন নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামেই বাস করতো না। যা উদ্বৃত্ত হতো তাকে পুঁজিতে পরিণত করে উত্পাদন বৃদ্ধিতে তাকে নিয়োজিত করার কথা ভাবতো না। তা ব্যয় করতো নানা ভোগ-বিলাসে।

নিঃসন্দেহে এ ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক। কিন্তু ভাগচাষে জমির মালিক যদি উত্পাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে আগ্রহী থাকে, যদি উত্পাদন খরচের সবটাই ভাগচাষীর উপর না চাপিয়ে নিজেই কিছুটা খরচ করে উত্পাদন সামগ্রী বা কাঁচামাল কেনার জন্য ভাগচাষীকে ঋণ দেয় বা কৃষিকাজ তদারকি করার জন্য চাষের এলাকা থেকে দূরে বাস না করে, চাষের এলাকায় বাস করতে থাকে তবে স্পষ্ট প্রমাণিত হবে যে জমি মালিকের মনোভাবে উত্পাদন বৃদ্ধি করে মুনাফা অর্জনের ইচ্ছা তৈরি হয়েছে। তখন আর এ প্রবণতাকে সামন্ততান্ত্রিক বলা যাবে না, তাকে পুঁজিবাদীই বলতে হবে। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশক থেকে ভাগচাষের জমির মালিকেরা এ প্রবণতা দেখাতে শুরু করেছে এবং পরবর্তীকালে তা অনেক বেড়েছে। ভাগ-চাষ প্রথার সাথে যে পুঁজিবাদী প্রথার চাষের কোন প্রকৃতিগত বিরোধ নেই তার প্রমাণ ভারতে যে সব অঞ্চলে (পাঞ্জাব-হরিয়ানা ইত্যাদি) পুঁজিবাদী কৃষি-ব্যবস্থার তুলনামূলক বিকাশ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কোন বিতর্ক নেই, সেখানে কৃষিতে ভাগচাষ প্রথা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ছোট জোতের মালিকরা কৃষির জন্য ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যাবার ফলে নিজেরা চাষ করতে না পেরে কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে সক্ষম বড় কৃষকের কাছে ভাগে জমি দিয়ে দিচ্ছে এমন ঘটনা সবারই জানা। এই ভাগচাষ অবশ্যই পুঁজিবাদী।

এ রকম আর একটি ভুল ধারণা হচ্ছে কৃষিতে ছোট জোতের প্রাধান্য মানেই তা সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন ব্যবস্থায় দ্যোতক। তাত্ত্বিক যুক্তি হিসাবে যেটা বলা হয় তা হলো যেহেতু পুঁজিবাদী কৃষিতেও পুঁজির স্বাভাবিক নিয়মে কেন্দ্রীভবন ঘটে, তাই চাষের জমিরও কেন্দ্রীভবন ঘটা অনিবার্য। অর্থাৎ কৃষিতে প্রযুক্ত পুঁজি যদি ক্রমান্বয়ে অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে, তবে কৃষিযোগ্য জমিকেও সেইভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে উঠতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ ইংল্যান্ডের পুঁজিবাদী বিকাশের সময় ক্ষুদ্র কৃষকদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা বলা যায়। তত্ত্বগতভাবে এ যুক্তি একেবারে নিশ্ছিদ্র নয়, কারণ পুঁজিবৃদ্ধির মাপ শুধু জমির বৃদ্ধি দিয়ে না হয়ে একই জমিতে উন্নত পদ্ধতিতে চাষের জন্য অন্যান্য উপকরণের অনেক বেশি ব্যবহারের মাধ্যমেও হয়। ভারতের পুঁজিবাদী কৃষির বিকাশ মূলত এইভাবেই হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি আয়তনের জোত মালিকদের পুঁজিনিবিড় চাষ বাড়িয়ে বড় জোতের মালিকের গ্রাস থেকে রক্ষা পাবার ঐতিহাসিক উদাহরণ হচ্ছে ফ্রান্স। ভারতের ক্ষুদ্র জোত সম্পর্কে দুটি পর্যবেক্ষণ এখানে করে নেওয়া যেতে পারে। প্রথমতঃ বিশ্বায়নের জাঁতাকলে পিষ্ট ছোট জোতের মালিক চাষি ঋণভার থেকে মুক্তির আশায় উত্পাদন বাড়াবার জন্য সর্বস্ব পণ করে। সে একদিকে যেমন আবার ধার করে চাষের উন্নততর উপকরণ জমিতে প্রয়োগ হবে, অন্য দিকে পারিবারিক শ্রমকে আরও বেশি মাত্রায় জমিতে নিয়োগ করে। এর ফলে ছোট জোতের উত্পাদনশীলতা বড় জোতকে ছাপিয়ে গেছে। এর ফলে ছোট জোতও পুঁজিবাদী চাষের আওতায় চলে এসেছে। দ্বিতীয়তঃ বিশ্বায়নের প্রকোপেই চাষের খরচা এমন বেড়ে গেছে এবং উত্পাদিত পণ্যের দাম কমে গেছে যে ভারতে বড় চাষিদের পক্ষেও এখনও আর কৃষি কাজ চালিয়ে যাওয়া লাভজনক নয়। ফলে তারা উদ্বৃত্ত পুঁজি কৃষিতে বিনিয়োগ না করে কৃষি-উপকরণের ব্যবসা বা অন্যান্য নানা ধরনের ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করছে। ছোট জোতের কেন্দ্রীভবন না হওয়ার এটা একটা বড় কারণ এবং তা পুঁজিবাদের সঙ্কটকেই সূচিত করছে।

আধাসামন্ততান্ত্রিক কৃষি-ব্যবস্থাই ভারতে আজও প্রাধান্যকারী রয়েছে এ কথা যাঁরাই বলেন তাঁরা এ দেশে মহাজনী কারবারের ব্যাপক প্রচলনের উদাহরণ দেন। এ কথা ঠিক মহাজনী কারবার বলতে যা বোঝায় অর্থাৎ পুঁজি উত্পাদনে নিয়োগ না করে অনত্পাদক সুদের কারবারে নিয়োজিত করা ও ঋণগ্রহীতাকে অর্থনীতি বহির্ভূত উপায়ে দাবিয়ে রাখা— তা নিঃসন্দেহে প্রাক-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। ভারতের মহাজনী সমগ্র ঋণ ব্যবস্থার এক চতুর্থাংশে পরিণত হয়েছে এ হিসেব আমরা আগেই দেখিয়েছি। তার সঙ্গে যেটা যোগ করা উচিত তা হচ্ছে যে কোন ব্যক্তিগত ঋণই মহাজনী ঋণ নয়। ধনী চাষি যখন উত্পাদন ব্যবস্থাকে মৃসণ রাখার লক্ষ্যে বা উত্পাদন বাড়াবার লক্ষ্যে ঋণ দেয় তখন তাকে আর প্রাকপুঁজিবাদী মহাজনী ঋণ বলা যাবে না। ক্ষেতমজুরদের দাদনও অনেক সময় পুঁজিবাদী ধনী চাষি দিয়ে রাখে যাতে চাষের সময় মজুর নিয়োগ নিশ্চিত থাকে। ভাগচাষীদের ঋণ দিয়ে উত্পাদন বাড়াবার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই ঋণ চরিত্রগতভাবে পুঁজিবাদী। কিন্তু যে পরিমাণে এ ঋণ প্রাতিষ্ঠানিক নয়, সেই পরিমাণে তা নৈব্যক্তিকও নয়। তাই একে আবার পুরোপুরি পুঁজিবাদী চরিত্রেরও বলা যাবে না। আমাদের দেশের ধনী চাষীরা বেশিরভাগই সুদের কারবার করে কারণ তাতে লাভ বেশি হয় বলে একটা কথা চালু আছে। এ কথাটিও আংশিক সত্য, কারণ কৃষিতে গত কয়েক দশক ধরে উত্পাদিকা শক্তি বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ মূলত ধনী চাষিরাই করে গেছে।

পূর্বের আলোচনাগুলি থেকে এবার আমরা বোধহয় কয়েকটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি—

১) প্রাক-ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক আমল থেকেই ভারতে শিল্প পুঁজি বিকাশের এক ধারাবাহিক ইতিহাস আছে, যা অন্যান্য ঔপনিবেশিক দেশগুলি থেকে আলাদা।

২) প্রাক-স্বাধীনতা যুগে যে শিল্প ভিত্তি তৈরি হয়েছিল তাতে ভর করে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে লাগাতার শিল্প-বিকাশ ঘটতে থাকে যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুঁজির দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে আরও বেগবান হয়।

৩) বিশ্বায়নের পর্বে ভারতের বৃহৎ পুঁজি বিশ্বায়িত আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পুঁজি-বৃদ্ধির মাত্রা এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে ভারতের বৃদ্ধির হার পশ্চিমী পুঁজিবাদী দেশের হারকে অনেক সময় পিছনে ফেলে দেয় এবং সে নিজেও আন্তর্জাতিক পুঁজির বাজারে রীতিমতো এক প্রতিযোগী শক্তি হয়ে ওঠে।

৪) স্বাধীনতার পর থেকে কৃষি-ক্ষেত্রে ওপর থেকে নানা ধরনের কৃষি-সংস্কারের উদ্যোগ চালু হয়, ভূমি সংস্কারের আধা-খ্যাঁচরা উদ্যোগ যার মধ্যে প্রধান।

৫) ১৯৬০-এর দশক থেকে প্রধানত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বাবধানে ভারতে শুরু হয় ''সবুজ বিপ্লব'' যাতে ভারতের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রদেশে কৃষি ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি বিনিয়োগ হয় এবং সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন-সম্পর্ক ভাঙতে শুর করে।

৬) বিশ্বায়ন পর্বে ভারত সরকারের তরফে ''গ্যাট'' চুক্তিতে সই করার পর ভারতের গোটা কৃষি ক্ষেত্রকে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সামনে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এখন তার কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে নয়, গোটা দেশের কৃষিতে পুঁজিনিয়োগ বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। বহুজাতিক সংস্থাগুলি যেমন ফলে ফেঁপে ওঠে তেমনি এক ধীর প্রক্রিয়ায় কৃষিতে সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক ভাঙতে থাকে।

৭) কৃষি ক্ষেত্রে সর্বহারা-আধা-সর্বহারারা সংখ্যাধিক হয়ে ওঠে; উত্পাদিত পণ্যের সিংহভাগ বাজারে চলে গিয়ে মুনাফা সৃষ্টি করে এবং তা অনেক ক্ষেত্রে কৃষিতেই পুনর্নিয়োজিত হয়ে ক্রমান্বয়ে কৃষিক্ষেত্রে উত্পাদিকা শক্তির বৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে, কখনো বা অন্য কোন পুঁজিবাদী উদ্যোগে ব্যবহার হচ্ছে।

৮) কৃষি-ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কের এই ভাঙন বা শিল্প পুঁজির এই বিকাশ কোন বুর্জোয়া সংস্কার বা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ঘটেনি, ঘটেছে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপে এবং উপর থেকে। এই বিকাশ তাই 'বিকৃত' বিকাশ, যা সামন্তবাদী অবশেষকে বহুল পরিমাণে টিকিয়ে রেখেই ঘটেছে।

৯) এই প্রবন্ধে দেওয়া পরিসংখ্যান এবং তা থেকে যে যে পর্যবেক্ষণ সমূহ বেরিয়ে আসছে তা অনিবার্যভাবে আমাদের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয় যে ভারতে পুঁজিবাদের বিকাশে সমস্ত বিকৃতি ও পশ্চাত্পদতা সত্ত্বেও ১৯৮০-র দশকের শেষ থেকে ১৯৯০-এর দশকের শুরুর পর্বে পুঁজিবাদ প্রাধান্যকারী স্থান নিয়ে নিয়েছে এবং দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিরাই দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এই সময় থেকেই ভারতকে চিহ্নিত করতে হবে একটি অত্যন্ত পিছিয়ে পুঁজিবাদী দেশ হিসেবে।

একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া কি একটি আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশ পুঁজিবাদী দেশ হয়ে উঠতে পারে?

এখনও পর্যন্ত কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরে এই রকম একটি প্রশ্ন উত্থাপন করাটাকেই গর্হিত কাজ বলে বিবেচনা করা হয়। এর মূল নিহিত রয়েছে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যেই। ১৯৬০ বা ১৯৭০ দশকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের অঘোষিত কিন্তু অবিসংবাদী নেতৃত্ব কমঃ মাও সে তুঙের নেতৃত্বাধীন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (CPC) বিশ্বপরিস্থিতি এবং পশ্চাত্পদ দেশগুলিতে বিপ্লবের প্রকরণ হিসেবে প্রাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, প্রাক-চীন বিপ্লবের মডেলটিকেই এমন জোরে সোরে উত্থাপন করে গেছে যে ঐ দুটি যুগান্তকারী ঘটনার পরে সাম্রাজ্যবাদের কর্মপদ্ধতিতে যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে এবং সেগুলি নিয়ে যে গভীর চর্চা শুরু করার প্রয়োজন তার ইঙ্গিত-মাত্রও দেয়নি। ফলে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা অন্য কিছু ভাবার সাহস দেখাবে কি করে? একে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের পুরনো অভ্যেস বিদেশী কোন পার্টির প্রতি অন্ধ আনুগত্য একটি ঐতিহ্য হিসেবে চেপে বসেছিল। অন্যদিকে জন্মকালীন মতাদর্শগত দুর্বলতা দৃষ্টিভঙ্গীর ক্ষেত্রে এক ধরনের বদ্ধমূলতা (fixedness) উপহার দিয়েছিল। এর বিষম ফল এখনও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। পৃথিবী উল্টে গেলেও তৃতীয় বিশ্বের যে কোন দেশকে আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক ধরে নেওয়া এবং তদনুযায়ী নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী গ্রহণ করা প্রায় বুক দিয়ে আগলে রাখার মত বিষয় হয়ে রয়েছে। তাঁদের যুক্তি কাঠামোটি এই রকম। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হবার পরেও সাম্রাজ্যবাদের চেষ্টা থাকবে প্রভাবাধীন দেশটিতে পশ্চাত্পদতা বজায় রেখে পুঁজির আঙ্গিক গঠনকে কম রাখতে যাতে সেখানে লগ্নী পুঁজি বিনিয়োগে তার মুনাফার হার বেশি থাকে। এই পশ্চাত্পদতা বজায় রাখতে তার নির্ভরযোগ্য সহায় সেই দেশের কমপ্রাডর বৃহৎ বুর্জোয়া যারা সাম্রাজ্যবাদ ও নিজেদের স্বার্থে সেদেশে মৌলিক ভূমিসংস্কার করবে না। গ্রামীণ ভূসম্পত্তির মালিকেরা সামন্ততান্ত্রিক হবার ফলে জমি থেকে প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত মূলতঃ ভোগ করে ফেলে। সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় খুঁটি এরাই, কারণ দেশে পশ্চাত্পদ অর্থনীতি বজায় রাখতে এরাই বড় সহায়ক। সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-বৃহৎ কমপ্রাডর পুঁজির এই অক্ষ সাম্রাজ্যবাদী লগ্নী পুঁজির স্বার্থ সব চেয়ে ভালভাবে দেখে এবং যতদিন না নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে এই জোটকে চূর্ণ করা যাবে ততদিন এই ব্যবস্থা একটা পরিবর্তনীয় রূপ নিয়ে দীর্ঘকাল বজায় থাকবে। দেশে শিল্পের বিকাশ এবং কৃষিতে পুঁজিবাদের বিকাশ একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আটকে থাকবে এবং উত্পাদন সম্পর্কের কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটা অসম্ভব হবে। বিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রথমভাগে পশ্চাত্পদ দেশের বিপ্লব সম্পর্কে তৃতীয় আন্তর্জাতিক এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির এই বিধান একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে একইভাবেই আঁকড়ে রয়েছেন বহু কমরেড।

চীন বিপ্লবের বিজয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কতগুলি গুরুতর পরিবর্তন সাধন করেছে। তার প্রতি মনোযোগ না দিয়ে আজকের বিশ্বকে কোনমতেই বোঝা যাবে না, তার সাথে বোঝা যাবে না আজকের সময়ের বিপ্লবের পদ্ধতি-প্রকরণ। প্রথমে চীন বিপ্লবের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা যাক। চীন বিপ্লবের বিজয় সাম্রাজ্যবাদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। নিতান্ত পিছিয়ে পড়া দেশেরও বুভুক্ষু কৃষক কীভাবে মার্কিন বা জাপানী সাম্রাজ্যবাদকে সমূলে উৎপাটিত করতে পারে তার এক জ্বলন্ত নিদর্শন হিসেবে চীন বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদের কাছে বিভীষিকা হয়ে গেছিল। এ ঘটনার যাতে আর পুনরাবৃত্তি না হয় তার জন্য সাম্রাজ্যবাদ অত্যন্ত সচেতনভাবে পশ্চাত্পদ সদ্যস্বাধীন দেশগুলির গ্রামাঞ্চলে কিছু সংস্কার কর্মসূচী নিয়েছিল। এই দেশগুলিকে ''কলম্বো প্ল্যানের'' অন্তর্ভুক্ত করা থেকে শুরু করে এ সব দেশে ভূমিসংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করা এবং পুঁজি বিনিয়োগ করে খাদ্যোত্পাদন বাড়িয়ে ক্ষুধাকে খানিক প্রশমিত করা— এ সবই সেই কর্মসূচীর অন্তর্গত। আমাদের দেশে ''সবুজ বিপ্লব'' প্রবর্তন করার অন্য অনেক কারণের মধ্যে এটিও একটি। আমাদের দেশের শাসকশ্রেণী যে ১৯৫০-এর দশক থেকেই ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমিদারি প্রথা বিলোপ করলো বা জমির উর্ধ্বসীমা বেধে দেবার মত ভূসম্পত্তির মালিকদের বিরুদ্ধে যায় এমন সব আইন করলো তার পশ্চাত্পটে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিসংস্কারের প্রবক্তাদের পরামর্শ ছিল না তা মনে করার কোনও কারণ নেই। ১৯৪০-এর দশকের শেষভাগে জাপান সরকারও ভূস্বামীদের কাছ থেকে জমি কিনে নিয়ে ভাগচাষীদের কাছে বিক্রি করেছিল। চীন বিপ্লবের পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পশ্চাত্পদ দেশে উপর থেকে ভূমিসংস্কার কর্মসূচী সাম্রাজ্যবাদ নিতে বাধ্য হয়েছিল এবং তার ফলে সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন ব্যবস্থার ক্ষয় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তবে এই ক্ষয় ছিল খুব শ্লথগতি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পুঁজিবাদী দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ এক কঠিন সঙ্কটের মুখে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্পষ্ট বোঝা যায় যে জাতিরাষ্ট্র-ভিত্তিক একচেটিয়া পুঁজি দেশের বাইরে পুঁজি রপ্তানি করে বা পুঁজি রপ্তানির ক্ষেত্র দখল করার জন্য যুদ্ধ করেও তার সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার বদ্ধ দশা থেকে বেরোতে পারছে না। জাতি-রাষ্ট্র-ভিত্তিক একচেটিয়া যখনই তার নিজস্ব উত্পাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার সুযোগ হারালো তখনই তার সঙ্কট শুরু হলো। তাই দেখা যায় ১৮৮১ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত (য়ার মধ্যে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ মারফৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের পুঁজিরপ্তানির ক্ষেত্রগুলিকে পুনর্বিভাজিত করেছে) শিল্পোত্পাদনের বৃদ্ধির নিম্নমুখী হার রোধ করতে পারে নি। এর মূল কারণ সঞ্চয়ন প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে তাকে যে ক্রমাগত বর্ধিত হারে ভোগ্যদ্রব্য উত্পাদন করতে হয় দেশের অভ্যন্তরে তার বাজার ফরিয়ে যাবার পর সে ভোগ্যদ্রব্যের চাহিদা আছে এমন অন্য ক্ষেত্র নতুন করে আর পায় নি। যুদ্ধ করেও এ সমস্যার মীমাংসা হলো না। অতীতে একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও পুঁজি তার একচেটিয়ার যাত্রা পথে একটা সময় সঞ্চয়নের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। পৃথক পৃথক বিদ্যমান পুঁজিগুলি নিজ নিজ ঘনীভবন প্রক্রিয়ার (concentration of capital) মাধ্যমে আর বৃদ্ধি পাচ্ছিল না, প্রক্রিয়াটি এত ধীর হয়ে গিয়েছিল এবং পুঁজিপতিদের উত্তরাধিকারী মধ্যে বিভাজনের কারণে এত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল যে মুনাফা অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়োজনেই ভিন্ন ভিন্ন পুঁজির পারস্পরিক মিলনের মাধ্যমে পুঁজির কেন্দ্রীভবন (centralisation of capital) এক অনিবার্য সমাধান সূত্র হিসেবে হাজির হয়েছিল। পুঁজির সঞ্চয়নের ক্ষেত্রে এটি একটি দ্রুতগতি প্রক্রিয়া। ঐ সময় প্রয়োজন ছিল আরও বৃহত্তর পরিসরে উত্পাদন এবং তার সাহায্যে শ্রমের উত্পাদনশীলতা বাড়িয়ে তোলা। এইভাবেই কেবলমাত্র সম্ভব হয়েছিল মুনাফার উর্ধ্বমুখী হারকে বজায় রাখা। দেখা যাচ্ছে পুঁজির সঙ্গে পুঁজির সহজাত দ্বন্দ্ব সংঘর্ষ যেমন থাকে (যা দু'দুটো বিশ্বযুদ্ধের সৃষ্টি করেছে) তেমনই তার মধ্যে থাকে পরস্পরের সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া। একটা সময় আসে যখন পুঁজির অস্তিত্বের প্রাণভোমরা মুনাফার ক্রমিক উচ্চতর হারকে বজায় রাখতে পুঁজিপতিরা তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের অহংটিকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিরাষ্ট্র-ভিত্তিক একচেটিয়াগুলি আবার পুঁজির সঞ্চয়ন, শ্রমের উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বৃহত্তর পরিসরে উত্পাদনকে ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে সঙ্কটে পড়লো। বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে বা বিশ্বে প্রভাবাধীন এলাকার পুনর্বিন্যাস করে যে এ সঙ্কট থেকে মুক্তি নেই তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। এখন একমাত্র সমাধান হতে পারে জাতিরাষ্ট্রের গণ্ডি ভেঙেচুরে আন্তর্জাতিক স্তরে একচেটিয়া পুঁজির কেন্দ্রীভবন। হলোও তাই। ভিন্ন ভিন্ন জাতিরাষ্ট্র-ভিত্তিক একচেটিয়াগুলির মধ্যে কেন্দ্রীভবন মারফৎ বহুজাতিক সংস্থার উদ্ভব বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে হয়ে উঠলো পুঁজিবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। জাতিরাষ্ট্রের বাইরে পুঁজির চলে যাওয়া এখন আর পুঁজির বহির্গমন নয়, তা হয়ে উঠলো আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির আভ্যন্তরীণ চলাচলেরই অংশ। পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন এই প্রক্রিয়ারই আনুষ্ঠানিক রূপ।

পুঁজির সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার, শ্রমের উত্পাদনশীলতার এবং ভোগ্যপণ্যের বাজারের সঙ্কট সাময়িকভাবে হলেও অতিক্রম করা গেল। পুঁজির এই বিশ্বজোড়া চলাচল একদিকে পৃথিবী জুড়েই পুঁজিবাদের বিকাশধারার আরও বিস্তৃতি, আরও গভীরতা লাভ করলো, অন্যদিকে এই পুঁজি নিজের অস্তিত্বের স্বার্থেই বাজার সম্প্রসারণের অভিযানে নামালো। এটা করতে গিয়ে পিছিয়ে পড়া দেশের বাজার তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। তারমধ্যে আবার ভারতের বাজার তার কাছে লোভনীয়। কারণ অন্যান্য পিছিয়ে পড়া দেশের তুলনায় ভারত ইতিমধ্যেই অগ্রসর অবস্থায় ছিল। নানাধরনের কৃষিসংস্কার ভারতের সামন্তবাদী উত্পাদন ব্যবস্থায় নানা ক্ষয় ধরিয়ে ছিল। বিশ্বায়িত পুঁজি ভারতের কৃষিতে যখন হুহু করে ঢকতে থাকলো তখন তা আরও দ্রুত আরও ব্যাপকভাবে ভারতের কৃষিতে সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন সম্পর্ক ভাঙতে লাগলো। পুঁজির আঙ্গিক গঠন বাড়ার ফলে মুনাফার হার নিম্নমুখী যেমন হলো, তেমনি পশ্চাত্পদ দেশগুলিতে বাজার সম্প্রসারণ করে পণ্যের রপ্তানি বাড়িয়ে সামগ্রিক মুনাফা বাড়াবার দরজাও খুলে গেল। উন্নত দেশগুলিতে যেসব পণ্যের বাজার সংকুচিত হয়ে পড়েছে ভারতের মতো দেশে সেই পণ্যের বাজার তৈরি করা হলো। যেমন নাইট্রোগ্লিসারিনের চাহিদা বিশ্বযুদ্ধের অবসানে কমে যাওয়ার পরে ''সবুজ বিপ্লব''-এর অঙ্গ হিসেবে ভারতে নাইট্রোজেন সারের বিপুল বাজার খুলে গেলো। বিশ্ব-একচেটিয়া তার বাজার সম্প্রসারণশীল রাখার জন্য ''মেধাস্বত্ব আইন''-সহ নানা বৈষম্যমূলক আইন চালু করে পুঁজির আঙ্গিক গঠনের সাথে সাথে মুনাফার হারও বাড়িয়ে চললো। ফল, সবজি, ফুল, চিংড়ি, মাছ ইত্যাদি যে পণ্যগুলির বিদেশে চাহিদা আছে তার উত্পাদনের জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলি পরিকাঠামো গড়তে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করলো। পরিবেশগত কারণে যে সব পণ্য উত্পাদন সাধারণ মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক (পরমাণু বিদ্যুত) সেগুলি ভারতের মতো দেশে স্থাপন করে পুঁজির বাজার আরও সম্প্রসারিত করলো। দেখা যাচ্ছে বিশ্বায়নের কালে আমাদের দেশে পুঁজির বিকাশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, খুব সীমিতও নয়। আবার এই বিকাশ যেহেতু বিশ্বায়িত পুঁজির স্বার্থে, আমাদের দেশের উন্নয়নের স্বার্থে নয়, তাই তা বিকৃত চরিত্র নিয়ে উপস্থিত।

তাই ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য ভারতের ''বিকাশে''র দিকটি, তার পুঁজিবাদী চরিত্রকে যেমন বোঝা দরকার তেমনই এর পশ্চাত্পদতার মাত্রা, চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যকে গভীরভাবে বোঝা প্রয়োজন। ভারতীয় সমাজ ও অর্থনীতি চরম বিপরীতের ঐক্যের এক অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক গবেষণা-ক্ষেত্র।

বর্তমান ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে আরও কিছু কথা

জাতিবর্ণভেদ প্রথা, জাতিসত্তার শক্তিশালী উপস্থিতি, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও নারীর উপর পুরুষতন্ত্রের মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব— এগুলি ভারতীয় সমাজে এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রেখেছে যে তার সম্পর্কে কিছু কথা না বললে ভারতীয় সমাজকে তার বৈচিত্র্যময়তায় বোঝা যাবে না।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে বর্ণাশ্রম ও জাতিবর্ণভেদ ব্যবস্থা দুটি পৃথক কালে উদ্ভুত সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যার সঙ্গে তুলনীয় কিছু অন্য কোন দেশে পাওয়া যাবে না। খৃষ্টপূর্ব ৩০০ সালের পরবর্তী ৮০০ বছরে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা ধীরে ধীরে জাতিবর্ণভেদ প্রথায় রূপান্তরিত হয়। খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে যখন কৃষির উপর নির্ভর করে ব্যবসাবাণিজ্য, রেশম চাষ, হস্তশিল্পের বিকাশ ঘটে তখন শূদ্রদের মধ্যে কৃষি ত্যাগ করে হস্তশিল্পে যোগ দেবার প্রবণতা বাড়ে। তাকে প্রতিহত করার জন্য খ্রিস্টীয় ২০০ সাল নাগাদ মনর বিধানকে ভিত্তি করে বর্ণাশ্রম প্রথার জায়গায় পেশাভিত্তিক বর্ণভেদ প্রথার সূত্রপাত ঘটানো হয়। এটাই ছিল মনুসংহিতার ব্রাহ্মণ্যবাদী মীমাংসা। ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রথাসমূহ ও সামাজিক রীতিনীতিগুলির দ্বারা সুরক্ষিত জাতিবর্ণভেদ প্রথা খ্রিস্টীয় ৬০০ সাল নাগাদ ভারতীয় সমাজের সর্বস্তরে আধিপত্য স্থাপন করে। ভারতীয় সামন্তবাদী উত্পাদন পদ্ধতির বিশেষত্ব হিসেবে বর্ণভিত্তিক উত্পাদন ব্যবস্থার এক সুদীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর জন্ম, গঠন ও বিবর্তনে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে শূদ্র, অতিশূদ্রদের মধ্যযুগ থেকে চলে আসা সংগ্রাম-সংঘর্ষ ভারতের সমাজ-জীবনে শ্রেণী সংগ্রামের এক বিশেষ ধরন তৈরি করেছে যাকে ঠিক মতো বুঝতে না পারলে সচেতন শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে তোলার কাজ অসম্ভব। স্বাধীনতার পর শিল্পে-নিযুক্তি নিম্নজাতিবণের মানুষদের জীবনে বিশেষ কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি। 'সবুজ বিপ্লব'-এর সূচনায় এই মানুষেরা নিজ নিজ পেশা থেকে ছিটকে গিয়ে কৃষি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কৃষকদের মতই বেশিরভাগ অসংগঠিত, অ-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্ষেত্রে নিয়োজিত হল। অকৃষিক্ষেত্রের সর্বহারা শ্রেণীর ৮০% মানুষ হচ্ছে ST, SC ও OBC ভক্ত। এদেরই এক বিশাল অংশ বেকার বা ছদ্ম বেকার। এর সাথেই উল্লেখ করা দরকার আদিবাসীদের কথা যারা সবচেয়ে বঞ্চিত, বিচ্ছিন্ন ও নিপীড়িত। এরা মোট জনসংখ্যার ৮%।

ভারত প্রকৃত অর্থে একটি বহুজাতিসত্তার দেশ, ''ভারতীয় জাতি'' হিসেবে গোটা দেশকে গড়ে তোলার এক কর্মসূচী ভারতের শাসকদের থাকলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিসত্তার লড়াইগুলি ভারত রাষ্ট্রের গঠন-বৈচিত্র্যকে সামনে তুলে ধরেছে। শাসকশ্রেণী বৃহৎ জাতিসত্তাগুলিকে ভারতীয়ত্ব হিসেবে তুলে ধরছে ও অন্যান্য অবদমিত জাতিসত্তাগুলিকে লুপ্ত করার চেষ্টা করছে। তার বিরুদ্ধে চলছে নিরবচ্ছিন্ন এক মরণপণ লড়াই, তা কখনও সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ ধরছে। কখনও এই লড়াইগুলির পিছনে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য ও মৌলবাদী চিন্তা থাকছে, কখনও বা থাকছে আঞ্চলিক মাঝারি বুর্জোয়াদের স্বার্থ। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের বা সাম্রাজ্যবাদী ইন্ধনও কখনও থাকছে। এ সব সত্ত্বেও সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে এই জাতি-সত্তাগুলির অবদমিত অনুভূতি ও জাতিসত্তা হিসাবে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। যদিও পৃথক পৃথক ছোট রাষ্ট্রের গঠন শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের কাছে কাম্য নয়, তবু অধিকারের প্রশ্নে একটি জাতিসত্তার বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার, এমনকি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের অধিকারকেও শ্রমিক শ্রেণী সমর্থন করবে।

ভারতের মেহনতি মানুষের মধ্যে ধর্ম, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গভীর প্রভাব ও শিকড় রয়েছে। মানুষের ধর্মবিশ্বাসের পিছনে রয়েছে একদিকে অসহায়ত্ব, নিজের ও মানুষের শক্তি সম্পর্কে অনাস্থা ও অবিশ্বাস অন্যদিকে কয়েক শ'বছর ধরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের ভাববাদী দর্শন চিন্তা ও আধুনিক বিজ্ঞানচর্চ্চায় অজ্ঞেয়বাদের তুমুল প্রভাব। তাই একেবারে অজ্ঞ, অশিক্ষিত মানুষ থেকে শুরু করে, শহুরে ''শিক্ষিত'' মানুষের মধ্যেও এর প্রভাব অবিসংবাদী। তাই আমাদের বুঝে নিতে হবে সমাজ বিপ্লবের প্রাক-মুহূর্তেও বিপ্লবের সমর্থক মানুষদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই থাকবেন ধর্ম ও ঈশ্বরে বিশ্বাসী। ধর্মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জাড়িয়ে রয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদ। ধর্মের আদিমতম আচার, অভ্যাস, রীতিনীতি, প্রথা ও অনুশাসনের ভিত্তিতে ধর্মে বিশ্বাসী মানুষকে সুসংগঠিত নির্দিষ্ট ছাঁচে গড়ে তোলা এবং ধর্ম বিশ্বাসে এক উগ্রতা সঞ্চার করা ধর্মীয় মৌলবাদের বৈশিষ্ট্য। সাধারণভাবে ধর্মের সাথে শাসকশ্রেণীর মতাদর্শ মিশে থাকে। ধর্ম চলমান শ্রেণী সংগ্রামকে দেখতে পায় না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বদলে ঈশ্বর বা আল্লার কাছে প্রতিকার চাইতে শেখায়, সমাজের বা শাসকশ্রেণীর যে কোন নিপীড়নকে পূর্বজন্মের পাপের ফল হিসাবে দেখায় ও ক্ষোভের আগুনকে নিষ্প্রভ করে দেয়। ধর্মীয় মৌলবাদ এই চিন্তার উপর মানুষকে সংগঠিত করে সমাজকে পিছনে টেনে রাখে। ধর্মের নাম করেই শাসকশ্রেণীর দলগুলি নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে উস্কে দেয়, দাঙ্গা সৃষ্টি করে। আমাদের দেশে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই শাসকশ্রেণী এই সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডল তৈরি করতে প্রথমত কাজে লাগিয়েছে এবং অনেকটা তার প্রতিক্রিয়াতেই অন্য সব ধর্মের মানুষদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। ধর্মবিশ্বাস দূর করা এক জরুরি গণতান্ত্রিক কর্তব্য। এর জন্য কখনও সরাসরি ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে হবে, কখনও বিশ্বাসে প্রত্যক্ষ আঘাত না দিয়ে যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা দিয়ে ধর্মবিশ্বাসকে প্রতিস্থাপিত করতে হবে।

শ্রেণীগত নিপীড়নের সঙ্গে নারীর জীবনে পিতৃতন্ত্রের নিপীড়ন সব সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ভারতে এই নিপীড়ন এক বিশেষ তীব্রতায় উপস্থিত। পুরুষের তুলনায় নারী অক্ষম— এই মৌলিক ভ্রান্তির উপর গড়ে উঠেছে পিতৃতন্ত্রের ধারণার সৌধ। পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পরিবার, বংশপরম্পরা, যৌন আকাঙ্ক্ষা, মানসিক ও শারীরিক তৃপ্তি চরিতার্থ করার জন্য নারীদের দাসসুলভ শ্রমদান ও বশ্যতা— এই হলো পিতৃতন্ত্রের মূলকথা। ভারতের ক্ষেত্রে মনুসংহিতা জাতিধর্ম ব্যবস্থার সাথে নারীর উপর নির্দিষ্ট করে দিয়েছে ধর্মীয় নানা বিধির অনুশাসন। তার মধ্যে আছে বাল্য বিবাহ, সতীদাহ, বৈধব্যদশার কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা। বর্তমান সময়ে এরই বিবর্তিত বহুবিচিত্র রূপ পণপ্রথা, কন্যাভ্রূণ হত্যা, বধূ নির্যাতন, ধর্ষণ, পরিবারের ভিতরে ও বাইরে যৌননিগ্রহ। পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে বুর্জোয়ারা ব্যক্তিগত সম্পত্তির সুরক্ষা ও শ্রেণী শাসনের স্থিতিশীলতা টিকিয়ে রাখতে বিবাহ ব্যবস্থাকে গৌরবান্বিত করছে, আবার স্ত্রীশিক্ষার প্রসার ঘটাচ্ছে পণপ্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইন করছে সংসদীয় বিভিন্ন ব্যবস্থায় নারীদের জন্য সংরক্ষণ। আবার পুঁজির বাজার সম্প্রসারণের জন্য নারীদেহকে পণ্য হিসাবে উপস্থিত করে বেশ্যাবৃত্তি, রূপচর্চা, ফ্যাশন শিল্প, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা, পর্ণোগ্রাফি, সেক্স ট্যুরিজম ইত্যাদিকে অবাধে প্রসারিত করছে। সব সমাজ ব্যবস্থাতেই বিবাহ ও পরিবার ব্যবস্থা পিতৃতন্ত্রের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। এই ব্যবস্থা ব্যক্তিগত মালিকানা ও শ্রেণী বৈষম্যের সাথে অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। বুর্জোয়া সংস্কারের ফলে বিবাহিত নারীদের উপর নির্যাতনের ক্ষেত্রে কিছু আইন রয়েছে, কিন্তু পুঁজিপতি শ্রেণী বা আধুনিক রাষ্ট্র বিবাহবন্ধন থেকে মুক্তির জন্য নারীর ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে বা বিবাহবিচ্ছিন্না নারীর দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। নারীর যৌনতার উপর অধিকার হরণ করতেও বিবাহ-ব্যবস্থা এক শক্তিশালী হাতিয়ার। অবিবাহিত নারীর জীবনে যৌনতার কোন সামাজিক স্বীকৃতি নেই। পিতৃতন্ত্রের নির্মাণ হিসেবেই সমগ্র সমাজে যৌন সম্পর্কের ধারণা গড়ে উঠেছে। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক নিরবচ্ছিন্ন লড়াই সমাজের অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। মনুসংহিতার বিধান আজও ভারতীয় মনোজগতে এমন গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে রয়েছে যে এখানে এই সংগ্রাম হবে অনেক বেশি জটিল ও কষ্টসাধ্য।

বর্তমান নিবন্ধে আমরা ভারতের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যের উপর আমাদের মনোযোগ প্রধানতঃ কেন্দ্রীভূত করায় অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে কেবল রূপরেখা বর্ণনা করা হলো। এগুলি নিয়ে বারান্তরে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা রইল।

শেষের কথা

ভারত সম্পর্কে আমাদের এই পর্যবেক্ষণ যে কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরের সাধারণভাবে গৃহীত ধারণার প্রায় বিপরীতধর্মী হিসেবে উপস্থিত হবে সে সম্পর্কে আমরা সচেতন। কিন্তু আমাদের বিচার ও উপলব্ধিতে, মনে হয়েছে অকুণ্ঠ চিত্তে সবার সামনে আমাদের বক্তব্য উপস্থিত করা প্রয়োজন। দুটি প্রত্যাশা নিয়ে আমরা এ কাজে হাত দিয়েছি। প্রথমতঃ আমরা মনে করি আমাদের দেশটি সম্পর্কে কতগুলি অনড় ধারণা থেকে বেরোবার একটি প্রক্রিয়া শুরু করা ভারতীয় বিপ্লবের রণনীতি ও রণকৌশল রচনার জন্য সবচেয়ে জরুরী কাজ। এ কাজে হাত দিয়ে আমরা অন্ততঃ এটুকু বোঝাতে পারবো যে এই বিষয়ে নতুন করে ভাবার ও গবেষণা করার যথেষ্ট অবকাশ আছে। দ্বিতীয় প্রত্যাশাটিও আমাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হচ্ছে বর্তমান প্রবন্ধটি একটি বড় প্রকল্পের সূত্রপাত মাত্র। যদি এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের শিবিরে ব্যাপক বিতর্ক, সমালোচনা, অনুসন্ধান ও গবেষণা শুরু হয় তবেই আমরা আমাদের ভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতাগুলি কাটিয়ে তুলতে পারবো এবং শুরু হবে একটি সম্মিলিত উদ্যোগ। একমাত্র তার সাহায্যেই ভারতীয় বিপ্লবের কর্মসূচীর রূপরেখা ক্রমশ পরিস্ফুট হতে থাকবে। এই প্রক্রিয়াটি শুরু হবার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকবো।

http://chintanmarxist.wordpress.com/2013/08/19/%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A6%AF%E0%A6%BC-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC/

No comments:

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...